১৯০১ সালে এলামিদের প্রাচীন রাজধানী সুসায় খননকার্য চালানোর সময় মাটির তলা থেকে আবিস্কৃত হয় ১২টি পাথরের টুকরো। তাতে আক্কাদীয়ান ভাষায় খোদাই করে লেখা ছিল মোট ২৮২টি বিধান। এই বিধানগুলোকেই পৃথিবীর সব চেয়ে প্রাচীন লিখিত আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা হয়— দ্য কোড অব হাম্বুবারি।
সেই আইন সংহিতায় প্রথমেই লেখা ছিল— আমি হাম্বুরাবি। স্বয়ং ঈশ্বর আমাকে এখানে সম্রাট করে পাঠিয়েছেন। আমিই ব্যাবিলনের প্রথম ইউফ্রেতিস অঞ্চলের বিজয়ী বীর। তার পরেই লেখা ছিল সেই মোক্ষম বাণী— আমি আমার দেশের জনগণের জন্য প্রদান করলাম ন্যায়নীতির এই মন্ত্র। যে আমার তৈরি করা এই আইন অমান্য করবে বা অবমাননা করবে, তার ওপরে স্বয়ং ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসবে
যিনি এটা দাবি করেছিলেন, সেই হাম্বুরাবি তাঁর ৪২ বছরের রাজত্বকালে গোটা ব্যাবিলনে স্বর্ণযুগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর সে জন্যেই তিনি যখন নিজেই নিজেকে প্রজাদের পিতা বলে ঘোষণা করেছিলেন, তখন সবাই সেটা একবাক্যে মেনেও নিয়েছিলেন। কারণ সবাই তাঁকে মান্যি করতেন। না, শুধুমাত্র যুদ্ধ জয় বা সুশাসনের জন্যেই নয়, তাঁকে সবাই মান্যি করতেন তাঁর ‘কোড’ নামের এই আইন রচনার জন্য। যেটা তাঁকে পরবর্তীকালে পৃথিবীজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
কী রকম ছিল তাঁর সেই আইন-কানুন? জানতে হলে, তাঁর তৈরি করা মাত্র কয়েকটি ধারা তুলে ধরলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কত ভয়ঙ্কর ছিল সেই বিধান।
তাঁর রচিত ফৌজদারি আইন ছিল মূলত প্রতিশোধমূলক। অঙ্গহানির বিপরীতে অঙ্গহানি। মৃত্যুর বদলে মৃত্যু। মানে, কেউ যদি কারও একটা আঙুল কেটে নেয়, তা হলে যে কেটেছে, তারও একটা আঙুল কেটে ফেলা হবে। কিংবা কেউ যদি কাউকে খুন করে থাকে, তা হলে তাকেও খুন করা হবে, এটাই ছিল বিধান।
তাঁর আইন সংহিতার ১৯৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও সন্তান যদি তার বাবাকে আঘাত করে, তা হলে যে হাত দিয়ে সে আঘাত করেছে, সেই হাত কেটে ফেলা হবে।
১৯৬ নং ধারাটি আবার কিছুটা বৈষম্যমূলক। পক্ষপাত দুষ্টও বলা যেতে পারে। যেমন, কোনও সাধারণ নাগরিক যদি কোনও অভিজাত লোকের চোখ নষ্ট করে দেয়, তা হলে তার শাস্তি হিসেবে ওই সাধারণ নাগরিকের চোখও উপড়ে ফেলা হবে। আবার ওই একই কাজ যদি কোনও অভিজাত লোক করে, তা হলে সেই লোকটি কিন্তু মুচলেকা দিয়ে অনায়াসে ছাড়া পেয়ে যাবে।
২০৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, দু’জন লোক যদি একে অপরের সঙ্গে মারপিট করে, আর তাতে যদি কেউ গুরুতর আহত হয়, তা হলে আহতের দাবি মতো পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিলেই, যে আঘাত করেছে সে রেহাই পেয়ে যাবে।
২১০ নং ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও লোক গর্ভবতী মহিলাকে আঘাত করে এবং সেই আঘাতের কারণে যদি সেই গর্ভবতী মহিলা মারা যায়, তা হলে আঘাতকারীর মেয়েকে জনসমক্ষে হত্যা করা হবে।
তাঁর রচিত পারিবারিক আইনও ছিল ভারী অদ্ভুত। ১২৯তম ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও বিবাহিত নারী কোনও পরপুরষের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে, তা হলে সেই পুরুষ এবং নারীকে বেঁধে একসঙ্গে জলে ডুবিয়ে মারা হবে। এ ক্ষেত্রে স্বামী যদি তার স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেয়, তা হলে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার জন্য কেবলমাত্র ওই পুরুষটিকেই সেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
১৫৯-১৬০ ধারায় বলা হয়েছে, বিয়েতে পাত্রপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ উভয়ই উভয়কে যৌতুক প্রদান করতে হবে। এবং বিয়ের আগেই তা পরিশোধ করে দিতে হবে।
আবার এক জায়গায় বিধান দেওয়া হয়েছে, স্ত্রী যদি স্বাস্থ্যের দিক থেকে দুর্বল হয়, তবে তার স্বামী ইচ্ছা করলে স্ত্রীর পাশাপাশি একজন উপপত্নীও রাখতে পারে। এই উপপত্নী স্ত্রী হিসেবে গণ্য না হলেও, তার গর্ভের সন্তান কিন্তু ওই স্বামীর সন্তান হিসেবেই সামাজিক স্বীকৃতি পাবে।
এই আইনে সন্তানদের উপরে বাবার অধিকার দেওয়া হয়েছে সব চেয়ে বেশি। এমনকী, বাবা যদি চায়, সে তার সন্তানকে বিক্রিও করে দিতে পারে।
আইন সংহিতার ১৯২ নং ধারায় লেখা রয়েছে, কোনও পালক সন্তান যদি কখনও রেগে গিয়েও তার মাকে বলে, তুমি আমার মা নও, তা হলেও শাস্তি হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে তার জিভ কেটে নেওয়া হবে।
হাম্বুরাবির ‘কোড’-এ লুঠ সংক্রান্ত আইনের ২২ এবং ২৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ডাকাত যদি ডাকাতি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তা হলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। আর যদি ডাকাত ধরা না পড়ে, তা হলে যার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে শহরের গভর্নর।
২১ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও চোর যদি চুরি করার সময়ে ধরা পড়ে যায়, তা হলে যেখানে ধরা পড়বে, সেখানেই গর্ত খুঁড়ে তাকে পুঁতে ফেলা হবে। এমনকী, মন্দির বা আদালতের সম্পদ চুরি করলেও এই একই বিধান ছিল হাম্বুরাবির আইনে।
এগুলোকে এখন যতই অদ্ভুত এবং অমানবিক মনে হোক না কেন, সে সময়ে কিন্তু পৃথিবীর সব চেয়ে প্রাচীন লিখিত এই আইনকেই সমর্থন করত সবাই এবং অক্ষরে অক্ষরে তা পালনও করত।