কবিতার কাছে কি প্রত্যাশা করে, পাঠক?
– কাব্যত্ব?
– কাব্যত্ব কা’কে বলে?
– রসাত্মক বাক্যই কাব্য।
কবিতার ভিতরে কাব্যত্ব কোথায় থাকে? কোন গুণে বা কী কারণে শব্দবন্ধ বা বাক্য রসাত্মক হয়ে উঠে কাব্য হয়?
কেউ কেউ বলেন, কাব্যের আত্মাই কবিতা।
কাব্যের আত্মা যাই হােক। কাব্যের শরীর হল শব্দবন্ধ বা বাক্য। আবার অনেকে বলেন- ওই শব্দবন্ধের অর্থ ছাড়া, কাব্যের আর আলাদা কোনাও আত্মা নেই।
বাক্যের শব্দ আর অর্থকে আটপৌরে না রেখে, সাজ-সজ্জায় সাজিয়ে দিলেই, বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে। এই সাজ-সজ্জার নামই অলংকার। শব্দকে যেমন অলংকারে, অনুপ্রাসে সাজিয়ে সুন্দর করে তোলা যায়। বাচ্যের অর্থকে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক-য়ে সাজিয়ে সুন্দর করা যায়। অনেকে আবার বলেন, কাব্যের আত্মা অলংকার নয়। তা
হলো রীতি বা স্টাইল। পদ রচনার বিশিষ্ট ভঙ্গি। কাব্যে আত্মা তার স্টাইল। ‘কাব্যের ইতিহাস হল তার টেকনিকের ইতিহাস’, যেমন আঁরাগ প্রমুখেরা ভাবতেন।
টেকনিকের সেই ইতিহাস লক্ষ্য করে বলা যায়, ছন্দ সমর্পিত শব্দের নামই কবিতা। দান্তে যেমন বলেহিলেন, ‘সুরে বসানো কথাই হল কবিতা।’
অলংকার পরলেই যেমন সবাইকে সুন্দর দেখায় না, যদি না তা, তার অবয়বের সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
এই অবয়বের সামঞ্জস্যপূর্ণতাই হলো স্টাইল বা রীতি।
রমণী দেহের লাবণ্য যেমন অবয়বের চেয়ে, অলঙ্কারের চেয়ে অতিরিক্ত অন্য কোনাও জিনিষ, তেমনি মহাকবির রচনা এমন এক বস্তু, যা শব্দ-অর্থ, রচনা ভঙ্গি – এ সবের অতিরিক্ত আরও বেশি কিছু। এই ‘অতিরিক্ত আরও বেশি কিছু’ ই হল কাব্যের আত্মা।
এই বস্তু আবার কী জিনিষ?
বস্তুবাদীরা বলেন, এই জিনিষটি হল, কাব্যের বাচ্য বা বক্তব্য।
কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে ওই বস্তু বা ভাবের বিশিষ্টতার উপর। তারা ভেবে থাকেন সব বস্তৃ বা সব ভাব কাব্যের বিষয় নয়। বিশেষ বিশেষ বস্তু, বিশেষ বিশেষ রকমের ভাবকে প্রকাশ করলে, তবেই তা কাব্য হয়। বস্তু বা ভাবের মনোহারিত্ব, অভিনবত্ব বাক্যকে কাব্য করে তোলে। যেমন, প্রকৃতি, চাঁদ, নারী, সূর্য, ফুল, পাখি, প্রজাপতি, ভ্রমর, ঋতু বৈচিত্র প্রভৃতি। তেমনই অনেক রকম ভাব আছে, যা মনকে আকৃষ্ট করে। যেমন অনুভূতির ক্ষেত্রে প্রেম, ভক্তি, বীরত্ব, করুণা, মহত্ব, মানবতা প্রভৃতি।
কবিরা, এইসব বিশিষ্ট ভাব বা বস্তুকে কাব্য প্রকাশ করেন। তাদের প্রকাশের বিশিষ্টতায় (স্টাইল) তা যখন ভাব ও বস্তকে আরও মনোজ্ঞ করে তোলে, তখনই তা কাব্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, ভাব-বস্তু-রীতি-অলংকার এদের যথার্থ সমন্বয়েই কাব্যের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া আর অতিরিক্ত কাব্যের আত্মা বলে কিছ নেই।
যেমন রক্ত, মাংস, মজ্জা ইত্যাদি উপাদানের যথার্থ সমন্বয়েই মানব দেহে চেতনার উদ্ভব ঘটে, মন নামে আলাদা কোনা বস্তু নেই। অনেকে আবার এই মতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। কারণ তারা দেখেছেন, ভাল কবিতার প্রকৃতিই হচ্ছে বাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। শব্দার্থে যতটুকু প্রকাশ হয়, সেই কথ্য-বস্তু (বক্তব্য)-টুকই কাব্যের প্রধান কথা নয়। তা যদি হত, তবে শব্দার্থের জ্ঞান আছে, এমন যে কোনও ব্যক্তিই কাব্যের আস্বাদ নিতে পারতেন। কিন্তু তা হয় না।
ভালাে কবিতা নিজের বাচ্যার্থে আটকে না থেকে বিষয়ান্তরের ব্যঞ্জনা বহন করে। তাকে ‘ধ্বনি’ বলেন আলঙ্করিকরা। কবিরা বলেন ‘রস’। কাব্য হচ্ছে সেই সব শব্দ-বন্ধ বা বাক্য, ‘রস’ যার আত্মা। এই জন্যই বলে, রসাত্মক বাক্যই কাব্য।
রসবােধ সব সময় বিদ্যা-বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে না। তাকে বিদ্যা-বৃদ্ধির দ্বারা বিচার করে, মাপ-জোক করে, কিছুই বোঝার উপায় থাকে না। হৃদয়ের ভিতরে রসবোধ না থাকলে, তা উপল্ধি করা যায় না। এই জন্যই বলে বোধহয়, ‘রসিক বােঝে রসের মর্ম, বে-রসিকে তার পায় না স্বাদ।
কাব্যের রস বিচার করে, সব সময় পাঠক তার থেকে কাব্য-রসের স্বাদ পায় না, সেই আস্বাদ পায় রসিক পাঠক, দরদী মনের অনুভূতি মিশিয়ে।
সহদয় পাঠক, কাব্যানুশীলনের অভ্যাসে, সে রস আস্বাদনের যোগ্য হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায়, কাব্যরসের আধার-কাব্যও নয়, কবিও নয়। তা হলো রসিক কাব্য পাঠকের মন। রসবোধ এক ধরনের মানসিক অবস্থান বলা যায়। কী করে মনে, এ অবস্থার উদ্ভুব ঘটে?
দার্শনিক কান্ট, জ্ঞানের উৎপত্তি বিশ্রষণ করে দেখিয়েছেন, তাতে দু’ধরনের উপাদান থাকে, মানসিক ও বাহ্যিক।
বাইরের উপাদান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মনে প্রবেশ করে, কিস্তু তা জ্ঞান নয়। জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে, যখন মনের কতগুলি তত্ত্ব, ওই বাহ্যিক উপাদানের উপর কাজ করে, বিশেষ পরিণতি বা আকার দেয়। এই সব তত্ত্ব মন বাইরে থেকে আহরণ করে না। নিজের ভেতর থেকে এনে বাইরের জিনিষের উপর তার প্রভাব ফেলে।
যেমন, রােদের তাপে মাথা গরম হয়। এই জ্ঞানের বাহ্যিক উপাদান রোদ, আগেকার অবস্থার ঠান্ডা মাথা এবং পরের অবস্থার মাথা গরম ভাব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মনে প্রবেশ কর। কিন্তু রোদ এবং গরম মাথার সম্পর্কটি অর্থাৎ ওদের
কার্য-কারণ সম্বন্ধে মনের দান। এই কার্য-কারণ তত্বের প্রয়োগেই বাহ্যিক উপাদান জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। উল্টোভাবে বলা চলে, ঐ বাহ্যিক উপাদান-ই মনোগত সাধারণ কার্য-কারণ তত্ত্বকে বিশেষ কার্যকারণের জ্ঞানে পরিণত করে এবং জ্ঞানের অথই হলাে, বিশেষ জ্ঞান। বাহ্যিক উপাদান এবং মানসিক তত্ত্ব- এই দুয়ের সংযোগ
হলে, তবেই জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। একটিকে ছাড়া, অন্যটি অস্তিত্বহীন।
রসের বিশ্লেষণেও এই দুই ধরনের উপাদান রয়েছে, মানসিক ও বাহ্যক।
রসের মানসিক উপাদান হল মনের ভাব বা ইমাোশনগুলি। আর বাহ্যিক উপাদানগুলি, জ্ঞানের বাহ্যিক উপাদানের মতাে, বাইরের লৌকিক জগৎ থেকে আসে না। আসে কবির সৃষ্ট কাব্য-জগৎ থেকে। কাব্য-জগতের ওই বাহ্যিক উপাদানের ক্রিয়ায় মনের ভাবে রূপান্তরিত হয়ে, রসে পরিণত হয়। সুতরাং রস জিনিষটি লৌকিক বস্তু নয়। তবে মনের যে সব ভাব রসে রূপান্তরিত হয়, তারা অবশ্যই লৌকিক।
শোক একটি মানসিক ভাব বা ইমোশন। লৌকিক জগতের বাহ্যিক কারণে, মনে শােকের জন্ম হলে, মানুষ শোকার্ত হয়ে ওঠে। কিস্তু শোকার্ত লোকের মনের শােক, তার কাছে রস নয় এবং সে শোকের কারণটিও কাব্য নয়।
কিস্তু কবি যখন তার প্রতিভার মায়াবলে, এই লৌকিক শোক ও তার লৌকিক কারণের, এক অলৌকিক চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলেন, তখনই রসিক পাঠকের মনে, রসের উদয় হয়। যার নাম-করুণ রস। এই করুণ রস শোকের ইমোেশন নয়।
শােক হচ্ছে দুঃখদায়ক। কিস্তু কবির কাব্য পাঠে, মনে যে করুণ রসের সঞ্চার হয়, তা চোখে জল আনলেও, মনকে অপূর্ব আনন্দে ভরিয়ে তোলে। এই কথা, কাব্যের আস্বাদ যার আছে, সে-ই জানে। কিন্তু তা কাউকে প্রমাণ করে বোঝানাে কঠিন। কারণ, করুণা রসে মনে যে অদ্ভুত সখ্য জন্মে, তার একমাত্র প্রমাণ হৃদয়বান লোকের অনুভূতিতে। করুণ রস শুধুমাত্র দুঃখের কারণ হলে, রাময়ণ পাঠে কেউ আর আগ্রহ বোধ করত না।
‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought’ যথার্থ কথাই বলেছেন কবি। তবে মনে রাখতে হবে, tell of saddest thought, যে বাস্তব ঘটনা মনে সােজাসুজি Sad thotght আনে, তা sweet ও নয় song-ও নয়। কবি যখন, সেই Saddest thought-এর কথt কাব্যে তুলে ধরেন, নানা রূপকল্পে, তখনই তা Sweetest song-য়ে রূপাস্তবিত হয়।
রস বা কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ। কবি তাঁর কাব্যে যে মায়া জগৎ সৃষ্টি করেন, তার কৌশল কী?
এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর অসম্ভব। কারণ, প্রত্যেক সার্থক কাব্য, এক বিশেষ সৃজন, কলের (machine) তৈরি জিনিস নয়।
প্রেমিকের মনে যে প্রেমের উদ্ভব হয়,তা
রসও নয়, কাব্যও নয়। কারণ তা প্রেমিকের
ব্যাক্তিগত হদয়ে আবদ্ধ। সুতরাং তা পরিমিত। তা লৌকিক। অতএব রস বোধের অন্তরায়।
কবি যখন প্রতিভার মায়ায়, এই পরিমিত লৌকিক ভাবকে ‘সকল সহৃদয় হৃদয় সংবাহী’
আলৌকিক রস মুর্তিতে রূপান্তর ঘটান, তখন তা কাব্য হয়ে ওঠে। পাঠকের মনেহয়, কাব্যের চরিত্র এবং ভাব পরের, কিন্তু সম্পূর্ণ পরের নয়, কিছুটা আমার নিজেরও, কিস্তু সম্পূর্ণ নিজেরও নয়।
আজকের দিনে মহাকাব্যে লেখা হয় না বললেই চলে। লিরিক কাব্য লেখা হয়। এখন যখন কবির নিজের মনের ভাবই কাব্যের উপাদান, তখন এই ভুল প্রায়ই ঘটে দেখি, কবির হৃদয়ের ভাবকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করাই বুঝি কবির লক্ষ্য এবং যে কবির ভাব যত তীব্র, যত আবেগময়, তার কাব্য সৃষ্টিও তত সার্থক। তাই যদি হত, তা হলে সাম্প্রদায়িকতা জিগিরের উম্মত্ত উত্তেজক সব ভাষণই উৎ্কৃষ্ট কাব্য বলে বিবেচিত হত। কারণ, তাতে সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা ও ক্রোধকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা সফল ভাবেই করে।
লােকে যদি আলো চায়, তবে তাকে জ্বালতে হয় বাতি (লাইট), তেমনি কবির লক্ষ্য যদিও রস সৃষ্টি, কিন্তু তার জন্য তাকে সৃষ্টি করতে হয় কাব্যের শব্দার্থময় কথা। এই কথাবস্তু যদি সহদয় পাঠকের মনে, অভিপ্রেত রস সঞ্চার করে, তবেই কবির কাজ সার্থক হয়। এর বেশি তার সাধ্যের বাইরে। কারণ, কাব্য কোনও
পাঠক-বিশেষের মনে রসের উদ্রেক ঘটাবে কিনা, তা কেবল কাব্যের উপর নির্ভর করে না, পাঠকের মনের রুচির উপরও নির্ভর করে।
কবি যে ভাবকে রসমূর্তিতে রূপ দিতে চান, যদি পাঠকের মন সে ভাব সম্পর্কে কতকটাও কবির মনের সহমর্মী না হয়, তবে সে পাঠকের কাছে কাব্য ব্যর্থ। কাব্য যে ভাবকে, রসে পরিণত করতে চায়, পাঠকের মনে তার কোনও ধারণাই যদি না থাকে, তবে তার বয়স যতই হোক, সে কাব্য সম্বন্ধে শিশু। অর্থাৎ ওই কাব্য তার জন্য নয়। মনে ভাব থাকলেই যে রসের আস্বাদন হবে, এমন
আবার নাও হতে পারে। যদি তার কাব্য পাঠের অভ্যাস না থাকে।
কাব্যের লক্ষ্য রস। শব্দ-বক্তব্য-স্টাইল-অলস্কার তার উপায় মাত্র। এই উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে এক যাদু প্রক্রিয়া বিদ্যমান, যা সকলেই বোঝে না, কেবল মাত্র কবিমনই বুঝতে পারে। এ জন্য কাব্যে পাঠে অভ্যস্থ পাঠকের কাছে যে ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে, সকলের কাছে তা ধরা পড়া সম্ভব নয়।
অবশ্য বেরসিকের কাছে এর কোন মূল্য নাও থাকতে পারে। যেমন, উদাহরণ স্বরূপ একটি বাস্তব ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করি। আমার এক তরুণ বন্ধু-সুশিক্ষিত, মার্জিত, রুচিবোধ সম্পন্ন, কম্প্যুটারে পারদর্শী, আই. টি সেক্টরে কর্মরত। একদিন কথায় কথায় আমায় বলল, তোমরা কবিতা কবিতা করে এমন মাতামাতি কর কেন বল তাে? কী মজা পাও আধুনিক কবিতা পড়ে? আমি তাে পড়ে ছাই কিছুই বুঝি না।
আমি তখন তাকে বলি। তাহলে তোমাকে একটা কবিতা বলি শোন –
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিয়াছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ; বিন্বিসার অশোেকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূরে অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লাস্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সযফন,
আমাদের দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’
বন্ধু শুনে বলে উঠলো, আরে থামো থামাে। এতাে পাগলের প্রলাপ | চলতি ছােকরাদের ভাষায়, ভাট বকা। হাজার বছর কেউ বাঁচে যে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে, বিস্বিসার -অশোকের ধূসর জগতে ঘুরবে? ঘুরে ক্লান্ত হবে, তারপর বনলতা সেনের দেখা পেয়ে শাস্তি পাবে।
আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি, এ তো কবির কল্পনা।
সে শুনে বলে, একেবারে অবাস্তব কল্পনা। যার কোনও মাথা মুন্ড নেই। তার চেয়ে বললেই পারতাে –
‘লক্ষ বছর ধরে আমি তাে আদম হয়ে ঘুরে ফিরি সমুদ্রে জঙ্গলে
নিবিড় শান্তি পেতে দু’দন্ডের তরে, ইভকে যে খুঁজে পাই অকস্মাৎ নিষিদ্ধ ফলে।
এরপর আমি আর কোনোদিন ওকে ভুলেও কবিতার রস গেলাতে যাইনি। কারণ সে কোনও দিনই বুঝবে না কবিতার ব্যঞ্জনা। কবিতার রস আস্বাদন করার মতন মনটাই ওর তৈবি হয়ে ওঠেনি যে। অথবা মনটাকে ও সেভাবে তৈরী করে তোলবার কথা ভাবেনি। তাই কবিতার রস সকলের জন্য নয়। যেমন ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ তেমনি সকলেই কবিতার পাঠক নয় কেউ কেউ কাব্য-পাঠক। এই জন্যই গল্প-উপন্যাসের মতো কখনোই কবিতার বইয়ের বাজার থাকে না। কবিতার বই বিক্রি, এত কম হয়।
কবিতার ভাষা, স্টাইল বা অলংকার প্রয়াোগের কোনও বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। নিয়ম থাকা সম্ভবও নয়। কেননা রস ছাড়া এদের আর কোনও আলাদা মুল্য নেই।
প্রাচীন কবিদের কাব্য বিচার করে, যদিও তার কাব্য থেকে কোনও কোনও সাধারণ নিয়ম আবিস্কার করা যায়, নতুন কবিদের ক্ষেত্রে সে নিয়ম প্রযোজ্য নাও
হতে পারে। কারণ, তাদের কাব্য প্রতিভা সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে চলেও, সার্থক কাব্য সৃষ্টি করতে পারে।
কাব্যের বিষয় সম্পর্কেও এই একই ব্যাপার। কী নিয়ে কবি কাব্য রচনা করবেন, তা কারও পক্ষই বলে দেওয়া সম্ভব নয়। কোন ‘অপূর্ব কথা বস্তু সৃষ্টি করে, রসকে আকর্ষণ করবে, আগে থেকে কে তা নির্ণয় করতে পারে? কারণ, এমন কোনও বিষয় নেই, যা রসিক কবি
প্রকাশ-উপযোেগী করে তুলতে পারেন না। বস্তু জগতের মতো কাব্য জগতও সীমাহীন। কাব্যে, কবির ব্যবহার স্বাধীন, বাইরের কোনও কিছুর আনুগত্য তাকে মানতে বাধ্য করা চলে না।
কবি জীবনানন্দ দাশ বলতেন, “কাব্যের ছন্দ তাে অনেক রকম, গদ্যও ছন্দও তো একরকম ছন্দ। কবি যখন ভারাক্রান্ত হন, তখন চোখ তার ছবি দেখে, কান শোনে ছন্দ এবং চোখও অনুভব করে যেন ছন্দ বিদ্যুৎ। কোন ছন্দে কবিতাটি রচিত হবে মুহুর্তের ভিতরেই নির্ণীত হয়ে যায় অনেক সময়।”
কাব্যের লক্ষ্য হল রস। রস হল ভাবের পরিণতি। কিন্তু ভাব কোন নিরালম্ব জিনিষ নয়। বস্তুকে আশ্রয় করেই তা জন্মায় এবং বেঁচে থাকে। কবি ভাবের এই বস্তুকে কথা-শরীর দিয়েই রসের উদ্বোধন ঘটান। সৃতরাং কাব্যের কথা-বস্তু যদি ভাবের প্রকৃত বস্তুর যথার্থ চিত্রণ না হয়, তবে রসের উদ্বোধনের ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করে। বর্ণনা এমন হবে যাতে পাঠকের অনুভূতি রঞ্জিত হয়।
কবি জীবনান্দ দাশ বলতেন, “কবিতা সৃষ্টির জন্য নিজেদের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করতে গিয়ে ও সেই কবিতা সৃষ্টি করবার সময় উপরোক্ত সামাজিক লাভ-অলাভের প্রশ্ন কবির বড় চেতনায় বিশেষ কোনো ছায়াপাতই করে না, তার চৈতন্য ও অনুচেতনা ঐকাস্তিকভাবে সক্রিয় থাকে কবিতাটিকে সৎ, সার্থক করে তোলার জন্য।”
কাব্যের জগৎ তাই সমস্তাটাই বস্তুর জগৎ নয়। খানিকটা মায়ারও জগৎ। তাই বলা চলে, ‘রামের জন্মভূমি সত্য, কবির মনোভূমি — তার চেয়েও বেশি সত্য।’
মহাকবি বাল্মীকির কাছে, রামের জন্মভূমি যতটা সত্য ছিল তার চেয়ে বেশি সত্য ছিল তার মনোভূমি। না হলে তার সৃজনকর্ম “রামায়ণ’ মহাকাব্য না হয়ে, শুধুমাত্র ইতিহাস গ্রন্থ বলেই বিবেচিত হত আজ। অনেকে আবার বলেন, রামের জন্মের আগেই নাকি মহাকবি রামায়ণ রচনা করেছিলেন।
কথা বস্তুর লক্ষ্য – বস্তু নয়, রস। কাব্যে যে বস্তুকে তুলে ধরা হয়, তা বস্তুর জন্য নয়, রস সৃষ্টির জন্য। কাজেই উপায় যদি উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যায়, তবে কাব্যের রস-হানি ঘটে। কাব্যের উৎকর্ষতা হ্রাস পায়। বস্তুর বাস্তবতা অনস্ত। কোনও কবিই তার সবটুকু কাব্যের কথাবস্তুতে স্থান দিত পারেন না। যদি পারতেন,
তবে তার সৃষ্টি আর যাই হাক কাব্য হত না। সুতরাং বাস্তবতার কতটুকু কাব্যে স্থান পাবে, তা নির্ভর করে, সেই কাব্যের উদ্দিষ্ট রসের উপর, এবং বিশেষ করে কবি প্রতিভার বিশেষত্বের উপর।
বস্তুর বাস্তবতার যে অংশ কাব্যের রসকে পরিপুষ্ট করতে পারে না, সেই অংশ কবিতার ভার, বোঝা। তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
বস্তুতস্ত্র এবং ভাবতন্ত্র রস সৃষ্টির দুই ভিন্ন কৌশল। কোন কবি, কোন কাব্যে, কোন কৌশল অবলন্বন করবেন তা নির্ভর করে তার রুচি এবং প্রতিভার বিশেষত্বের উপর। এই দুই কৌশলের মধ্যে সৃষ্ট রসের আস্বাদের ভিতরে প্রভেদ থাকলেও কিন্তু রসত্বের প্রভেদ নেই। সুতরাং কেউ, কাউকে ছােট ভাবলে, সেটা অবশ্যই ভুল করা হবে। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, প্রথাগত ধারায় রচিত কবিতা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক ধারায় সৃষ্ট কবিতা, যখন দুটি ধারাই একসঙ্গে বহমান থাকে, তখন দুটি ধারার দিকেই সমান দৃষ্টি দেওয়া প্রয়াোজন। সুতরাং কাউকে অগ্রাহ্য করা ভুল হবে। একটাকে বাদ দিয়ে অথবা একটা শুধু পড়লে, রুচির প্রসার ঘটবে না। তবে এক আস্বাদের রসে অরুচি হলে,কিছুদিনের জন্য পাঠক অন্য রসের স্বাদ নিতে পারেন। খেজুরে অরুচি হলে তেতুলের স্বাদ গ্রহণে বাধা নেই কোনও।
কাব্যের সঙ্গে কাব্যের ছােট বড়র ভেদ, মূলত রসের তারতাম্য নিয়ে। কাব্য আর অকাব্যের ভেদ, এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
কাব্যে রস সৃষ্টির যে সব উপাদান যথা শব্দ, স্টাহল, অলস্কার, ছন্দ – সে একই মাল মসলা দিয়ে রচিত রচনা, অথচ যাতে রস নেই, তা হচ্ছে অকাব্য। কেউ কেউ আবার তাকে বলে থাকেন ‘চিত্র-কাব্য’। চিত্র যেমন বস্তুর অনুকরণ কিন্তু বস্তু নয়, এও তেমনি কাব্যের অনুকরণ অথচ কাব্য নয়। এ রকম অকাব্য যে রচিত হয়, তার কারণ অনেক। প্রধান কারণ, রস সৃষ্টির প্রতিভা যার নেই, অথচ তার কাব্য রচনার ইচ্ছে আছে ষোল আনা। এই ইচ্ছের বেগে সে যা রচনা করে চলে, তা কাব্য হয় না, হয় কাব্যের ছায়ামুর্তি মাত্র। এই জন্যই, সমসমায়িক যশঃপ্রার্থী কবিরা কেউ কেউ, পূর্বসূরী কোনও প্রভাবশালী কবির ‘ভাষা-ছন্দ-ভঙ্গি র ব্যর্থ অনুকরণ করে সফল হতে চায়। কারণ তাদের মনের ভরসা, কতকটা ওই রকম, মূর্তি গড়তে পারলেই, তার মধ্যে রস সঞ্চার আপনা থেকেই হয়ে যাবে।
সত্যি বলত কী, তা কখনোই হয় না, ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। আবার অনেকে আছেন, যাদের কাব্য রচনার উদ্দেশ্য- উপদেশ দেওয়া, প্রচার করা, মানুষের বুদ্ধির কাছে কোনো সত্যকে তুলে ধরা। যেমন পােপের, ‘এসে অন ম্যান’ অথবা কৃষ্ণচন্দ্র মজমদারের ‘সদ্ভাব শতক’ কিংবা ‘খনার বচন’, এইসব রচনাকে কাব্যের আকারে গড়লেও, রস এখানে উপায় মাত্র, বক্তব্যই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সুতরাং এইসবগুলি কাব্য নয়। কাব্যের ছদ্মবেশ মাত্র। পদ্য বলা চলে। কবিতায় রসই প্রধান উপপাদ্য বিষয়। কাব্যে ব্যবহৃত অন্য আর সবকিছুই তার উপায় বা উপাদান মাত্র।
প্রসঙ্গতঃ কবি জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে। তিনি বলতেন, “কবিতা মুখ্যত লােকশিক্ষা নয়, কিংবা লোকশিক্ষাকে রসে মপ্তিত করে পরিবেশন – না, তাও নয়। কবির সে রকম কোনও উদ্দশ্য নেই”।
অ্যারিস্টটল জানতেন যে, বিসাদৃশ্যের মধ্য সাদৃশ্যের সন্ধান যে কবির ক্ষমতায় কুলায় না, সে প্রতিভায় বঞ্চিত।
আজকের দিনে মানুষের কাছে, সমাজ বন্ধন এবং সমাজ ব্যবস্থা (অর্থনীতি,রাজনীতি) খুব বড় হয়ে উঠেছে। এত বড়, যেন মনে হয় মানুষের সব প্রচেষ্টা, সমস্ত সৃষ্টির ওটাই হচ্ছে চরম লক্ষ্য। কিস্তু যে সব সৃষ্টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমাজের কোনও কাজ লাগে না, তার যে কোনও মূল্য আছে, সে কথা ভাবা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়েছে।
কিছু লােকের ধারণা, পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা একদিন সমস্ত মানুষকে দুর্দশাহীন, সকল রকম সুখ-স্বাচ্ছন্দের অধিকারী করে তুলবে। সুতরাং তাদের দাবী কবিদের উপর বেড়ে গেছে। তাদের সেই দাবী- কবির রস সৃষ্টির শক্তি এই সমাজ সংসারের মঙ্গল সাধনের জন্য নিয়ােজিত করা হোক। এ দাবী অসঙ্গতও নয়। লৌকিকে জীবনের উপর যে কবিতার প্রভাব নেই, তা তো নয়। কিন্তু সে ফল জীবনের পুষ্টিতে নয়, মানবিক মুক্তিতে। আমাদের আত্ম -উপলন্ধি আরও গভীর, আরও বিস্তৃত করা ছাড়া কবিতার অন্য আর কোনো উদ্দেশ্য না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।
কবি কাব্যের স্রষ্টা হলেও, সে অবশ্যই সামাজিক জীব। মানুষের দুঃখ-সুখ, আশা-নিরাশা, প্রণয়-হিংসা তার কাব্যের বিষয়। কবি তাদের রস সৃষ্টির উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেন, সেখানে হয়তোে কবির সামাজিকতা ঢাকা পড়ে যায়, কারণ রস সৃষ্টিই তার চরম লক্ষ্য। যেমন শেক্সপীয়রের নাটক, যেখানে কবির সামাজিকতা প্রবল কিন্তু তা রস সুষ্টির অস্তরায় হয়ে ওঠেনি। সামাজিকতা এখানে উপরি পাওনা।
কবি রসের ছলে উপদেশ দেন। ওই কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি কাব্য রসের সাহায্যে সত্যকে প্রকাশ করেন এ কথাও মিথ্যে। সত্য – কাব্যের লক্ষ্য নয়, রসের উপাদান মাত্র।
কবি বা শিল্পী, নেতা নন, সমাজ সংস্কারকও নন। তার কাজ সমস্যার সমাধান
বাতলে দেওয়া নয়। শুধু তা শিল্প সুষমায় প্রকাশ করে দেওয়া। বক্তব্যে উপদেশ দেওয়া নয়, সমাজের ক্ষতটা রসমন্ডিত করে তুলে ধরা।
কবি ইয়েটস বলেছেন, “অপরের সঙ্গে আমাদের যে কলহ, তা থেকে আমরা ভাষার অলঙ্কার পাই, আর নিজের সঙ্গে যে দ্বন্দু, তা থেকে কবিতা।”
কবিতায় উপদেশ দেওয়া, শিক্ষা দেওয়ার কাজ কবির পক্ষে যথার্থ নয়। সে কাজ অপরের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল।
শিল্পী যখন পাথর কুঁদে কুঁদে একটি মৃর্তির প্রকাশ ঘটান, তখন কেউ তাকে বলেন না যে মূর্তির মধ্য দিয়ে সে পাথরকে প্রকাশ করেছেন। এও তেমনি দৃষ্টি বিভ্রম মাত্র।
তাহলে এখন প্রশ্ন, কাব্য সংসার জীবন বা সমাজের কাজে কতটা লাগে?
কবি বলেন, কোনও কাজেই লাগে না। কাব্যের প্রধান কাজ রসিক পাঠকের মনে আনন্দ লহরী তােলা ছাড়া আর অন্য কিছুই নয়। কেউ যদি তার থোকে সংসার জীবন কিংবা সমাজের জন্য কিছু পান, তা তার বাড়তি পাওনা। এ’জন্য কবিকে কেউ কেউ অসামাজিক জীবও ভাবতে পারেন। মূর্খও ভাবতে পারেন। তা’তে প্রকৃত কবি দুঃখ পাবেন বলে মনেহয় না।
কবিতা কখনোই তত্বকে প্রমাণ করে না। সে তত্বকে রূপদান করে মাত্র। সব সময় যে তাও করে, তা নয়। তত্ত্ব হােক বা না হােক, একটা কিছু যে কোনও রস
বস্তকে, সে আপনার কল্পনায় ও ভাবে – ছাঁচে ফেলে, একটা সুষমাময় রূপে গড়ে গড়ে তুলতে পারলেই সে খুশি।
সে ভাবকে ধরতে চায় না, অভাবনীয়কে ধরতে চায়। এই জন্য সে যে রস সৃষ্টি করে, তার মধ্যে আসল ভাবটা কি, তা উদ্ধার করা এত কঠিন। মুখে যেমন মনের নানা ভাবের আলাে-ছায়ার কারুশিল্প দেখা যায়, কবিতার মধ্য দিয়ে তেমনি ভাবের নানা ইশারা ইঙ্গিত মাত্র পাওয়া যায় মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।
ঋণস্বীকার – অতুলচন্দ্র গুপ্ত।
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!