একটি জেলার উন্নয়ন চিত্রের সাথে সে জেলার সড়ক, ব্রিজ আর শিল্পকারখানা-ই শুধু নির্ভর করেনা। সেই জেলার মানুষের চিন্তা চেতনা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অবস্থাও সমান নির্ভরশীল। আপনার চিন্তা চেতনা ও সাংস্কৃতিক অবস্থান সুন্দর না হলে সুন্দর কোনো কিছুই আপনার থেকে আশা করা হবে বোকামী। বরিশালের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন?
ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি আওয়ামী লীগ ছাড়া এ জেলায় বর্তমানে আর কোনো রাজনৈতিক দল আছে কিনা তা বোঝা কষ্টসাধ্য। তবে মাঝে মধ্যে মহানগর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার উঁকি ঝুঁকি দেন। তার এই উঁকি ঝুঁকিটাও ঘর কিম্বা মসজিদ- মন্দিরে কেন্দ্রীক।
সেটা কেন তার ব্যাখ্যাও আমরা জেনেছি সাবেক সাংসদ সরোয়ার এর মুখেই। তিনি বলেছেন, রাস্তায় নামলেই ধর পাকড় কিম্বা মামলা – হামলার আতঙ্কে ভোগেন নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে তার বিপক্ষের কিছু নেতা-কর্মীর অভিযোগ, সরোয়ার এর বয়স হয়েছে। তিনি এখন আরাম প্রিয় হয়ে গেছেন। আন্দোলনে ভয় পান।
এমতাবস্থায় জেলায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বটাই চোখে পড়ে সবার আগে।
সম্প্রতি মহানগর বিএনপিতে আবারো এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এবার বেশ কয়েকজন সহ সভাপতি ও অনুসারী নিয়ে আলাদা হলেন আরেক সহ সভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুক। এর আগে মহানগর যুবদলের এবং ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্ধের সুত্রপাত জাতীয় দৈনিকের আলোচ্য ছিলো। এবারো একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ এনে আলাদা হলেন ফারুক।
বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও বরিশাল মহানগর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার এ দ্বন্ধের কথা স্বীকার করে বলেছেন, বহিরাগত কিছু লোক আওয়ামী লীগের মদদে দলকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র করছে।
এরই উত্তরে মহানগর বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরুজ্জামান ফারুক জানালেন তার ক্ষোভের কথা। বরিশাল প্রতিদিন পত্রিকায় মজিবর রহমান সরোয়ার এর বক্তব্য তাকে ইঙ্গিত করেছে উল্লেখ করে তিনি ক্ষোভের সাথে জানালেন,
বরিশালে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বগত দিকদিয়ে খুব একটা পার্থক্য নেই। এখানে বিএনপি মানে মজিবর রহমান সরোয়ার ও তার আত্মীয় পরিজন। এর বাইরে কাউকে আসতে দেয়া হয়না। দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মী এখানে অবহেলিত।
একজন লোক একাধারে সংসদ সদস্য ও মেয়র। আবার সাংসদ আবার মেয়র। মহানগর ও জেলার সভাপতি আবার কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব। যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আছেন তিনি। তার কাছের লোকেরা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছে। যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের তিনি মূল্যায়ন হতে দেন না। কারণ কেন্দ্রে শুধু তার লবিং চলে। এই নিয়ম ভাঙা জরুরী।
তিনি বলেন, মজিবর রহমান এর আগে জেলারও সভাপতি ছিলেন। তখন এবাদুল হক চান এর সাথে, সাবেক মেয়র কামালের সাথেও তার দ্বন্দ্ব হলে তারাও আলাদা হয়ে যান। একই বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদা বহু সমাবেশ আগেও হয়েছে।
গত সম্মেলনে ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়েই এ দ্বন্ধের শুরু বলে জানান ফারুক।
তিনি আরো বলেন, সরোয়ার ক্ষমতার দাপটে এতোটাই অন্ধ হয়েছেন যে, সব কর্মীদের তিনি লাগেজ বহনকারী মনে করেন। তার পছন্দ মতো চলতে পারলে তবেই তাকে পদ প্রদান করেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে বরিশালে এমনিতেই বিএনপির কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা। নেতৃত্ব তৈরীর সুযোগ না থাকলে নতুন নেতৃত্ব কে দেবে? সুযোগ তো দিতে হবে।
৩ জুন বৃহস্পতিবার সাময়িকী প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন মনিরুজ্জামান ফারুক।
ছাত্রদল কমিটি নিয়ে বিরোধিতার পরে যুবদলের কমিটি নিয়েও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের সাথে মজিবর রহমান সরোয়ারের দ্বন্দ্ব আজো চলছে বলে জানান তিনি।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে জেলার একজন দক্ষিনের সহ সভাপতি জানান, সরোয়ার ভাইয়ের অবদান অস্বীকার করবো না। মনিরুজ্জামান ফারুক ভাই তার হাত ধরেই বিএনপিতে এসেছেন। কিন্তু আজ অবস্থা এমন হয়েছে যে, বিএনপি নয়, মানুষ ব্যক্তি সরোয়ার কে চেনে। এটা ক্ষতিকর। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের এ বিষয়ে ভাবা উচিত।
বরিশাল জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবায়দুল হক চান অবশ্য এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে রাজি নন। তবে সরোয়ারের দুটি পদে থাকা সমীচীন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘গঠনতন্ত্র যার হাতে, এটা তিনি নির্ধারণ করবেন। আমি মনে করি, যাঁরা প্রকৃতই বিএনপি করেন, তাঁদের দলীয় গঠনতন্ত্র মানা উচিত এবং দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত।’
সরোয়ারের পক্ষের নেতারা মনে করেন, বরিশালে বিএনপি মানেই মজিবর রহমান সরোয়ার। এক ব্যক্তির এক পদ বিধান থাকলেও বিএনপির প্রধান চাইলে বিশেষ ক্ষমতাবলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁদের যুক্তি, বরিশাল বিভাগে বিএনপির অবস্থান এখন অত্যন্ত নাজুক। তবে সরোয়ার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে নগর বিএনপিকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই গোটা বিভাগে বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। এখন সরোয়ার না থাকলে নগর বিএনপিও দুর্বল হয়ে পড়বে। এর রেশ পড়বে গোটা বরিশাল অঞ্চলের বিএনপিতে।
এই যে দুটি পদ ধরে রাখা এ বিষয়ে কি বলবেন? এমন প্রশ্ন করা হলে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘আমার এ নিয়ে কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নেই। আমিও চাই নতুন নেতৃত্বের বিকাশ হোক। কিন্তু সেটা হতে হবে গঠনতান্ত্রিক নিয়মে। নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কিছুদিন আগে মারা যাওয়ার পর বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বে আছেন। এখন আমি নগর বিএনপির পদ ছাড়লে এ পদেও একজন ভারপ্রাপ্ত আসবেন। এতে তো আর নেতৃত্বের বিকাশ হলো না। যদি পদ ছাড়তেই হয়, তবে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের হাতে ছাড়তে হবে।’
দুটি পদে থাকা সমীচীন কি না, জানতে চাইলে বরিশাল সদর আসনের চারবারের সাংসদ ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত এ মেয়র বলেন, ‘এটা সমীচীন না হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকেরা বরিশালের রাজনীতি সম্পর্কে খুব ভালো জানেন। তারা এখনো এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কোনো আলাপ করেননি। আলাপ করলে এ বিষয়ে যেটা বাস্তবসম্মত, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’তার আগে আমি সবাইকে ঐক্য ধরে রেখে একসাথে মাঠে থাকার ও বরিশালে বিএনপিকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানাবো।