কলকাতা থেকে দিল্লী আসছি। রাজধানী ট্রেনে করে। আমার আশেপাশে অনেক যুবতী মেয়ে। আমার স্বামী আমার সামনের সিটে, জানলার ধারে। আর ঠিক তার সামনের সিটে আমি, জানলার কাছে। সিনিয়র সিটিজেন, তাই নিচের দুটো সিটে বসে আছি আমরা দুজনে। দিনের বেলায় তখন আমি জানলার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আর পতিদেব এক মনে মোবাইল ঘাঁটছেন।
শুনলাম – আমার ঠিক পাশের মেয়েটি ফোনে কারোর সঙ্গে তেজে ঝগড়া করছে। আমি ওর দিকে তাকালাম। খুব সুন্দরী। ও বলছে, ” তুমি টাকার জন্য আমাকে দূরে পাঠাও। আমাকে বেচে নিজের মা, বাপ, ভাই, বোনেদের পেট চালাও। লজ্জা করে না তোমার! নিজে রোজগার করে ওদের খাওয়াতে পারো না? আমি তোমায় দেখে নব! আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে চির জীবনের মত দুবাইয়ে থেকে যাব। এই যে দিল্লী আসছি। এখানে এক সপ্তাহ থেকে তো মুম্বাই যাব। ওখানে তো দু সপ্তাহ থাকব। তারপর আর কলকাতায় ফিরব না। ওখানের একজন আমাকে বলেছেন যে দুবাইয়ে পাঠিয়ে দেবেন। আমি তাইই করব। আমার বাবার দেওয়া সব গয়নাগুলো তো বেচে খেলে, তোমরা গুষ্টি মিলে। আমার বাবার দেওয়া ফ্ল্যাটটাও তো বেচে দিয়ে টাকা নিয়ে নিলে। মদ গিলে, জুয়া খেলে, ফুর্তি মারিয়ে উড়িয়ে দিলে। এখন ভাড়া ঘরে আমার রোজগারে গুষ্টি নিয়ে আছো। আর আমি তোমাদের টাকা দব না। আর গায়ে হাত তুলতে পারবে না। আমি তো আর তোমার সঙ্গে থাকবোই না। মার খেয়ে কেন পরে থাকব? এখনও আমার গায়ে লাঠির দাগ রয়েছে। আর তোমার গুণ্ডা ভাই সে তো আমায় টানাটানি করে। গালে এখনও নখের আঁচড় কেটে আছে। ভাইকে শাসন করতে পারো না! ঠিক আছে, আমাকে আর একদম বার বার বার ফোন করবে না! বরণ করে দিলাম! ” এই বলে ও ফোন কেটে দিল।
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ওর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে এসেছিল। আঁচড় কাটা গালের জল ও রুমাল দিয়ে মুছছিল। নিজের থেকেই বলল, ” জানেন মাসী! আমার লোকটা আমাকে ঘরে দু এক দিন রাখে আর বেশ্যার কাজ করতে জোর করে পাঠায়। না এলে গলা টিপে ধরে। ” আমি বললাম, ” তোমার বয়স কত? কোথায় থাকো তুমি? কেঁদো না, চুপ কর? ” ও বলল, ” একুশ বছর। রাজা বাজার এলাকায়, কলকাতায় থাকি। আমার নাম নূরজাহান। আমি টেন পাস। আমার পাঁচ বছর হল সাদী হয়েছে। আমার স্বামীর বাড়ির সবাই মিলে আমার পেটের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিল। বিয়ের তিন বছর পর পেটে এসেছিল। বলল সবাই মিলে এতো তাড়াতাড়ি দরকার নেই। পরে মা হবি! ” খুব কাঁদছিল। নাম না বললে বোঝার উপায় নাই যে ও মুসলমান। অতি ভদ্র পোশাক। চুড়িদার পরা। খুব ভালো করে সামনে ওড়না দেওয়া। সংযতভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিল। সব সময় সাবধানে আছে – যেন আমাকে ও ছুঁয়ে না ফেলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” তুমি একলা যাচ্ছো? ” ও অন্যদের দেখিয়ে বলল, ” এরা সবাই আমার সঙ্গে একই কাজে যাচ্ছে। আমরা সবাই নামলে, আমাদের একজন দিদি এসে গাড়ি করে নিয়ে যাবে। সে বিউটি পার্লারের মালকিন। সে তার ফ্ল্যাটে আমাদের রাখবে। খাওয়াবে। ওখান থেকেই হোটেলে নিয়ে যাবে। সেখানে সারা রাত ডিউটি করতে হবে। অনেক টাকা পাই। ” আমি দেখলাম আশেপাশের মেয়েরা সবাই টিন এজার। এইই সবচেয়ে বয়স্কা।
আমি মোবাইল ফোনের মধ্যে মন দিলাম। বুকটা আমার ফেটে যাচ্ছিল। হায়! বিয়ে করে ওকে কি করতে হচ্ছে! এবার দেখি কি, আমি যা খাচ্ছি ওরাও তাইই খাচ্ছে। আমি আইসক্রিম কিনলাম। ওরাও কিনে খেল। আমি ফ্রুট জুস কিনলাম। ওরাও। আমি দু পা সিটে তুলে বাবু হয়ে বসেছি তো ওরাও তাইই করল। আমি ফোন ঘাঁটছি তো ওরাও। আমি ফোনের ঠাকুরের ছবিকে প্রণাম করলাম তো ওরাও মক্কার ছবি বের করে মাথা ঠেকালো। অবাক হলাম আমি। একটু পরে নূরজাহান বলল, ” মাসী তুমি আল্লার খুব কাছের আছো। ” আমি বললাম, ” না তো। আমি তো ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শিষ্যা। ” ও বলল, ” আমি দিল থেকে সারা পাচ্ছি। তুমি বহুৎ সাঁচ্চা আছো। আল্লা আমাকে বুঝিয়ে দিল। ” এই বলে ও আমার পায়ের কাছে মাথা নত করে বসল। ছুঁলো না আমাকে। আমি ওর দু কাঁধ ধরে তুললাম। সিটে বসালাম। এরপর ও আমার পায়ে মাথা ঠেকালো। সাহস করে ছুঁলো। ওর দেখাদেখি সবাইই তাই করলো। এবার আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে এলো। ওরাও কাঁদছে আর আমিও। আর আমার স্বামী ও সব দেখে উঠে চলে গেল। অনেক পরে এসে আবার বসল। এরপর আমি আর ওদের সঙ্গে কথা বললাম না। বুঝলাম যে স্বামী আমার পছন্দ করছেন না।
ওরাও ব্যাপারটা বুঝলো। তাই চুপ করে থাকলো। অনেক সময় কাটলো। নামার সময় নামলাম সকলেই। এরপর স্টেশনে এসে ওরা আমাকে আবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। আমি বললাম, ” ঠাকুর দয়া করুন! ” এবার যে যার মতো চলে এলাম।
পরে উবের কারে করে বাড়ি আসতে আসতে পথে আমার মনে হল – ঠাকুর তো নানা ধর্মের পথেই সাধনা করেছিলেন। তাই আসল সার অনুভব করে বলেছিলেন, “যত মত তত পথ।” আবার তিনি যে সকলকেই আপন করে নিয়েছিলেন। তাই তো নটী বিনোদিনীকে উনি নিজের করে নিয়েছিলেন। আমি যেন মিল খুঁজে পেলাম মনে মনে মনে। সত্যিই ঠাকুরের কৃপা ধন্যা আমি, তাই হয় তো ট্রেনে ওদের সঙ্গ পেয়েছিলাম।
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!