অমলা দাশ (১৮৭৭—১৯১৯) ছিলেন বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী এবং রবীন্দ্র সংগীতের প্রবাদপ্রতিম গায়িকা। তার গান, সুর এবং সঙ্গীতচর্চা ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। তিনি শুধু গান গাইতেন না, তার কণ্ঠের বিশেষত্ব এবং তার গানের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্মের জন্য বাংলা সঙ্গীতজগতে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
জন্ম ও শৈশব
অমলা দাশের জন্ম ১৮৭৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায়। তার পিতা ভুবনমোহন দাশ ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, আর তার মা নিস্তারিনী দেবী ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। অমলা ছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নারী, যার মধ্যে ছিল একধরনের শৈল্পিক প্রতিভা। তার পিতা-মাতা দুজনেই সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন এবং তারা শৈশব থেকেই তাকে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।
অমলার পরিবার ছিল অত্যন্ত সাংস্কৃতিক এবং বিদ্যাশীষ্ঠ। তার অগ্রজ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন মহান নেতা, আর তার বড়দিদি তরলা, সঙ্গীতসাধিকা সাহানা দেবীর মা। এই পরিবারের পরিবেশই অমলাকে সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আগ্রহে উৎসাহিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সম্পর্ক
অমলা দাশের সঙ্গীত জীবনের বিশেষ এক অধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় তার গান রচনা করার সময়, অমলা তার কাছ থেকে তা শিখে গান গাইতেন। প্রাথমিকভাবে, রবীন্দ্রনাথের গান লিখে রাখার কাজটি অমলাই করতেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান গেয়েও তিনি শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের মাধুর্য ছিল একেবারে অনন্য।
গান রেকর্ডিং এবং সঙ্গীত জগতে পথচলা
অমলা দাশ শুধুমাত্র গায়িকা ছিলেন না, তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। ১৯১৪ সালে শারদীয়া পূজা উপলক্ষে প্রথম পুজোর গানের রেকর্ড প্রকাশ করে এইচএমভি (হিজ মাস্টার্স ভয়েস)। প্রথমবারের মতো তিনি অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে দুটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন—‘হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ’ এবং ‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী’। তিনি ‘মিস দাশ’ নামেও গান রেকর্ড করেন, কিন্তু পরে তার নিজ নামেই বেশ কিছু গান রেকর্ড করেন। তখনকার সমাজে, বিশেষত সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা গ্রামোফোন রেকর্ডে গান গাইতেন না। কিন্তু অমলা এই বাধা ভেঙে দিয়েছিলেন এবং তাঁর গানের মাধ্যমে নতুন এক পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন।
রেকর্ড করা গানের মধ্যে কিছু বিখ্যাত গান:
- হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ (ইমন কল্যাণ)
- প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী (সিন্ধু কাফি)
- চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না (বেহাগ)
- তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী (খাম্বাজ)
- ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা (মিশ্র ঝিঁঝিট)
- ওই রে তরী দিল খুলে (ভৈরবী)
- তিমির দুয়ার খোলো (রামকেলী)
অমলা দাশের কণ্ঠে এসব গান, আজও শ্রোতাদের মনে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তার গানগুলো সঙ্গীতের চিরন্তন সৌন্দর্য এবং আবেগের এক অসাধারণ প্রকাশ।
অমলা দাশের শিক্ষা ও অবদান
অমলা দাশ শুধু সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না, তিনি সমাজের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি পুরুলিয়া জেলার একটি মেয়েদের বিদ্যালয় স্থাপন এবং পরিচালনা করেছিলেন, যা তার সঙ্গীতের পাশাপাশি তার শিক্ষাদানের প্রতিভারও একটি পরিচায়ক। তার এ উদ্যোগ সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি সঙ্গীতের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তন ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন। অমলা তার অগ্রজ চিত্তরঞ্জন দাশের সহায়তায় ওই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অনেক প্রতিভাবান নারীকে সঙ্গীত ও শিক্ষা জগতের দিকে উদ্বুদ্ধ করেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
অমলা দাশ ১৯১৯ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তার অকাল মৃত্যু বাংলা সঙ্গীত জগতে এক শূন্যতা সৃষ্টি করে। তবে তার রেখে যাওয়া সঙ্গীত, শিক্ষা এবং সঙ্গীতের প্রতি তার অবিশ্বাস্য ভালোবাসা আজও তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
তার বোনঝি, সঙ্গীতজ্ঞ সাহানা দেবী, তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন—”তার কণ্ঠের তান যে কী অপূর্ব ছিল, দানাগুলি সব যেন আলাদা হয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠত। আর কী কণ্ঠই ছিল মাসিমার! কোথায় গলা চলে যেত তার সপ্তকের ধৈবত পর্যন্ত!” এই কথাগুলো তার কণ্ঠের অমিত সম্ভাবনা এবং অমলার গান গাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার একটি স্বীকৃতি।
অমলা দাশ ছিলেন বাংলা সঙ্গীতের এক দ্যুতিময় নক্ষত্র, যার কণ্ঠ এবং সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা আজও আমাদের মাঝে জীবন্ত হয়ে আছে। তার সঙ্গীত এবং সংগ্রাম আজও নারীদের শক্তি ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় এক অনুপ্রেরণা। তার গানে, জীবনে এবং শিক্ষা কর্মে তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।