বাংলা লোকসংগীতের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন অংশুমান রায়। তার কণ্ঠস্বরের শক্তি ও আবেগ শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি লোকসংগীতের জগতে ছিলেন এক অগ্রগণ্য নাম। তার গানে ধরা পড়েছে বাংলার মাটির গন্ধ, গ্রামবাংলার মানুষের আনন্দ-বেদনার কাহিনি এবং ঐতিহ্যের গভীর ছোঁয়া। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সম্মান ও দেশের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করে, যা তার অবদানকে স্বীকৃতি দেয়।
জন্ম ও শৈশব
অংশুমান রায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯ আগস্ট ১৯৩৬ সালে, অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার বাছুরডোবা গ্রামে। তার পিতা ছিলেন রামপদ রায় এবং মাতা বিভাবতী রায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি সংগীতের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন।
সংগীত শিক্ষা ও শুরুর জীবন
সংগীতের প্রথম পাঠ তিনি নেন তার বড়দা শঙ্কর রায়ের কাছে, যিনি তাকে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে পরিচিত করান। পরে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত ও ঠুমরীর তালিম নেন তার এক সম্পর্কিত কাকার কাছ থেকে। শুধু গান নয়, তিনি তবলা, বেহালা, বাঁশি এবং মাদল বাজানোর শিক্ষাও নিয়েছিলেন।
শিক্ষা জীবন ও গবেষণা
ঝাড়গ্রামের কুমুদ কুমারী ইনস্টিটিউশন থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তিনি ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার জন্য তিনি পুরুলিয়ার অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি, পঞ্চকুটের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন এবং সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের লোকসংগীতের ধারা অনুধাবন করেন। তাই তার গানে রাঢ় বাংলার লোকসংগীতের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়।
সংগীতজীবন ও জনপ্রিয়তা
অংশুমান রায়ের কণ্ঠে গীত লোকগান ও আধুনিক গানের এক অনন্য সংমিশ্রণ দেখা যায়। তার কণ্ঠে জনপ্রিয় কিছু গান হলো:
- “ভাদর আশিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে”
- “সাঁঝে ফোটে ঝিঙা ফুল সকালে মলিন গো”
- “দাদা পায়ে পড়ি রে মেলা থেকে বৌ এনে দে”
- “আমার বঁধু মান করেছে”
- “আর না থাকিয়ো বাপের ঘরেতে”
- “বলি ও খোকার মা”
- “আমার বেটার বিয়া দিব সময় হয়েছে”
- “হায় হায় সাত পাকে বাঁধা পড়ো না”
চলচ্চিত্রে সংগীতচর্চা
অংশুমান রায় কেবলমাত্র মঞ্চ বা অ্যালবামের গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যও গান গেয়েছেন। তার কণ্ঠে নেপথ্য সংগীত জনপ্রিয় কিছু চলচ্চিত্র হলো:
- বাবা তারকনাথ (১৯৭৭)
- চারমূর্তি (১৯৭৮)
- করুণাময়ী (১৯৭৮)
- দক্ষযক্ষ (১৯৮০)
- বাতাসী (১৯৮০)
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা “শোন একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি” গানটি নিজের সুরে গেয়ে গেয়েছিলেন। এই গান বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল এবং আজও বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য হয়।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
অংশুমান রায়ের সংগীত প্রতিভা তাকে বহু সম্মান ও পুরস্কার এনে দিয়েছে। তার প্রাপ্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্মাননা হলো:
- ১৯৭৮ সালে চারমূর্তি ছায়াছবির “ঘোচাং ফু, খাবো তোকে” গানের জন্য সেরা পুরুষ গায়কের পুরস্কার
- ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সম্মান ও বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক প্রদান করে
ব্যক্তিগত জীবন
অংশুমান রায় কমলা ব্যানার্জীকে বিবাহ করেন। তাদের দুই পুত্র— সঙ্গীতশিল্পী ভাস্কর রায় ও গিটার বাদক অন্তর রায় এবং এক কন্যা মিতা গুহ রায়। তাদের পরিবারেও সংগীতের চর্চা ছিল গভীরভাবে প্রোথিত।
জীবনের শেষ অধ্যায়
১৯৯০ সালের ২২ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী কমলা ব্যানার্জী তার মৃত্যুর মাত্র দেড় মাস আগেই প্রয়াত হন। এই ক্ষতি তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল।
অংশুমান রায় ছিলেন বাংলা লোকসংগীতের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা। তার গানে বাংলার মাটি, মানুষ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। আজও তার গান বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তার সুরেলা কণ্ঠ ও অসাধারণ সুর সৃষ্টির ক্ষমতা বাংলা সংগীতজগতে এক অমূল্য সম্পদ।