ড. অনুপ ঘোষাল: ভারতীয় সঙ্গীতের এক কিংবদন্তি

রায়হান চৌধুরী
5 মিনিটে পড়ুন

ড. অনুপ ঘোষাল (১৯৪৪/১৯৪৫ – ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩) ছিলেন একজন অভিজ্ঞানী ভারতীয় গায়ক, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক, যিনি মূলত বাংলা গানের জগতে একজন মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। তার অসামান্য কণ্ঠ এবং সংগীতের প্রতি নিবেদিত জীবনের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে এক অনন্য স্থান অর্জন করেছিলেন। বিশেষত, তিনি সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “গুপী গাইন বাঘা বাইন” এবং “হীরক রাজার দেশে”তে গাওয়া গানের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। যদিও তিনি নজরুলগীতি শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন, তিনি বিভিন্ন ধরণের গানের মাধ্যমে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনা শুরু হয়েছিল “সাগিনা মাহাতো” নামক একটি বাংলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, যা তাকে আরো পরিচিত করে তোলে।

প্রারম্ভিক জীবন ও পরিবার

ড. অনুপ ঘোষাল একটি সঙ্গীতপ্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা, লেফটেন্যান্ট অমুল্য চন্দ্র ঘোষাল এবং মা, লেফটেন্যান্ট লাবণ্য ঘোষাল, দুজনেই সঙ্গীতের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। তার মা খুব ছোটবেলা থেকেই অনুপের সঙ্গীতশিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং ৪ বছর বয়সে তাকে সঙ্গীত শেখাতে শুরু করেন। তার এই শিক্ষা জীবন ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং তাঁকে একজন ভবিষ্যৎ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

শিক্ষা জীবন

অনুপ ঘোষাল ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অসীম আগ্রহ ও প্রতিভা প্রদর্শন করেছিলেন। মাত্র ৪ বছর বয়সে, তিনি কলকাতার অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রথম গানের অনুষ্ঠান গাইতে ছিলেন। তিনি ২৬ বছর পর্যন্ত সঙ্গীতের নানা শাখায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, যেমন ঠুমরী, খেয়াল, ভজন, রাগ, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি, আধুনিক বাংলা গান, এবং আরও অনেক লোকগান। এই সময়ে তিনি শিখেছিলেন বাংলার বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী বেগম সুচিত্রা গোস্বামী, সন্দীপচন্দ্র দত্ত, দেবব্রত বিশ্বাস ও মনীন্দ্র চক্রবর্তীর মতো সঙ্গীতজ্ঞদের কাছ থেকে।

তিনি কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর থিসিস ছিল “নজরুলগীতি – রূপ ও রসানুভূতি”, যা নজরুলগীতির গুণ ও অনুভূতির বিশ্লেষণ করে।

- বিজ্ঞাপন -

সংগীত জীবনের শুরু

ড. অনুপ ঘোষালের সংগীত জীবনের সূচনা হয় ১৯৬৬-৬৭ সালে, যখন তিনি ‘সংগীত ভারতী ডিগ্রি পরীক্ষায়’ শাস্ত্রীয় সংগীতে স্বর্ণপদক লাভ করেন। সেই সময়েই তিনি জাতীয় পণ্ডিত হিসেবে নির্বাচিত হন, শাস্ত্রীয় সংগীতে তার সর্বোচ্চ অবদানকে সম্মান জানিয়ে।

তাঁর প্রথম প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কাজ শুরু হয় ১৯ বছর বয়সে, যখন তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘গোপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রের জন্য গান গাইতে শুরু করেন। এই সিনেমার গানগুলি সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে স্থায়ী ছাপ রেখে যায় এবং তাকে এক বিশিষ্ট গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

চলচ্চিত্র জীবনের সাফল্য

ড. অনুপ ঘোষাল সিনেমা জগতে নিজের স্থান মজবুত করেন বিভিন্ন বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরি ও আসামী চলচ্চিত্রে গান গেয়ে। বিশেষত, “হীরক রাজার দেশে” (১৯৮১) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, তার কণ্ঠে অনেক বিখ্যাত গান রয়েছে, যেমন “তুমি সাথী হও জীবনে” এবং “তুজসে নারাज़ নাহি জিন্দগী”

বিদেশে সংগীত পরিবেশন

ড. অনুপ ঘোষাল তার জীবনের বড় অংশ সংগীত পরিবেশন করতে ইউকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানির মতো দেশগুলোতে ভ্রমণ করেছেন। তিনি পশ্চিমে ভারতীয় সঙ্গীত সংস্কৃতির প্রচারের জন্য বহুবার গেছেন এবং বিদেশে তার কণ্ঠের প্রশংসা পেয়েছেন। তাঁর সংগীত শুধু ভারতেই নয়, বিদেশেও অত্যন্ত জনপ্রিয়।

সাহিত্যকর্ম

একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তার অবদানের পাশাপাশি, ড. অনুপ ঘোষাল সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন। তিনি “গানের ভূবন” নামক একটি প্রামাণিক বই লিখেছেন, যেখানে ভারতীয় সঙ্গীতের মূল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সঙ্গীতের সার্বজনীনতা এবং তার ঐতিহ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতেন, এবং তিনি গবেষণা করেছিলেন যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যত উজ্জ্বল।

- বিজ্ঞাপন -

রাজনৈতিক জীবন

২০১১ সালে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তিনি উত্তরপাড়া কেন্দ্রে নির্বাচিত হন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় তার নির্বাচিত হওয়া ছিল একটি বড় রাজনৈতিক সাফল্য।

মৃত্যু

ড. অনুপ ঘোষাল ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে কলকাতায় ৭৮ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সঙ্গীত জগতের একটি বিরাট ক্ষতি, তবে তাঁর সঙ্গীত ও অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

ড. অনুপ ঘোষাল তার সঙ্গীত জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার:

- বিজ্ঞাপন -
  • জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৮১) – “হীরক রাজার দেশে” চলচ্চিত্রের জন্য
  • বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৯২) – শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক
  • সঙ্গীত ভারতী স্বর্ণপদক (১৯৬৭) – শাস্ত্রীয় সংগীতে শ্রেষ্ঠ গায়ক
  • এটি খ্যাতি পেয়েছেন বিভিন্ন দেশে, যেমন ১৯৯৪ সালে শিকাগো সিটি থেকে সম্মানিত নাগরিকত্ব প্রাপ্তি।

ড. অনুপ ঘোষাল ছিলেন একটি সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি, যার কণ্ঠের সুর আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। তার সংগীত চিরকাল ভারতীয় সঙ্গীতের ধারা ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করবে। তার অবদান সংগীত ও সংস্কৃতির জগতে অমর থাকবে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!