অজিত রায় (জন্ম: ২৯ জুন, ১৯৩৮ – মৃত্যু: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১) ছিলেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক। তার সঙ্গীত, গীতিকা ও সুরগুলি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তার সঙ্গীত আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে, এবং তিনি আজও বাংলাদেশের সঙ্গীতের এক অমর নাম।
শৈশব ও শিক্ষা
অজিত রায় বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার সোনালুর কুঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুকুন্দ সর্গর এবং মা কণিকা রায় ছিলেন সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ। তার মা ছিলেন তার প্রথম সঙ্গীত গুরু, যিনি তাকে গানের প্রতি আগ্রহী করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন এবং টেবলায় সুর তোলা শিখেছিলেন।
১৯৫৭ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়াকালীন সময়ে তিনি প্রথিতযশা সঙ্গীতজ্ঞদের থেকে শিক্ষা নেন। তবে তার সঙ্গীত শেখার প্রকৃত অনুপ্রেরণা ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, যা তাকে সঙ্গীতের মাধ্যমে মুক্তির গান গাওয়ার প্রেরণা দেয়।
সঙ্গীত জীবন শুরু
অজিত রায় ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ রেডিওতে গান গাইতে শুরু করেন। তার কণ্ঠের যাদু এবং বিশেষ ধরনের গান গাওয়ার কৌশল তাকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীতে টেলিভিশনেও তিনি তার গান পরিবেশন করেন। বিশেষভাবে ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে তিনি একটি নতুন গান পরিবেশন করতেন। তার একটি বিখ্যাত গান ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতায় সুর করা গান।
চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ
অজিত রায় সঙ্গীতের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও তার অবদান রেখেছেন। তিনি বহু জনপ্রিয় সিনেমায় নেপথ্য গায়ক হিসেবে গান গেয়েছেন। কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে রিপোর্টার, জীবন থেকে নেওয়া, যে আগুনে পুড়ি, জন্মভূমি, কোথায় যেন দেখেছি, এবং কসাই। এছাড়াও, তিনি সুরুজ মিয়া ছবিতে বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যা তার অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দেয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অবদান
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, অজিত রায় ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা গানটি গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সাহস ও উদ্দীপনা জাগান। তিনি বাংলা সঙ্গীতের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামীদের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অজিত রায়ের গানগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার উৎসাহ জুগিয়েছিল। তার সুরে গাওয়া গানগুলো যেমন একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা, অপমানে তুমি সেদিন, কথা দাও কথাগুলো প্রভৃতি গানগুলি মুক্তিযুদ্ধের সংগীত হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
পারিবারিক জীবন
অজিত রায় ১৯৩৮ সালের ২৯ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী ছিলেন বুলা রায়, এবং তাদের দুটি সন্তান ছিল, কন্যা শ্রেয়শী রায় মুমু এবং পুত্র রোমাঞ্চ রায়। পারিবারিক জীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল এবং আদর্শ পিতা ও স্বামী। তার মা কণিকা রায় তাকে সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা ও আগ্রহ সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছিলেন।
সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতারে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন অজিত রায়। তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে এই পদে কাজ করেছেন এবং ১৯৯৫ সালে অবসর নেন। তিনি তার কর্মজীবনে অনেক সঙ্গীত পরিচালনা করেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গীত সংস্কৃতিতে তার অসামান্য অবদান রাখেন।
এছাড়াও, তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং ১৯৮৭ সালে কলকাতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
অজিত রায় তার সঙ্গীত কর্মজীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ২০০০ সালে তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়। তার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে:
- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শিল্পী পরিষদ থেকে শব্দসৈনিক পদক
- সিকোয়েন্স পদক (১৯৮৮)
- বেগম রোকেয়া পদক
- রবি রশ্মি পদক
- রবীন্দ্র পুরস্কার (২০১১)
- বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার শ্রদ্ধাঞ্জলি পত্র
মহাপ্রয়াণ
অজিত রায় বেশ কিছুদিন ধরে ফুসফুস সংক্রমণজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ২০১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ১:০৫ মিনিটে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগত শোকস্তব্ধ হয়। ৫ সেপ্টেম্বর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় এবং পরবর্তীতে পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে তাকে দাহ করা হয়।
অজিত রায়ের অবদান
অজিত রায় ছিলেন শুধুমাত্র একজন সঙ্গীতশিল্পী নয়, তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতিনিধি। তার গানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সঙ্গীতের ভাষায় চিত্রিত করেছেন। তার মৃত্যু, যদিও আমাদের জন্য এক গভীর শোকের মুহূর্ত, কিন্তু তার সঙ্গীত, সুর এবং গানের মাধ্যমে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। অজিত রায়ের অবদান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে যাবে।