অদিতি মুন্সী একজন ভারতীয় বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী এবং রাজনীতিবিদ, যিনি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীত ও রাজনৈতিক পরিসরে একটি অসামান্য স্থান অধিকার করেছেন। ১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা অদিতি মুন্সী তার সঙ্গীত ও রাজনৈতিক কেরিয়ারে যে অর্জনগুলি করেছেন, তা তাকে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ভূদৃশ্যে একটি বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। তিনি হিন্দু ভক্তিমূলক সঙ্গীত, বিশেষ করে কীর্তন, গাওয়ার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, এবং তার রাজনীতির জগতে প্রবেশও তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। এই প্রবন্ধে, আমরা অদিতি মুন্সীর সঙ্গীত এবং রাজনৈতিক যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরব।
প্রারম্ভিক জীবন এবং সঙ্গীতের ভিত্তি
অদিতি মুন্সী কলকাতার বাগুইহাটির দক্ষিণপাড়া এলাকায় মণীন্দ্র মুন্সী এবং মিতালী মুন্সীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার সঙ্গীতের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং তারা পুরাতন সঙ্গীত ঐতিহ্যর মধ্যে বেড়ে ওঠে। অদিতির শৈশব কাটে কীর্তন গাওয়া এবং ধর্মীয় রীতিতে সঙ্গীত চর্চার মধ্যে। তার মা তাকে সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দেন এবং তার বাবা তাকে প্রেরণা জোগান। এই পরিবেশে অদিতির সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ গড়ে ওঠে, যা তাকে শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত করে তোলে।
সঙ্গীত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ
অদিতির সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় তার পরিবার থেকেই, যেখানে তাকে মূলত কীর্তন গাওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়। এরপর তিনি আরও সঙ্গীত শিখতে বিভিন্ন খ্যাতনামা সঙ্গীত শিক্ষক থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি শ্রী শুভ্রকান্তি চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রী স্নেহাশীষ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সঙ্গীত শিখেছিলেন। কীর্তন ও পুরাতন বাংলা সঙ্গীতের জন্য তিনি শ্রীমতি কঙ্কনা মিত্র, শ্রীমতি সরস্বতী দাস এবং তিমির বরণ ঘোষের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়াও, সঙ্গীতের তাল ও ছন্দের ওপর তার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি ধ্রুব বিশ্বাসের কাছে তবলা এবং গৌতম ভট্টাচার্যের কাছ থেকে খোল শেখেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীর্তন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে তার সঙ্গীত শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
কর্মজীবন এবং অর্জন
অদিতি মুন্সীর সঙ্গীত জীবনের শুরু ২০১০ সালে অল ইন্ডিয়া মেরিট কনটেস্টের মাধ্যমে, যেখানে তার আবেগপূর্ণ গাওয়া সবার নজর কাড়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর শ্রী এম কে নারায়ণের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেন। তার সঙ্গীত যাত্রার আরেকটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত ছিল ২০১৫ সালে জি বাংলা সা রে গা মা পা-তে অংশগ্রহণ, যেখানে তাকে “কীর্তনের রাণী” হিসেবে অভিহিত করা হয়।
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থেকে সঙ্গীত সম্মান পুরস্কার লাভ করেন, এবং ২০১৮ সালে শ্রী চৈতন্য ইনস্টিটিউট অফ বৈষ্ণব ধর্ম সংস্কৃতির পক্ষ থেকে তাকে কীর্তন সাম্রাজী উপাধি দেওয়া হয়। ২০২০ সালে মিরচি মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে এমার্জিং ফিমেল ভোকালিস্ট পুরস্কার লাভ করেন।

প্লেব্যাক সিঙ্গিং এবং আধুনিক অবদান
অদিতি মুন্সী তার সঙ্গীতের প্রতিভা শুধুমাত্র সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তিনি প্লেব্যাক সিঙ্গিংয়ে নিজের স্থান তৈরি করেছেন। তিনি তুষঙ্গনি, গোত্র, কথামৃত এবং বিশমিল্লাহ ছবিতে প্লেব্যাক গান গেয়েছেন। বিশমিল্লাহ সিনেমার অ্যালবামটি ২০২২ সালে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তার গানগুলি শ্রোতাদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, এবং তিনি প্রায়শই শ্রোতাদের আত্মবিশ্বাসীভাবে হারিবল গান গাওয়াতে উদ্বুদ্ধ করেন।
সংগীতম: অদিতির স্বপ্ন প্রকল্প
অদিতি মুন্সী তার স্বপ্ন প্রকল্প সংগীতম চালু করেন, যা একটি সঙ্গীত হাউস এবং সাংস্কৃতিক একাডেমি, যেখানে সকল বয়সের মানুষরা সঙ্গীতের মাধ্যমে একত্রিত হতে পারেন। সংগীতম সঙ্গীত হাউস সঙ্গীত অ্যালবাম তৈরি এবং প্রকাশের উপর কেন্দ্রিত, এবং সংগীতম সাংস্কৃতিক একাডেমি ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই একাডেমি তরুণ প্রতিভাদের প্রশিক্ষণ দেয়, যা তাদের বিভিন্ন সঙ্গীত শাখায় দক্ষতা অর্জন করতে সহায়ক।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
অদিতি মুন্সী ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে রাজারহাট গোপালপুর বিধানসভা আসন থেকে নির্বাচিত হন। তার রাজনীতিতে প্রবেশ জনগণের প্রতি তার দায়িত্ববোধ এবং সমাজে পরিবর্তন আনার ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। নির্বাচনে তার বিজয় প্রমাণ করেছে যে তিনি শুধুমাত্র একটি সঙ্গীতশিল্পী নন, বরং একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রী।
ব্যক্তিগত জীবন
অদিতি মুন্সী ২০১৮ সালে দেবরাজ চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন, যিনি বিধাননগর পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর। তাদের সম্পর্ক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই দৃঢ় এবং একে অপরকে সমর্থন করে।
ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টি
অদিতি মুন্সীর সঙ্গীতের প্রতি নিষ্ঠা এবং তার অনবদ্য প্রচেষ্টা তাকে একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার সঙ্গীত এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশে এক নতুন দিগন্ত খুলেছে। সংগীতম এর মাধ্যমে তিনি তরুণ প্রতিভাদের জন্য একটি শক্তিশালী সঙ্গীত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন, যা ভবিষ্যতে আরও অনেক সঙ্গীত শিল্পীকে সফল হতে সাহায্য করবে।
অদিতি মুন্সী শুধুমাত্র একটি সঙ্গীতশিল্পী বা রাজনীতিবিদ নয়, তিনি একটি সাংস্কৃতিক দূত, যিনি সঙ্গীত, সংস্কৃতি এবং জনসেবাকে একত্রিত করে বিশ্বকে নতুনভাবে দেখতে সক্ষম করেছেন।