ব্রাহ্মধর্ম – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব
ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ তথা বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে যে সত্যটি প্রকাশিত হয় তা হল— হিন্দুধর্ম মৌল সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট আচার ও বিধি সর্বস্ব অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।
হিন্দুধর্মের মধ্যে অসারতা ও যুক্তিহীনতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ধর্মের এই অন্তঃসারশূন্যতা তৎকালীন কিছু মননশীল মানুষের হৃদয়কে বিক্ষুব্ধ করে তুলল। তারা ধর্মের ক্ষেত্রে বা জীবনাদর্শের ক্ষেত্রে এক নতুন বোধ, নতুন চেতনা আনতে তৎপর হলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সমস্ত ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করে হিন্দুধর্মকে এক উদার সমুন্নত ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে অগ্রসর হলেন এই যুগের প্রথম আধুনিকমনস্ক মানুষ রাজা রামমোহন রায়।
এই প্রসঙ্গে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি— “যখন বঙ্গদেশ ভ্রম কুসংস্কারের অন্ধকারে আবৃত ছিল, যখন ধর্মহীন ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে বঙ্গীয় যুবকগণ নাস্তিকতা ও সংশয়বাদের স্রোতে পতিত হইয়া দুর্গতি সাগরের দিকে ধাবিত হইতেছিল, যখন ধর্মপ্রচারকগন বঙ্গসমাজে নিকৃষ্ট ধর্মমতের প্রাবল্য দেখিয়া হিন্দুধর্ম ও সমাজ রূপ দুর্গকে দলবলে আক্রমণ পূর্বক উহাকে কম্পিত করিয়া তুলিতে ছিলেন তখন মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় হিন্দু শাস্ত্রের তুমুল আন্দোলন উত্থিত করেন এবং হিন্দুধর্মের উচ্চ পবিত্র সত্য প্রচার করিয়া বঙ্গদেশকে এক নতুন আলোকে আলোকিত করেন।
সেই আলোকে ভ্রম ও কুসংস্কারের কুৎসিতভাব নাস্তিকতার ভীষণতা এবং খ্রিস্টীয়ান ধর্মের অসারতা প্রকাশিত হইয়া পড়িল।
বঙ্গদেশ দ্রুতবেগে যে অধোগতি প্রাপ্ত হইতেছিল তাহা রুদ্ধ হইয়া গেল। রাজা রামমোহন হিন্দুশাস্ত্র মন্থন করিয়া যে ধর্মমতের উদ্ধার করলেন এবং যাহার বলে বঙ্গদেশ— সমগ্র হিন্দু সমাজের মহোপকার সাধন করিলেন তাহাই ব্রাহ্মধর্ম।”
(আদি ব্রাহ্মসমাজ ও হিন্দু সমাজ। আশ্বিন ১৮২২ শক। ৬৮৬ সংখ্যা। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা)
রামমোহন যখন হিন্দুধর্মের সমুন্নত রূপ হিসেবে ব্রাহ্মধর্ম গড়ে তুললেন তখন তাঁকে তিন ধরনের উপদ্রব সহ্য করতে হয়েছিল একটি রক্ষনশীল হিন্দু পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা অপরটি খ্রিস্টান মিশনারীদের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে অপপ্রচার এবং তৃতীয়টি হল ইংরেজি শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে অনাস্থা। রামমোহন রায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে দেশের উন্নতি করতে হলে প্রথমেই ধর্মীয় কুসংস্কার বর্জন করে তাকে উন্নীত করতে হবে।
কারণ ধর্মের উপর এই ভারতবর্ষের তথা বাংলার মূল ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। তবে এই ধর্ম সংস্কার করতে গিয়ে তিনি অন্ধ ভাবে ইউরোপের অনুকরণ করলেন না। বরং স্বদেশের ঐতিহ্যের দিকেই দেশবাসীকে আকৃষ্ট করলেন।
হিন্দু ধর্মকে বিকৃতি থেকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির মূল শিকড় যেখানে প্রোথিত আছে সেই বেদান্তের দিকেই দৃষ্টি ফেরালেন। আশৈশব বেদ উপনিষদ কোরান বাইবেল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও আলোচনা দ্বারা রামমোহন একেশ্বরবাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। উদার অসাম্প্রদায়িক বিশ্বজনীন ধর্মই রামমোহন রায়ের ধর্ম ছিল।
১৮১৫ সালে রামমোহন অনুবাদ ও ভাষ্য-সহ বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় তিনি সর্বপ্রথম বেদান্তের ভাষ্যকার। রামমোহন বেদান্ত গ্রন্থ ও বেদান্তসার বাংলা হিন্দি এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ দুটির অনুবাদ করার মূল উদ্দেশ্য হল হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মনের ভ্রম দূর করা।
১৮২৮ সালে রামমোহন ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রাহ্ম আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। রামমোহনের ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল একটি মহান উদ্দেশ্য।
তিনি বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের উপাসক তাদের একত্রিত করে একটি সর্বধর্মীয় উপাসনা সভা গঠন করতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজকে তিনি কোনও বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ে পরিণত করতে চাননি। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের লোকেরই ব্রাহ্মসমাজ এসে উপাসনায় যোগদানের অধিকার ছিল।
বাল্যকাল থেকেই রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভাকে ব্রাহ্মসমাজে রূপান্তরিত করেন। তিনি রামমোহন রায়ের থেকেও দৃঢ়ভাবে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের বিরোধিতা করে হিন্দুসমাজের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক হয়েছিলেন।
তিনি প্রধানত বেদান্ত ধর্মের অনুশীলনে যত্নবান হলেন এবং ১৮৩৮ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রাহ্ম ধর্মকে হিন্দুধর্মের এক পরিশুদ্ধ রূপ হিসেবে তুলে ধরতে চান।
১৮৩০ সালের ১৫ই নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় বিদেশ গমন করেন এবং ১৮৩৩ সালে ব্রিস্টলে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে এই সময় ব্রাহ্মধর্মের আন্দোলন একেবারে ঝিমিয়ে পড়ে এবং নব্য শিক্ষিত হিন্দু তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই সময় একটা নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়।
এই সুযোগে খ্রিস্টান মিশনারীরা হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মেতে ওঠেন। তাই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য তা প্রচার করেন। দেশের প্রাচীন শাস্ত্র সম্বন্ধে দেশের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে অবজ্ঞা প্রকাশ পাচ্ছিল এবং তারা খ্রিস্টানুরাগী হয়ে উঠছিল।
কাজেই তখন প্রাচীন ঔপনিষদিক ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের কয়েকটি সার্থকতা ছিল। প্রথমত হিন্দু ধর্মের উৎস সন্ধান করলে একেশ্বরবাদের সমর্থন পাওয়া যায় এ কথা তখন উচ্চকণ্ঠে প্রচার করার প্রয়োজন ছিল। কারণ একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্মের প্রতিস্পর্ধী রূপে হিন্দুধর্মকে তুলে ধরা তখন অত্যন্ত জরুরি ছিল।
অপর সার্থকতা হল স্বদেশর বিভ্রান্ত তরুণ চিত্তকে স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের সামনে ভারতের প্রাচীন হিন্দু ধর্মের অপূর্ব রূপ উদঘাটিত করে দেওয়া।
তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গে সঙ্গে তত্ত্ববোধিনী মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় বেদ উপনিষদ এর আলোচনা ও বিলাতি বিজ্ঞানতত্ত্ব প্রভৃতির প্রচার বাংলা ভাষায় প্রবর্তন করেন।
খ্রিস্টধর্মের প্রবাহ রোধ করার জন্য রক্ষণশীল হিন্দুদের সঙ্গে সম্মিলিত হতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেননি। ধর্মান্তকরণের ঢেউ রোধ করার জন্য রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪ -১৮৬৭) এর সঙ্গে সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৮৪৬ সালের ১লা মার্চ চিৎপুর রোডে রাধাকৃষ্ণ বসাকের বৈঠকখানায় তিনি হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয় (ইংরেজি নাম— হিন্দু চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন) প্রতিষ্ঠা করেন। এই হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয় ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান অস্ত্র যা তিনি খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুধর্মের এই পুনরুত্থানের সন্ধিক্ষণে দক্ষিণেশ্বরের কালী বাড়িতে বিরাজ করছেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তিনি কলকাতায় ছুটে আসছেন। এখানকার গুণী শিক্ষত মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। নিজের আত্মোপলব্ধির সঙ্গে জ্ঞানী মানুষদের তত্ত্বজ্ঞান মিলিয়ে নিতে চাইছেন।
রানী রাসমনির জামাতা মথুরবাবুর কলেজের বন্ধু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দু’জনে একসঙ্গে হিন্দু কলেজে পড়তেন। একদিন মথুরবাবুর সঙ্গে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব এলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে, মনে ইচ্ছা কিছু তত্ত্বকথা শ্রবণ করবেন। প্রথম দর্শনেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে বিদ্যা, ঐশ্বর্য, মান, সম্ভ্রমের অভিমান দেখলেন। অভিমান শূন্যতাই প্রকৃত জ্ঞানীর লক্ষণ। তাই এখানে একটু অভিমানের অঙ্কুর দেখে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মনে প্রশ্ন উঠছে, “সেজবাবুকে বললুম – আচ্ছা অভিমান জ্ঞানে হয় না অজ্ঞানে হয়? যার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে তার কি আমি পণ্ডিত; আমি জ্ঞানী, আমি ধনী বলে অভিমান থাকতে পারে?”
(শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।প্রথম ভাগ)
কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মনোভাবের পরিবর্তন হল। “দেখলাম যোগ ভোগ দুইই আছে… বললুম তুমি কলির জনক। ‘জনক এদিক-ওদিক দুদিক রেখে খেয়েছিল দুধের বাটি।’ তুমি সংসারে থেকে ঈশ্বরে মন রেখেছ শুনে তোমায় দেখতে এসেছি;”
(শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত। ঐ)
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৈহিক লক্ষণ দেখতে চাইলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত করলেন। আবরণ মুক্ত হওয়া মানেই ভারমুক্ত হওয়া মালিন্যমুক্ত হওয়া আর আবরণ খুলে ফেললেই থাকে না কোনও অহংকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ দেখলেন দেবেন্দ্রনাথের গৌরবর্ণের বক্ষদেশর উপর কে যেন সিঁদুর ছড়িয়ে দিয়েছে। তার পার্থিবতনু হয়ে উঠেছে ভগবতী তনু। ঈশ্বরের স্পর্শ শরীরে বর্তমান। বললেন “তুমি জনক রাজার মতো দুখানা তরোয়াল ঘোরাও একখানা জ্ঞানের আর একখানা কর্মের। তুমি পাকা খেলোয়াড়।”
(পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব তাঁর কাছে কিছু ঈশ্বরীয় কথা শুনতে চাইলেন। দেবেন্দ্রনাথ বললেন—“এই জগত যেন একটি ঝড়ের মতো আর জীব হয়েছে— এক-একটি ঝাড়ের দীপ। আমি এখানে পঞ্চবাটিতে যখন ধ্যান করতুম ঠিক ওই রকম দেখেছিলাম। দেবেন্দ্রের কথার সঙ্গে মিলন দেখে ভাবলুম তবে তো খুব বড়লোক। ব্যাখ্যা করতে বললুম তা বললে ‘এ জগত কে জানতো?— ঈশ্বর মানুষ করেছেন তার মহিমা প্রকাশ করবার জন্য।ঝাড়ের আলো না থাকলে সব অন্ধকার, ঝাড় পর্যন্ত দেখা যায় না।’
(শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত)
উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সাক্ষাৎকার ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের পাতায় একটি স্মরণীয় ঘটনা। হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের সূচনা লগ্নে এই ঘটনাটির গুরুত্ব স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।