অনাদি কুমার ঘোষদস্তিদার ১৯০৩ সালে শ্রীহট্টে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। ১৯১২ সালে তিনি বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র হিসেবে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর সংগীতজীবনের বীজ রোপিত হয়। ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঁচ বছর ধরে গান শেখেন।
এর পাশাপাশি তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ভীমরাও শাস্ত্রী, নকুলেশ্বর গোস্বামী এবং কলকাতার রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছ থেকে। শুধু কণ্ঠসংগীতে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি বীণা বাজাতেও দক্ষতা অর্জন করেন এবং পরে একজন দক্ষ বীণাবাদক হিসেবে স্বীকৃতি পান। উদয়শঙ্করের নৃত্যদলে তিনি বীণা বাজানোর কাজও করতেন।
কর্ম ও সংগীতজীবন
১৯২৫ সালে কলকাতায় এসে অনাদি কুমার রবীন্দ্রসংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাইরে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পান।
১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ‘সংগীত সম্মিলনী’ ও ‘বাসন্তী বিদ্যাবীথি’তে শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি ‘গীতবিতান’-এর অধ্যক্ষ এবং পরবর্তী সময়ে অধিকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর হাত ধরেই রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
রেডিও, গ্রামোফোন ও চলচ্চিত্র
অনাদি কুমার ঘোষদস্তিদার রেডিও, গ্রামোফোন এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর উদ্যোগেই রেডিওতে ব্লক প্রোগ্রাম শুরু হয়।
সংগীত পরিচালক রাই চাঁদ বড়াল তাঁকে কলকাতার ‘নিউ থিয়েটার্স’-এ নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি বহু চলচ্চিত্রে সংগীত প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সংগীত প্রতিভার পরিধি শুধু কলকাতার চলচ্চিত্র জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি বম্বে টকিজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
থিয়েটার জগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিশির ভাদুড়ী তাঁকে থিয়েটার জগতে নিয়ে আসেন, এবং তাঁর ‘চিরকুমার সভা’ ও ‘শেষরক্ষা’ নাটকে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন। পরে তিনি স্টার থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত হন।
স্বরলিপি রচনা
রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনাদি কুমার ঘোষদস্তিদারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইন্দিরা দেবী চৌধুরীরানীর উদ্যোগে ‘স্বরলিপি সমিতি’ গঠিত হলে তিনি এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন এবং বহু গানের স্বরলিপি রচনা করে রবীন্দ্রসংগীতকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করেন।
চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত
বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি পথিকৃৎ। তাঁর পরিচালনায় প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হয়। চলচ্চিত্র ও সংগীতের সংযোগ ঘটিয়ে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মৃত্যু
১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অনাদি কুমার ঘোষদস্তিদার মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর অবদান আজও বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তাঁর প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রসংগীত শুধু শান্তিনিকেতন বা এলিট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছে।
অনাদি কুমার ঘোষদস্তিদার ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের অন্যতম অগ্রদূত। শিক্ষক, সংগীত পরিচালক, স্বরলিপি রচয়িতা, বীণাবাদক এবং চলচ্চিত্র সংগীতজ্ঞ—এসব ভূমিকায় তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর অনবদ্য কাজের জন্য বাংলা সংগীতজগৎ আজও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।