গম্ভীরা, বা গম্ভীরা গান, বাংলা লোকসংগীতের এক বিশেষ ধারা যা মূলত পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা এবং বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে উদ্ভূত। এটি মূলত একটি নৃত্য এবং গানের মেলবন্ধন, যা সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা হয়। গম্ভীরা গানের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন বাস্তবতা ও সমস্যা তুলে ধরা হয় এবং একে একে বিভিন্ন শৈলীতে ফুটিয়ে তোলা হয়।
গম্ভীরা গানের উৎপত্তি ও ইতিহাস
গম্ভীরা গানের উৎপত্তি মূলত শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। ‘গম্ভীর’ শব্দটি শিবের এক নাম, এবং গম্ভীরা গান শিবের বন্দনায় গাওয়া হয়। এটি একটি দীর্ঘ ইতিহাস সম্পন্ন লোকসংগীত, যা হাজার হাজার বছর আগে বাংলা অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয় যে, শিবের উৎসবের অংশ হিসেবে গম্ভীরা গান গাওয়া শুরু হয় এবং এটি ক্রমেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
গম্ভীরা গানের স্থানীয়তা ও পরিবেশন
গম্ভীরা গান পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার সাথে একেবারে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এখানে চৈত্রসংক্রান্তির সময় গম্ভীরা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গম্ভীরা গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি এক ধরনের দলবদ্ধ গান যা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মঞ্চে একসাথে পরিবেশন করেন। এর মধ্যে একটি চরিত্র সাধারনত নাতি এবং আরেকটি চরিত্র নানার ভূমিকায় থাকে। এই গান ও নৃত্যের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন বিষয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা, মানুষের সুখ-দুঃখ, ও নানা সমস্যার কথা আলোচনা করা হয়।
গম্ভীরা উৎসব
গম্ভীরা উৎসব মালদহের চৈত্রসংক্রান্তির সময় খুবই জনপ্রিয়। এই উৎসবের মূল অনুষ্ঠান গম্ভীরা গান ও নৃত্য পরিবেশন করে। এখানে সাধারনত শিবপূজা, তামাশা, ও বিভিন্ন নাটকীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের একাধিক ভাগ থাকে – যেমন ‘ছোট তামাশা’, ‘বড় তামাশা’ এবং ‘ফুলভাঙ্গা’ ইত্যাদি। প্রতিটি ভাগে গম্ভীরা গান এবং নৃত্য পালা-গম্ভীরা বা আদ্য গম্ভীরা ধরনের হতে পারে, যার মাধ্যমে সমাজের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
গম্ভীরা গানের ধরন
গম্ভীরা গানের দুটি প্রধান ধরন আছে – আদ্যের গম্ভীরা এবং পালা-গম্ভীরা। আদ্যের গম্ভীরায় দেব-দেবী বা শিবকে উদ্দেশ্য করে গান গাওয়া হয় যেখানে মানুষের সুখ-দুঃখের কথা পরিবেশন করা হয়। পালা-গম্ভীরায় দুজন লোক (নানা-নাতি চরিত্র) একে অপরের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে একটি সমস্যা তুলে ধরে এবং এর সমাধান প্রস্তাব করা হয়। এই ধরনের গম্ভীরা গানে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধানের পথ আলোচনা করা হয়।
গম্ভীরা মুখোশ ও নৃত্য
গম্ভীরা নৃত্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল মুখোশের ব্যবহার। বিশেষ করে মালদহ জেলার গম্ভীরা অনুষ্ঠানে মুখোশ তৈরির জন্য নিম এবং ডুমুর গাছ ব্যবহার করা হয়। মাঝে মাঝে মাটির মুখোশও ব্যবহার করা হয়। গম্ভীরা নৃত্যের সময়, গম্ভীরা মুখোশ পরিধান করা হয় এবং সেটি এক ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় পত্রের ধারণা তুলে ধরে। এই মুখোশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নরসিংহী, কালী, চামুণ্ডা, শুম্ভনিশুম্ভ বধ, লক্ষ্মী-সরস্বতী ইত্যাদি।

বাংলাদেশে গম্ভীরা
বাংলাদেশে গম্ভীরা গানের একটি পরিবর্তিত সংস্করণ দেখা যায়। এখানে গম্ভীরা গান পরিবেশন হয় নানা-নাতির ভূমিকায়, যেখানে নানা বা বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং তার নাতি একটি সমস্যা তুলে ধরে এবং এর সমাধান আলোচনা করে। বাংলাদেশের গম্ভীরা গানে শিবের উপস্থিতি এখন আর থাকে না, বরং এটি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের গম্ভীরা গানে বর্তমানে বাংলা ও হিন্দি সিনেমার সুরও প্রবেশ করেছে, যা গম্ভীরা গানকে আরও আধুনিক ও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
গম্ভীরা গানের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
গম্ভীরা গানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ভূমিকা রয়েছে। এটি শুধু এক ধরনের বিনোদনই নয়, বরং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনগণের মঙ্গলের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এই গানের মাধ্যমে সমাজের নানা সমস্যার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং তার সমাধানও প্রদানের চেষ্টা করা হয়।
গম্ভীরা গানের ইতিহাস ও তার পরিবেশন পদ্ধতি বাংলার লোকসংগীতের অন্যতম মূল্যবান অংশ। এটি শুধু একটি গান নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে এসেছে। গম্ভীরা গান যতই যুগের সাথে আধুনিক হচ্ছে, ততই এটি বাংলার সংস্কৃতির একটি অমূল্য অংশ হিসেবে নিজেদের স্থান ধরে রেখেছে।