সোনাঝুরির মাঝে
অভিধান এক হাতে মাথার ওপর নীল-রঙের সুন্দর একটি ছাতা ধরে অন্য হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে পঞ্চম বাড়িতে ঢুকল। বসন্ত ঋতু। চৈত্র মাস। চড়া রোদ। অভিধান তার স্টাইলিশ বড় ডায়ালের হাত-ঘড়িতে সময় দেখল, সকাল সাড়ে-এগারোটা বাজে। অভিধানের বয়স চব্বিশ বছর। তরতাজা যুবক ছেলে। ফর্সা। মাঝারি উচ্চতা। স্টাইলিশ ছেলে। দেখতে খুবই সুন্দর। অভিধানের পরনে দামি সাদা টি-শার্ট, আকাশি রঙের দামি জিন্সের প্যান্ট। ক্লাসিক-সাইড-পার্ট স্টাইলে মাথার চুল কাটা। পায়ে পালিশ করা চকচকে ডাবল-মংক-স্ট্র্যাপ খয়েরি-সু। মাথার চুল বাদামি রং করা। দাড়ি-গোঁফ যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করে কাটা। বুক পকেটে ছোট লাল-পাথর বসানো রুপালি রঙের দামি একটি কলম, চোখে সরু সোনালি-ফ্রেমের গোল আকারের কালো রঙের অ্যাভিয়েটর রোদ-চশমা।
অভিধান তার চোখের অ্যাভিয়েটর রোদ-চশমাকে খুলে বুক-পকেটে রাখল। আশপাশে চারদিক তাকাল। অভিধান দেখতে পেল, গাছে-গাছে অনেক সবুজ রঙের কচি-কচি পাতা। গাছগুলো দেখে অভিধানের মনে হলো, প্রতিটি গাছ যেন এক-একজন নারী আর কচি-কচি পাতা যেন তাদের সন্তান। কচি-পাতা ধরা গাছগুলো দেখে অভিধানের মনে এল,সন্তান হাতে নিয়ে নারী দাঁড়িয়ে।
বাড়িটিতে কোনও প্রাচীর নেই। খোলা বাড়ি। উঠোনে দাঁড়িয়ে অভিধান ডেকে উঠল, “বাড়িতে কেউ আছেন?” ঘরের ভেতর থেকে প্রবীর বের হয়ে এল। প্রবীর অভিধানকে বলল, “আসুন, ঘরের ভেতরে আসুন। জুতো পরে আসুন। কোনও অসুবিধে নেই।” অভিধান ফোল্ডিং-ছাতাটি গুটিয়ে নিল। হাতের ব্যাগটা বেশ শক্ত করে হাতে ধরে জুতো পরে অভিধান ঘরের মধ্যে ঢুকল। প্রবীর অভিধানকে টেবিলের পাশে একটি প্লাস্টিকের চেয়ার দেখিয়ে বলল, “বসুন। চেয়ারে বসুন।” অভিধান টেবিলের ওপর ব্যাগটি রেখে চেয়ারে বসল। প্রবীর দরজার কাছে গেল। দু’পাল্লাযুক্ত কাঠের দরজায় মজবুত করে খিল লাগিয়ে দিল। ঘরের দুটো জানলা শক্ত করে বন্ধ করল। প্রবীর চৌকির ওপর উঠে বসল। প্রবীর বলল, “আপনার মোবাইল ফোনটা দিন তো।” প্রবীর অভিধানের পূর্ব পরিচিত। এর আগে বেশ কয়েকবার প্রবীরের সাথে অভিধানের দেখা হয়েছে। দু’জনের সম্পর্ক খুবই ভালো। অভিধান কোনও কথা না বলে তার দামি স্মার্ট মোবাইল ফোনটা প্রবীরের হাতে তুলে দিল। নিজের প্যান্টের পকেটের মধ্যে স্মার্টফোনটি ঢুকিয়ে নিয়ে প্রবীর অভিধানকে বলল, “অবন্তী-সৌবীরের প্রেমকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে ঘরবন্দি করা হলো। আপনাকে গৃহবন্দি করা হলো।”
দুই
অন্ধকার ঘরে ডিমলাইট জ্বালাতে-জ্বালাতে প্রবীর অভিধানকে বলল, “আমি জানি, রাজনীতির কারণে কিংবা ভোটের সময় সুষ্ঠভাবে ভোট পরিচালনা করার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দি বা নজর বন্দি করা হয়। আপনাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে ‘প্রেম’-কে সহায়তা করার কারণে। এটার মধ্যে কোনও রাজনৈতিক কারণ নেই বা অন্য কোনও কারণও নেই।”
প্রবীর আবার বলল, “পাঁচ দিন আগে আমার বাবা দিল্লি থেকে বাড়িতে এসেছিল। বাবার সাথে দেখা করার জন্য আমিও একই সময়ে বাড়ি এসেছিলাম। আমার বাবা অবন্তী আর সৌবীরকে নিয়ে রায়গঞ্জের এক নার্সিং-হোমে গেছে অবন্তীর পেটের বাচ্চাকে নষ্ট করার জন্য। বাবা ফিরে এসে গ্রামের সকল লোককে নিয়ে প্রেমে সহায়তা করার জন্য আপনার বিচার বসাবে। বিচারে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে কিনা আমি তা জানি না। বিচারে সর্বসম্মতভাবে কী সিদ্ধান্ত হবে, সেটাও আমি জানি না।”
ঘরটির দেওয়াল পাঁচ ইঞ্চি ইটের তৈরি। মেঝে মাটির। ঘরে একটি চৌকি, একটি কাঠের টেবিল। টেবিলের দু’পাশে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার। ঘরের চাল খাঁড়া টিনের। টিনের নিচে চাটাইয়ের বেড়ার ছাদ। ঘরের কোণে রয়েছে উঁকি মারছে ছোট-ছোট কিছু ইঁদুরের গর্ত। দুটো কাঠের জানলা। একটি জানলা পূর্ব দিকে অপরটি উত্তর দিকে। জানালায় লোহার শিক লাগানো। ভেতর থেকে জানলা বন্ধ করার ও খোলার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘরের মাঝ বরাবর পূর্ব দিকে একটি কাঠের দরজা। প্লাস্টারবিহীন দেওয়ালে লাগানো রয়েছে হিন্দি সিনেমার কিছু ছবি। টেবিলের ওপর রয়েছে এ-ফোর সাইজের কিছু সাদা কাগজ ও একটি নীল-কালির-কলম।
প্রবীর টেবিলের অপর পাশের চেয়ারে বসল। প্রবীরের বয়স বছর ছাব্বিশ হবে। সুঠাম চেহারা। মাঝে টেবিল। একপাশে অভিধান, অন্য পাশে প্রবীর। টেবিলের একধারে একটি ডিমলাইট জ্বালানো। প্রবীর অভিধানকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কবে এবং কীভাবে জেনেছিলেন অবন্তী আর সৌবীরের প্রেমের কথা?”
অভিধান জানাল, “প্রায় দেড়-বছর আগের কথা। আমি সাধারণত বাইকে চড়ে সোনাঝুরি গ্রামে যেতাম। একদিন হঠাৎ আমার মনে এসেছিল, বাইকে নয়, আমি মাটির রাস্তায় খালি পায়ে হেঁটে-হেঁটে আমার দত্তক-পরিবারে যাব। মাটিতে রয়েছে প্রাণ, মাটিতে আছে সজীবতা। পায়ে মাটির গন্ধ নিতে-নিতে আমি আমার দত্তক-পরিবারে যাব।
সোনাঝুরি গ্রামে যেতে প্রায় দু’কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। আমি মালদা থেকে ভটভটি ধরে সোনাঝুরি গ্রামে যাওয়ার মাটির রাস্তার কাছে নেমেছিলাম। রোদ ছিল। একটু একটু হালকা হাওয়া বইছিল। আমি ছাতা ফুটিয়ে ছাতা মাথায় জুতো ছাড়া মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। রাস্তার দু’পাশে সবুজ শস্যক্ষেত আর সবুজ গাছপালা দেখতে-দেখতে এগোচ্ছিলাম। পায়ে হেঁটে দত্তক-পরিবারে যেতে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। খুশিতে ভরে উঠছিল আমার মন। আমি মনের ভেতর একটা সতেজতা অনুভব করছিলাম, হৃদয় জুড়িয়ে যাচ্ছিল আমার।
ছাতা মাথায় হেঁটে-হেঁটে অর্ধেক পথ যাওয়ার পর হঠাৎ আমার মনে এসেছিল, ছাতা আমাদের রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে ঠিকই, তবে ছাতা কিন্তু বহু নারী-পুরুষের প্রেমের সাক্ষী, প্রচুর ভালোবাসার প্রত্যক্ষদর্শী। ছাতার তলায় নারী-পুরুষের প্রচুর প্রেম শুরু হয়, ছাতার নিচে বহু প্রেম প্রতিপালিত হয়, ছাতার নিচে অনেক… অনেক প্রেম সজীবতা লাভ করে, ছাতার তলায় নারী-পুরুষের অসংখ্য প্রেম পরিপূর্ণতা পায়। ছাতার নিচে বাস করে প্রেম, ছাতার তলায় ঘর করে থাকে ভালোবাসা।
আমি ছাতা মাথায় হাঁটিছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করেছিলাম, কিছুটা দূরে একটি উঁচু মাটির ঢিবির ওপর একজন যুবক, ও একজন যুবতী লাল-হলুদ-বেগুনি-সবুজ চার রঙের একটি ছাতা মাথায় দিয়ে পাশাপাশি বসেছিল। যুবক-যুবতী দু’জনকে আমার খুব চেনা-চেনা লাগছিল। কাছাকাছি গিয়ে আমার ছাতার আড়াল দিয়ে আমি দেখেছিলাম, যুবক-যুবতী দু’জন অবন্তী আর সৌবীর। ছাতা দিয়ে আমার মুখ ঢেকে থাকার কারণে ওরা আমাকে চিনতে পারেনি। আমি একইরকম ভাবে পথ হাঁটছিলাম আর অবন্তী-সৌবীর ছাতা মাথায় বসে ছিল।
আমি খালি পায়ে হেঁটে-হেঁটে যখন সোনাঝুরি গ্রামে পা দিয়েছিলাম, তখন ভীষণ সুখে ভরে গিয়েছিল আমার দেহ-মন-প্রাণ। মাটিতে হাঁটার আনন্দ আমার সারা শরীরে বইছিল। অবন্তীদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম, অবন্তী বাড়িতে নেই। পরের তিনটে বাড়িতে স্বাস্থ পরীক্ষার জন্য ঢুকেছিলাম। সেদিন স্বাস্থ পরীক্ষা করতে খুবই ভালো লাগছিল আমার। তিনটে বাড়িতে স্বাস্থ পরীক্ষা শেষ করে সৌবীরের বাড়িতে ঢুকেছিলাম। দেখেছিলাম, সৌবীর বাড়িতে নেই। আমি আবার অবন্তীদের বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। অবন্তী বাড়িতে ছিল। অবন্তীর স্বাস্থ পরীক্ষার সময় অবন্তী বলেছিল, “আমি মিহির মাহাতোর ছোট ছেলে সৌবীরের সাথে প্রেম করি। সৌবীরের সুঠাম দেহ আমাকে ভালোলাগে, সৌবীরের কথাবার্তা, হাঁটাচলা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি সৌবীরকে খুবই ভালোবাসি। সৌবীর যাতে অসুখ-বিসুখে না পড়ে, সে দিকে ভালোভাবে নজর দেবেন।” আমি আবার সৌবীরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সৌবীর বাড়িতে ছিল। সৌবীরকে পরীক্ষা করার সময় সৌবীর বলেছিল, “আমি শশধর কর্মকারের একমাত্র মেয়ে অবন্তীকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসি।”
অবন্তীর ঘন-কালো-লম্বা-চুল আমাকে ঘুমোতে দেয় না, অবন্তীর দু’চোখ, তার চাহনি আমাকে চঞ্চল করে রাখে, অবন্তীর ঠোঁট আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। আপনি অবন্তীর স্বাস্থ পরীক্ষা একটু আন্তরিক ভাবে এবং যত্ন সহকারে করবেন।” অভিধান প্রবীরকে বলল, “আমি সেই দিনই প্রথম জানতে পেরেছিলাম অবন্তী-সৌবীরের প্রেমের কথা।” কথা শেষ করে অভিধান চেয়ারে ভালোমতো বসল।
ঘরের আবছা আঁধারে প্রবীর অভিধানের অস্পষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে অভিধানকে বলল, “আপনাকে গৃহবন্দি করার পরিকল্পনাটা কিন্তু অবন্তী-সৌবীর জানে না। আপনাকে যে ঘরবন্দি করা হয়েছে, সেটাও তাদের জানতে দেওয়া হয়নি। আর তাদের জানতেও দেওয়া হবে না।”
তিন
ঘরের কোণে বেশ কিছু মাকড়সার জাল ঝুলছিল। স্কেটিং-জুতো পরে মেঝে দিয়ে মাঝে-মধ্যে কিছু আরশোলা স্কেটিং করতে-করতে এদিক-ওদিক চলাফেরা করছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেরা যেমন জামার বোতাম খুলে গুরুজনদের অমান্য করে বুক উঁচিয়ে পাড়ায় চলাফেরা করে, তেমনই ঘরের মধ্যে বুক উঁচু করে ছোট-ছোট ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ডিম লাইটের আবছা-আলো আলোর অপ্রতুলতার অসুবিধে বোঝাচ্ছিল। দরজা-জানলা বন্ধ করা ঘরের ভেতর হাওয়া ঠিকমতো দম নিতে পারছিল না। বদ্ধ ঘরে বাতাসের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পোকামাকড় আটকে পড়া ঝুলন্ত মাকড়সার জালগুলো ‘জাল-বন্দি’ রূপ দেখাচ্ছিল।
প্রবীর জিজ্ঞেস করল, “কতদিন হলো অবন্তীর পেটের বাচ্চার?
অভিধান জানাল, “আট মাস পঁচিশ দিন। আর পনের পরে ছিল অবন্তীর প্রসবের দিন।”
প্রবীর বলল, “আপনি কী করে বুঝেছিলেন, অবন্তীর পেটের বাচ্চা সৌবীরের বাচ্চা?”
অভিধান বলল, “পেটে বাচ্চা এসেছে, এটা সঠিক ভাবে জানার পর অবন্তী আমাকে নিজে থেকে জানিয়েছিল, তার পেটে সৌবীরের সন্তান। আমি সৌবীরকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। সৌবীর নিজে আমার কাছে বলেছিল, অবন্তীর পেটের বাচ্চা তার নিজের সন্তান।”
প্রবীর অভিধানকে বলল, “আপনি অবন্তী ও সৌবীরকে সব সময় সুস্থ রাখতেন। অবন্তী-সৌবীরের প্রেমে যাতে কোনওরূপ ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য সামান্যতম অসুখ দেখা দিলেই ওষুধ দিয়ে ওদের দু’জনকে আপনি দ্রুত সারিয়ে তুলতেন। ফলে তারা দু’জনে প্রেম করার অনেক সুযোগ পেয়েছিল। আবার আপনি অবন্তী ও অবন্তীর পেটের সন্তানের সঠিকরূপে চিকিৎসা করেছিলেন। অবন্তী ও সৌবীরের প্রেমকে বাড়তে সাহায্য করা এবং অবন্তী ও তার পেটের সন্তানের সুচিকিৎসা করা আপনার ভয়ানক দোষ, আপনার মহা অপরাধ।”
প্রবীর বলল, “আপনি কি অবন্তী ও সৌবীরের মধ্যে তাদের প্রেমের কথা আদান-প্রদান করতেন?”
অভিধান উত্তর দিল, “না। কখনই না। ওরা দু’জনে প্রেম করত এটা জানতাম ঠিকই, কিন্তু আমি কখনও ওদের কাছে ওদের প্রেমের ব্যাপারে কোনও কিছু জিজ্ঞেস করিনি, ওদের প্রেম সম্পর্কে কোনও আলোচনা ওদের সঙ্গে করিনি। শুধু প্রেম নয়, অন্য কোনও বিষয়েও ওদের একজনের কথা কখনই অপরজনকে বলিনি।”
প্রবীর অভিধানকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কখন জানতে পেরেছিলেন, অবন্তী গর্ভবতী?”
অভিধান বলল, “আমি জানতাম, মালদার জেলার বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান ‘গৌড়’ একসময় ভয়ানক প্লেগ-রোগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এমন দুঃখজনক ঘটনায় গৌড় দেখার প্রবল ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিল। আমি গৌড় দেখতে গিয়েছিলাম। একটা রোগের কারণে গৌড় ধ্বংস হওয়ায় গৌড়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার খুবই কষ্ট হয়েছিল, ভীষণ যন্ত্রণা হয়েছিল। অনেকক্ষণ গৌড়ের মাটিতে বসে ছিলাম। গৌড় থেকে ফিরে বাইক নিয়ে অতীতের গৌড়বাসীদের জীবনযাপন কল্পনা করতে-করতে সোনাঝুরি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। সোনাঝুরি গ্রামে ঢুকতেই দেখতে পেয়েছিলাম, রাস্তার ধারে উঁচু-উঁচু শাখা থেকে ঝাড়বাতির মতো ঝুলে পড়া হলদে-সোনালি রঙের অমলতাস ফুলে পরিপূর্ণ অমলতাস ফুল-গাছের নিচে অবন্তী ও সৌবীর পাশাপাশি বসে। হলদে-সোনালি রঙের অমলতাস ফুলের সৌন্দর্যে চারপাশ অপরূপ সৌন্দর্যে ভরে উঠেছিল। অবন্তী সৌবীরের কাঁধে মাথা দিয়েছিল। অবন্তীর চুল খোলা। অবন্তীর ঘন কালো চুল ছড়িয়ে ছিল সৌবীরের বুকের ওপর। কিছু চুল হাওয়াতে সৌবীরের মুখমন্ডলের ওপর বারবার এসে পড়ছিল। সৌবীরের বুকের ওপর পড়া অবন্তীর খোলা ঘন-কালো-চুল যেন অনেক ঘন-কালো-অন্ধকার-রাত আর সৌবীরের মুখমন্ডলের ওপর পড়া ঘন-কালো-চুল দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কিছু ঘন-কালো-রাত সৌবীরকে বারবার উত্তক্ত করছিল।
এর কিছুদিন পরে অবন্তীদের বাড়ি গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, অবন্তী বমি করছিল। আমার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। আমি অবন্তীদের বাড়িতে প্রেগনেন্সি কার্ড দিয়ে প্রেগনেন্সি-টেস্ট করাই। দেখা যায়, অবন্তী গর্ভবতী। এরপর আমি অবন্তীকে মালদা এক মহিলা গাইনোকোলোজিস্টের কাছে নিয়ে যাই। মহিলা ডাক্তার অবন্তীকে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, প্যাথোলোজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত করেছিল, অবন্তী গর্ভবতী। তখনই আমি জানতে পেরেছিলাম, অবন্তী গর্ভবতী।”
প্রবীর বলল, “আমি জেনেছি,আপনি অবন্তী ও সৌবীরের সাথে অনেকটা সময় কাটাতেন। ওদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর কারণটা কী?”
অভিধান বলল, “‘প্রেম’ পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। প্রেম আছে বলেই পৃথিবী বেঁচে রয়েছে। প্রেমের জন্য মানুষ হাজার হাজার বছর বাঁচতে চায়। প্রেম ছাড়া জীবন অর্থহীন। প্রেমের স্পর্শে মৃতপ্রায় ব্যক্তিও বেঁচে ওঠে। প্রেম মানুষকে ‘সুন্দর’ করে তোলে। আমি প্রেমিক-সৌবীর ও প্রেমিকা-অবন্তীর কাছে যখন থাকতাম, তখন আমার মনে আমি খুবই সুখ অনুভব করতাম, ভীষণ আনন্দ পেতাম, খুশিতে ভরে উঠত আমার মন। প্রেমের সুখ, ভালোবাসার আনন্দ উপভোগ করার কারণেই আমি অবন্তী ও সৌবীরের সঙ্গে একটু সময় বেশি কাটাতাম।”
চার
দু’বছর আগে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ যোজনায় নতুন নিয়ম হয়েছিল, মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীকে পাঁচ বছরের জন্য মেডিক্যাল কলেজের নিকটবর্তী অনুন্নত, পিছিয়ে পড়া কোনও গ্রামের পাঁচটি করে পরিবারকে দত্তক-পরিবার হিসেবে দেওয়া হবে। প্রতি ছাত্র-ছাত্রী তাদের প্রাপ্ত পাঁচটি দত্তক-পরিবারের বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ সংক্রান্ত বিষয়টা দেখবে, তাদের স্বাস্থের ব্যপারে পরামর্শ দেবে,তাদের চিকিৎসা করবে, প্রয়োজনে তাদের ভালো স্বাস্থ-কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে। মেডিক্যাল পড়া প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রামের স্বাস্থ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ যোজনা থেকে এমন নিয়ম করা হয়েছিল।
অভিধানের বাড়ি হুগলী জেলার আরামবাগ শহরে। ধনী ঘরের একমাত্র ছেলে। স্টাইলিশ ছেলে। তার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়া। দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে সে ডাক্তারি পরীক্ষায় বসার জন্য কোচিং নিতে শুরু করেছিল। বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী। মা গৃহকর্ত্রী।কোচিং শেষ করে ডাক্তারি পরীক্ষায় বসেছিল। ভালোভাবে ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করেছিল। দু’বছর আগে মালদা মেডিক্যাল কলেজে অভিধানের ডাক্তারি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। অভিধান এখন মালদা মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
মালদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পুরাতন মালদার ভাবুক গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন ঝাড়পুকুরিয়া ও সোনাঝুরি গ্রামকে দত্তক-গ্রাম হিসেবে নিয়েছিল। দু’বছর আগে মালদা মেডিকেল কলেজ মেডিক্যাল পড়ুয়া প্রথম বর্ষের ছাত্র অভিধানকে সোনাঝুরি গ্রামের পাঁচটা পরিবারকে তার দত্তক-পরিবার হিসেবে দিয়েছিল। প্রতি রবিবার অভিধান তার নিজের বাইক নিয়ে সোনাঝুরি গ্রামে আসত এবং তার ধার্যকৃত পাঁচটি দত্তক-পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করত। দরকারে দত্তক পরিবারের সদস্যদের ভালো চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেত। দু’বছর ধরে নিয়মিত ভাবে কর্তব্যে গাফিলতি না দিয়ে, কোনও রকম গড়িমসি না করে অভিধান তার পাঁচটি দত্তক-পরিবারের শরীর-স্বাস্থ দেখভাল করছিল। আজ রবিবার অভিধান সোনাঝুরি গ্রামে তার পাঁচটি দত্তক-পরিবারের চিকিৎসা করতে এসেছিল।
সোনাঝুরি গ্রাম একটি সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম। গ্রামের বেশিরভাগ লোক সাঁওতাল উপজাতির। তবে কিছু অন্য জাতির লোকও আছে। এখানকার লোকদের শরীর, স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। বেশির ভাগ লোক অপুষ্টিতে ভোগে। প্রথম পরিবারটি ছিল অবন্তী কর্মকারের আর একদম শেষের পরিবার ছিল মিহির মাহাতোর। অবন্তী গম্ভীরা গান করে। গম্ভীরা মালদা জেলার ঐতিহ্যবাহী লোকগান। মালদার আইহো-এর যাদবনগর গ্রামে একটি মেয়েদের গম্ভীরার দল রয়েছে। সেই মহিলা দলের সাথে বাইরে-বাইরে গম্ভীরা করে বেড়ায় অবন্তী। মাঝে-মধ্যেই অবন্তী বাইরে গম্ভীরা গান করতে যায়। মিহির সারা বছর বাড়িতে থাকে না। দিল্লিতে কাজ করে। মিহির মাহাতোর দু’ছেলে প্রবীর ও সৌবীর। প্রবীর বড় ছেলে ও সৌবীর ছোট ছেলে। প্রবীর কোচবিহারে এক পাউরুটি কারখানায় কর্মচারী হিসেবে কাজ করে। সারা বছর বাড়িতে থাকে না। সৌবীর বাড়িতে একা থাকে। মা মৃত। দূরশিক্ষার মাধ্যমে বিএ পড়ে। পাশের বাড়ির এক বয়স্কা মাসি মা-হারা সৌবীরের জন্য বাড়িতে এসে রান্না করে দিয়ে যায়। সৌবীরের বয়স তেইশ বছর। অবন্তীর বয়স বাইশ বছর। মাধ্যমিক পাশ করে অবন্তী আর পড়াশোনা করেনি। অবন্তীর বাবা-মা কেউ নেই। অবন্তীর সাথে তার থেকে তিন বছরের ছোট তার এক পিসতুতো ভাই থাকে। অভিধান নিয়মিত অবন্তী কর্মকার ও মিহির মাহাতোর বাড়িতে নিয়মিত এসে তাদের পরিবারের সকলের ভালোভাবে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত, চিকিৎসা করত। অনেক সময় তাদের নিকটবর্তী স্বাস্থকেন্দ্রে নিয়ে যেত। যখন মিহির ও প্রবীর বাড়িতে আসত, তখন অভিধান তাদের শরীর-স্বাস্থ পরীক্ষা করত ও ওষুধপত্র দিত।
যেদিন অভিধানকে সোনাঝুরি গ্রামের পাঁচটি পরিবারকে মালদা মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে দত্তক-পরিবার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, সেদিন অভিধান সারাদিন সোনাঝুরি গ্রামে ছিল। সমস্ত সোনাঝুরি গ্রাম ঘুরে বেরিয়েছিল। সোনাঝুরি গ্রামের গাছপালা, মানুষ-জন, পশু-পাখি, বিভিন্ন জলাশয়, রাস্তাঘাট, ফল-ফুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল। তার দত্তক-পরিবারের গ্রামকে দেখে মন-প্রাণ ভরে গিয়েছিল অভিধানের। দত্তক-পরিবারের গ্রামের রূপে হৃদয় জুড়িয়ে গিয়েছিল তার। প্রত্যেক মেয়ের ও প্রতিটি বউ-এর শরীরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, তেমনই প্রতিটি গ্রামের একটা নিজস্ব ঘ্রাণ রয়েছে। অভিধান সেদিন সোনাঝুরি গ্রামে সারাদিন ঘুরে ঘুরে সোনাঝুরি গ্রামের গন্ধ গ্রহণ করেছিল, ঘ্রাণ আস্বাদন করেছিল।
সেদিন অভিধান সোনাঝুরি গ্রামে দাঁড়িয়ে স্থির করেছিল, সোনাঝুরি গ্রামের তার পাঁচটি দত্তক-পরিবারের শরীর-স্বাস্থ সে সব সময় ভালো রাখবে। তার পাঁচটি পরিবারের কোনও সদস্য যেন তার অবহেলায় স্বাস্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে না ভোগে, সেদিকে সে যত্নবান থাকবে। কর্তব্যে গাফিলতি করবে না কখনও। সে ঠিক করেছিল, সাঁওতাল অধ্যুষিত এই গ্রামের কোনও লোকের সাথে কোনও দিনও খারাপ ব্যবহার করবে না, কাউকে কখনও খারাপ কথা বলবে না।
অবন্তী ও সৌবীর প্রেম করত। অভিধান অবন্তী এবং সৌবীরের চিকিৎসা করত। অবন্তী আর সৌবীর দু’জন দু’জনকে খুবই ভালোবাসত। অবন্তীর পেটে সৌবীরের বাচ্চা এসেছিল। পাঁচদিন আগে মিহির মাহাতো সময় বাড়ি এসেছিল। একই সময় বাবার সাথে দেখা করবে বলে প্রবীর বাড়ি এসেছিল। মিহির মাহাতো ও প্রবীর জানতে পেরেছিল, অবন্তীর পেটে সৌবীরের সন্তান। মিহির মাহাতো বলে উঠেছিল, “অসম্ভব। অবন্তী গম্ভীরা গান করে। বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়ায়। বারো জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। আমি গম্ভীরা গান করা অবন্তীর সাথে আমার ছেলে সৌবীরের সম্পর্ক মানি না।” রায়গঞ্জের ভালো ডাক্তার দিয়ে অবন্তীর বাচ্চাকে দেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে মিহির মাহাতো আজ সকালে অবন্তী ও সৌবীরকে ট্যাক্সি করে রায়গঞ্জে গিয়ে পৌঁছেছিল। মিহির মাহাতো ঠিক করেছিল, অবন্তীকে রায়গঞ্জে নার্সিং-হোমের কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে অবন্তীর বাচ্চা নষ্ট করে দেবে। ডাক্তারকে টাকা খাইয়ে অবন্তীর বাচ্চা নষ্ট করে তবেই সে বাড়ি ফিরবে। অবন্তী-সৌবীরের প্রেম এবং অবন্তীর পেটের সন্তানের জন্য মিহির মাহাতো ও প্রবীর মাহাতো দু’জনে মিলে অভিধানকে দোষীরূপে চিহ্নিত করেছিল, অভিধানকেই অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল।
পাঁচ
প্রবীর ডিমলাইটের আলো বাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। টিমটিম করে ডিমলাইট জ্বলতে লাগল। প্রবীর চৌকিতে বসতে-বসতে বলল, “ডাক্তারবাবু, আপনি কীভাবে চিকিৎসা করেছিলেন যে, এতদিন অবন্তীর ও অবন্তীর বাচ্চার খারাপ কিছু হয়নি?”
অভিধান বলল, “আমি অবন্তী ও অবন্তীর পেটের বাচ্চাকে সুস্থ রাখার জন্য কিছু ডাক্তারি সুপরামর্শ দিয়েছিলাম। আমি অবন্তী ও তার পেটের সন্তানকে মন-প্রাণ-হৃদয় দিয়ে চিকিৎসা করতাম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম। নিয়মিত গ্রামে এসে অবন্তী ডাক্তারি পরামর্শগুলো ঠিকঠাক মেনে চলছিল কিনা তা নিজের চোখে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখতাম। প্রেমিক-সৌবীর যাতে কোনও অসুখে না পড়ে, সেদিকে তীক্ষ্ণভাবে নজর রাখতাম। সব সময় আমি সৌবীরকে সুস্থ রেখেছিলাম। কারণ, প্রেমিক-সৌবীর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রেমিকা-অবন্তী অসুস্থ হয়ে পড়বে। আবার প্রেমিকা-অবন্তী অসুস্থ হয়ে পড়লে অবন্তীর পেটের প্রেমের বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি মালদায় অবন্তীকে নিয়ে গিয়ে এক ভালো স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখিয়েছিলাম। স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ অবন্তীর প্রসবের তারিখ বলে দিয়েছিল।” অভিধান প্রবীরকে আবার বলল, “আমি মধুর ‘প্রেম’-এর চিকিৎসা করতাম, আমি সুমধুর ‘ভালোবাসা’-এর চিকিৎসা করতাম।
অনেকটা সময় পর প্রবীরের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। প্রবীর মোবাইল ফোনের স্ক্রিন দেখল,তার বাবা মিহির মাহাতোর ফোন। প্রবীর ফোন রিসিভ করে কানে ধরল। ওপ্রান্ত থেকে মিহির মাহাতো বলল,” প্রবীর, ঘরের একদম কোণে যা। আমার কথা তুই ছাড়া আর কেউ যেন শুনতে না পারে।” প্রবীর ঘরটির এক্কেবারে কোণে গেল। প্রবীর বলল, “বলো বাবা, তোমার কথা অন্য কেউ শুনতে পাবে না।” মিহির মাহাতো বলতে লাগল, “অবন্তীর বাচ্চাকে নষ্ট করা সম্ভব হয়নি। অবন্তী সন্তান প্রসব করেছে। মেয়ে হয়েছে। আমরা অবন্তীকে নিয়ে নার্সিং হোম গিয়েছিলাম। ডাক্তার দেখেশুনে জানিয়েছিল, “অসম্ভব। এ বাচ্চা নষ্ট করা সম্ভব নয়।”
আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন ডাক্তারবাবু?” ডাক্তারবাবু বলেছিল, “এই বাচ্চা অনেক ‘বড়’ হয়ে গেছে। বড় হওয়ার কারণে এই বাচ্চা নষ্ট করা সম্ভব নয়।” ডাক্তারবাবু আরও জানিয়েছিল, “যে-ডাক্তার অবন্তীর চিকিৎসা করেছিল, সেই ডাক্তার একদম সঠিক চিকিৎসা করায় অবন্তীর বাচ্চা ‘বড়’ হয়েছে এবং এখনও সুস্থ আছে।” আমরা অবন্তীকে নিয়ে অন্য নার্সিং-হোমে যাচ্ছিলাম। রাস্তার মধ্যে অবন্তীর পেটে প্রচন্ড ব্যথা উঠেছিল। আমরা নিকটবর্তী রায়গঞ্জ সরকারি হাসপাতালে অবন্তীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তারবাবু অবন্তীকে দ্রুত লেবার-রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারবাবু লেবার- রুম থেকে বেরিয়ে আমাদের জানিয়েছিল, অবন্তী সন্তান প্রসব করেছে। মেয়ে হয়েছে। অবন্তী ও অবন্তীর মেয়ে দু’জনেই সুস্থ আছে। মিহির মাহাতো আবার বলল, “শোন প্রবীর, কোনও মতেই অভিধান যেন অবন্তীর সন্তান হওয়ার কথা জানতে না পারে। কোনও ভাবেই না।” প্রবীর উত্তর দিল, “ঠিক আছে বাবা,তাই হবে। অবন্তীর সন্তান হওয়ার কথা কোনও মতেই অভিধান জানতে পারবে না।” মিহির মাহাতো ফোন কেটে দিল। প্রবীর চুপচাপ গিয়ে চৌকির ওপর গিয়ে বসে পড়ল। ভীষণ গরম লাগছিল তার। অস্থির লাগছিল শরীরের ভেতরটা। গরমে গায়ের জামা খুলে ফেলল প্রবীর।
ছয়
প্রচন্ড গরম সহ্য করতে না পেরে প্রবীর বারান্দার দিকের জানলাটা খুলে দিল। অভিধান চেয়ারে বসে থেকে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। খোলা জানলা দিয়ে অভিধান কিছুটা দূরে একটি রুদ্রপলাশ ফুল-গাছ দেখতে পেল। উজ্জ্বল লাল-রঙের রুদ্রপলাশ ফুলের সৌন্দর্যে মন ভরে গেল তার। রুদ্রপলাশের রূপে প্রাণ জুড়িয়ে গেল তার।
অভিধান টেবিলের ওপর থেকে এ-ফোর সাইজের একটি সাদা কাগজ নিল। টেবিলের ওপর রাখা নীল-কালির কলমটি হাতে নিল। জানলার মধ্য দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নীল কলমটি দিয়ে সাদা কাগজের ওপর ছবি আঁকতে লাগল।
অভিধান একমনে ছবি আঁকছিল। কোনও দিকে মন ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রবীর উঠে অভিধানের কাছে গেল। গিয়ে বলল, “দেখি, আপনি কেমন ছবি আঁকতে পারেন। ছবি আঁকার হাত আপনার কেমন দেখি।” অভিধানের আঁকা ছবি দেখে চমকে উঠল প্রবীর। প্রবীর দেখল, অভিধান একটি বাচ্চা মেয়ের ছবি এঁকেছে। একদম ছোট একটি বাচ্চা মেয়ের ছবি। মেয়ের ছবিটি দেখে মাথা ঘুরতে লাগল প্রবীরের। বাচ্চা শিশুর ছবি দেখে ঘামতে লাগল সে।
প্রবীর চৌকিতে গিয়ে বসল। কী মনে হলো অভিধানের, তার পকেটে থাকা শৌখিন কালো-কালির কলমটি দিয়ে বাচ্চা মেয়েটির ডান গালে কালো রঙের একটি গোলাকার, সুন্দর একটি কালো-তিল এঁকে দিল।
অভিধান সাদা কাগজে তার আঁকানো ছবিটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রাখল। কাগজটির ওপর নীল-কালির কলমটি রাখল। তারপর চেয়ারে পেছন দিকে হেলান দিয়ে তার চোখ দু’টি বন্ধ করল। চেয়ারে চোখ-বন্ধ করে বসে রইল অভিধান। বেশ কিছুক্ষণ চোখ-বন্ধ অবস্থায় বসে থাকার পর অভিধান তার চোখ দুটো খুলল। খোলা জানলার দিকে তার চোখ গেল। ভীষণ চমকে উঠল অভিধান। ভয়ানক চমকে উঠল প্রবীর। চৌকি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রবীর। প্রবীরের মাথা কাজ-করা বন্ধ করে দিল। ধপ করে চৌকিতে বসে পড়ল সে। অভিধান দেখতে পেল, খোলা জানলার সামনে দু’হাতে সন্তানকে তুলে ধরে অবন্তী খোলা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে। সৌবীর অবন্তীর পাশে।
সাত
অভিধান চেয়ার ছেড়ে উন্মুক্ত জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। অবন্তী তার দু’হাতে খোলা জানলার সামনে তার সন্তানকে তুলে ধরে রয়েছে। অভিধান প্রথমে বাচ্চাটির মুখ দেখল। এরপর দুটো ঠোঁট দেখল। তারপর বাচ্চাটির দু’টি চোখ, চোখের কালো-পাতা, কালো রঙের ভ্রু, মাথার কালো চুল দেখল। বাচ্চাটির ফর্সা নাক, কান, গাল, হাত-পা, হাত-পায়ের আঙুল দেখে অভিধান বলে উঠল, “ভ্রুণ। একটি ভ্রুণ।” বাচ্চাটির ডান গালের দিকে চোখ দিতেই চমকে উঠল অভিধান। দেখল, বাচ্চাটির ডান গালে একটা গোল কালো তিল। অবাক হয়ে অভিধান তাকিয়ে রইল তিলটির দিকে। আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল কালো তিলটির দিকে। কবিরা কবিতা লেখা সম্পূর্ণ করে যে-পরিমাণ অফুরন্ত আনন্দ লাভ করে, লেখকরা তাদের প্রথম প্রকাশিত গল্পের বইকে বুকে জড়িয়ে ধরে যে-পরিমাণ অপরিসীম খুশি অনুভব করে, ঔপন্যাসিকরা তাদের লেখা উপন্যাস-বইয়ের-গন্ধ শুঁকে যে-পরিমাণ সুখ উপলব্ধি করে, অবন্তী-সৌবীরের বাচ্চাকে দেখে তেমনই আনন্দ, খুশি আর সুখে ভরে গেল অভিধানের সমস্ত দেহ। অবন্তী জানলার আর একটু কাছে গিয়ে বাচ্চাটিকে দু’হাতে ধরে জানলার সামনে আরও একটু উঁচুতে তুলে ধরল। অভিধান জানলার শিকের মধ্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে তার দু’হাতে নিল। বাচ্চাটি অভিধানের হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে-সাথে নড়ে উঠল। হাত-পা নড়াচড়া করতে লাগল। জানলার লোহার শিকের ফাঁকা দিয়ে দু’হাতে বাচ্চাটিকে ধরে অভিধান বলে উঠল, “আহ, কি পরম শান্তি! আহ, কি চরম সুখ!
আট
অল্প সময় পর প্রবীর এসে অভিধানকে বলল, “ডাক্তারবাবু, জানলা থেকে আপনি একটু দূরে সরে আসুন তো। “অভিধান বাচ্চাটিকে অবন্তীর হাতে দিয়ে জানলার কাছ থেকে দূরে সরে এল। প্রবীর জানলার কাছে গেল। তারপর জানলার পাল্লা দুটো ধরে সজোরে ‘দ্রাম’ শব্দ করে জানলাটি বন্ধ করে দিল। জানলাতে মজবুত করে জানলার হুড়কা লাগিয়ে দিল। দরজায় গিয়ে কাঠের ডাঁসা লাগিয়ে দিল। অপর জানলাটি ঠিকঠাক লাগানো রয়েছে কিনা দেখে নিল। জানলার ধারে বসে কবিরা কবিতা লেখে, জানলা দিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেম করে, জানলার ধারে দাঁড়িয়ে নতুন বর-বউ সারা রাত কাটিয়ে দেয়, মন খারাপের সময় জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষ মনকে তরতাজা করে। জানলা ছাড়া ঘর অসম্পূর্ণ। জানলা ঘরের সৌন্দর্য। সেই জানলাকে কোনওরকম সম্মান না জানিয়ে বিশ্রী শব্দ করে বন্ধ করাতে, জানলার সাথে কুৎসিত ব্যবহার করাতে অভিধান মনে-মনে ভীষণ ক্ষুন্ন হলো। জানলার সাথে খারাপ আচরণ করায় একরাশ ক্ষুন্নতা বুকে নিয়ে অভিধান চেয়ারে এসে বসল। সারা ঘরে ডিমলাইটের আবছা অন্ধকার। প্রবীর তার নিজের মোবাইলে ফেসবুক দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
চেয়ারে বসে অভিধানের সামনে ভেসে উঠল, অবন্তী ও তার চার বছরের মেয়ে একটি পাখিফুল-গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। অবন্তী পাখিফুল-গাছ থেকে পাখিফুল তুলছিল। অবন্তীর মেয়ে অবন্তীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। অভিধানের মনে এল, গাছের কচি পাতা পাখির লেজের মতো ঝোলে বলে সম্ভবত গাছটিকে পাখিফুল-গাছ বলা হয়ে থাকে। সারা ফুলগাছ গুচ্ছবদ্ধ উজ্জ্বল লাল-রঙের পাখিফুলে পরিপূর্ণ ছিল। উজ্জ্বল লাল-পাখিফুলের অপরূপ সৌন্দর্যে ছেয়েছিল চারদিক। হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অবন্তী তার মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। বৃষ্টি আরও জোরে পড়তে লাগল। বৃষ্টির জল ভিজিয়ে দিচ্ছিল অবন্তী ও তার মেয়েকে। হঠাৎ ফুটন্ত ছাতা নিয়ে হাজির হলো সৌবীর। ছাতার নিচে অবন্তী তার মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিল। অভিধান দেখতে পেল, ছাতার তলায় অবন্তী, সৌবীর ও তাদের চার বছরের মেয়ে। স্কেটিং-করা একটি আরশোলা অভিধানের গায়ে উঠে স্কেটিং করার চেষ্টা করতেই অভিধানের সম্বিত ফিরে এল। মিলিয়ে গেল ছাতার নিচে দাঁড়ানো অবন্ত, সৌবীর ও তাদের মেয়ে।
নয়
দরজা-জানলা বন্ধ আবছা-অন্ধকারের ঘরটিতে গুমোট আবহাওয়া। কঠোর ভাবে গৃহবন্দি অভিধান। বদ্ধ-ঘরে ভেতর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অভিধান। আস্তে-আস্তে নিচু হয়ে মেঝের কাছে বসল। মেঝের মাটিতে হাত দিল। ঘরটির মাটি একটি আঙুলে লাগিয়ে তার কপালে লম্বা করে মাটির একটি তিলক পড়ল। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল। ঘরের ভেতর একরাশ নিস্তব্ধতা। সময় সামনের দিকে এগিয়ে চলল। ঘরে কঠিনভাবে গৃহবন্দি অভিধান। গৃহবন্দি-ঘরের মাটির তিলক অভিধানের কপালে। ঘরবন্দি-ঘরের মাটি অভিধানের কপালে।
সমাপ্ত
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!