নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম সেমিফাইনালে ভারত ৭০ রানে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করেছে। কলকাতায় কালকের (বৃহস্পতিবার) দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের বিজয়ী দলের সঙ্গে রবিবারের ফাইনালে ভারতের দেখা হবে।
একটা সময় পর্যন্ত টানটান উত্তেজনায় ভরা এই ম্যাচে ৩৯৮ তাড়া করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ড ৪৮ ওভার ৫ বলেই ৩২৭ রানে অল আউট হয়ে যায়।
১১৯ বলে ১৩৪ রান করে নিউজিল্যান্ডের হয়ে একটি অনবদ্য ইনিংস খেলেন ড্যারিল মিচেল, কিন্তু দলকে জেতানোর জন্য তা যথেষ্ঠ ছিল না।
নিউজিল্যান্ডের হয়ে তৃতীয় উইকেটে কেইন উইলিয়ামসন ও ড্যারিল মিচেল ১৮১ রানের একটি অসাধারণ পার্টনারশিপ খেলেন – একটা সময় মনে হচ্ছিল তারা দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তেও নিয়ে যেতে পারবেন।
কিন্তু দলীয় ২২০ রানের মাথায় মহম্মদ শামি উইলিয়ামসনকে তুলে নেওয়ার পরই নিয়মিত ব্যবধানে নিউজিল্যান্ডের উইকেট পড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ তারা ম্যাচ থেকে হারিয়ে যেতে থাকে।
ভারতের হয়ে আরও একবার বলে ভেলকি দেখিয়েছেন মহম্মদ শামি, নয় ওভার ৫ বলে ৫৭ রান দিয়ে তিনি তুলে নিয়েছেন মোট ৭টি উইকেট।
নিউজিল্যান্ডের প্রথম চারটি উইকেটই গেছে তার ঝুলিতে। এছাড়া যশপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ সিরাজ ও কুলদীপ যাদবও পেয়েছেন একটি করে উইকেট।
এর আগে প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ডকে জেতার জন্য ৩৯৮ রানের বিশাল টার্গেট দিয়েছিল ভারত। ভারতের হয়ে সেঞ্চুরি করেন ভিরাট কোহলি (১১৭) আর শ্রেয়স আইয়ার (১০৫)।
ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করার রেকর্ডও এই ম্যাচে ভেঙে দিয়েছেন ভিরাট কোহলি।
ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা টসে জিতে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমে ফিল্ডিং করতে পাঠান এবং এরপর ভারত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে তোলে ৩৯৭ রান।
ইনিংসের শুরুতেই ঝোড়ো ব্যাটিং করে ইনিংসের শক্ত ভিত গড়ে দেন রোহিত শর্মা – যেটাকে তিনি এই বিশ্বকাপে প্রায় রুটিনে পরিণত করে ফেলেছেন। ভারতের ৫০ রান আসে মাত্র ৫ ওভার ২ বলে।
রোহিত শেষ পর্যন্ত আউট হন মাত্র ২৯ বলে ৪৭ রান করে, যে ইনিংসে ছিল চারটি চার ও চারটি ছক্কা। ওপেনিং জুটিতে তিনি ও শুভমান গিল মিলে ৮ ওভার ২ বলে করেন ৭১ রান।
প্রথম পাওয়ার প্লে-তে ভারত মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে করে ৮৪ রান।
গিল পরে পায়ের পেশীতে টান ধরার কারণে সেঞ্চুরির কাছাকাছি এসেও ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। তখন তার রান ছিল ৬৫ বলে ৭৯।
এরপর দলের হাল ধরেন শ্রেয়স আইয়ার ও ভিরাট কোহলি – তাদের জুটিতে ওঠে ১৬৩ রান।
কোহলি শেষ পর্যন্ত আউট হন টিম সাউদির বলে, ১১৩ বলে ১১৭ রান করে। তার ইনিংসে ছিল ৯টি চার ও দুটি ছক্কা।
এটা ছিল তার ওয়ান-ডে কেরিয়ারের ৫০তম সেঞ্চুরি, যার মাধ্যমে তিনি শচীন তেন্ডুলকরের ৪৯টি সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙলেন। তেন্ডুলকর নিজেও তখন মুম্বাইয়ের স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন।
ঠিক দশদিন আগে কোহলি কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচে সেঞ্চুরি করে তেন্ডুলকরের রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন।
ওদিকে শ্রেয়স আইয়ারের সেঞ্চুরি আসে মাত্র ৬৭ বল খেলে। তার ইনিংসে ছিল ৪টি বাউন্ডারি ও ৮টি ওভার বাউন্ডারি।
নিউজিল্যান্ড বোলারদের মধ্যে টিম সাউদি তিনটি ও ট্রেন্ট বোল্ট ১টি উইকেট পেয়েছেন। তবে দু’জনেই ছিলেন অসম্ভব খরুচে, বোল্ট দিয়েছেন ১০ ওভারে ৮৬ রান আর সাউদি ১০ ওভারে ঠিক ১০০ রান।
মুম্বাইয়ের পিচ নিয়ে বিতর্ক
নিউজিল্যান্ড ও ভারতের মধ্যকার বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ম্যাচ মাঠে গড়ানোর কয়েক ঘণ্টা আগে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের উইকেট নিয়ে তুমুল বিতর্ক উঠেছে।
ভারত ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটি হচ্ছে এমন একটা উইকেটে যেখানে আগে দুটি ম্যাচ খেলা হয়েছে।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোর খবর অনুযায়ী ম্যাচটি এর আগে সাত নম্বর পিচে খেলার কথা ছিল। ওই পিচে এখনও কোনও ম্যাচ হয়নি।
কিন্তু ম্যাচের আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে ম্যাচ ছয় নম্বর পিচে হবে, যেখানে আগে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ইংল্যান্ড এবং ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা ম্যাচ হয়েছিল।
ভারত এই উইকেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩০২ রানের জয় পেয়েছে গ্রুপ পর্বে। সেই ম্যাচে শ্রীলঙ্কা ৫৫ রান অলআউট হয়ে গেছে।
নিউজিল্যান্ডের গণমাধ্যম এনজেড হেরাল্ড বলছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়াই বিসিসিআই সেমিফাইনালের জন্য পিচ পরিবর্তন করেছে।
আইসিসি ইভেন্টে পিচ নিয়ে কাজ করেন অ্যান্ডি অ্যাটকিনসন। তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইলে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “বিশ্বকাপের আগে যে পরিকল্পনা ছিল সেটায় বদল এসেছে। এই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের কোনও ইভেন্টের ফাইনালে টিম ম্যানেজমেন্ট ও স্বাগতিক বোর্ডের অনুরোধের পিচে খেলা হতে যাচ্ছে”।
তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের নীতিমালায় পুরনো পিচ বা নতুন পিচে খেলার কোনও বাধাঁধরা নিয়ম নেই।
পিচ ও আউটফিল্ড নীতিমালায় বলা হয়েছে, “যেই মাঠকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ম্যাচ আয়োজনের, ভেন্যু কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে সেরা উইকেট কোনটি এবং সেরা আউটফিল্ড কন্ডিশন কোনটি”।
২০১৯ ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ও এজবাস্টনে তাজা, নতুন পিচে সেমিফাইনাল খেলা হয়েছিল।
তবে ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দুটি সেমিফাইনালই আয়োজিত হয়েছিল পুরনো পিচে, যেটি আগে ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান যা বলছে
চলতি বিশ্বকাপে ভারত নয়টি ম্যাচের সবকটিতে জয় নিয়ে সেমিফাইনালে এসেছে, অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের যাত্রা পথ ছিল অম্লমধুর।
কখনো টানা জয়, কখনো টানা ম্যাচ হারের ভেতর দিয়ে যাওয়া নিউজিল্যান্ড শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বড় ব্যবধানের জয় দিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা পাকা করেছে।
তবে নিউজিল্যান্ড যখন প্রতিপক্ষ, তখন ভারতের দলটার মনের কোণে একটা ভয়ের জায়গা থাকাই স্বাভাবিক।
ক্রিকেট ইতিহাসে ভারত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চারটি নকআউট ম্যাচে হেরেছে বিভিন্ন ফরম্যাটে।
আবার নিউজিল্যান্ড গত তিন বিশ্বকাপেই কোনও না কোনও স্বাগতিক দলের বিপক্ষে হেরেছে নকআউটে কিংবা ফাইনালে।
২০১৫ ও ২০১৯ টানা দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে স্বাগতিক দলের কাছে হেরে শিরোপা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে নিউজিল্যান্ডকে।
এবারে ভারত ও নিউজিল্যান্ড তাই উভয়েই সতর্ক।
ওয়াংখেডেতে পরে ব্যাট করে জেতা কঠিন
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেডে স্টেডিয়াম ব্যাটারদের জন্য স্বর্গ বলেই বিবেচিত।
যেমন ওয়াংখেডে স্টেডিয়ামে ২০২৩ বিশ্বকাপে শুরুতে ব্যাট করে গড় রান এসেছে ৬ উইকেটে ৩৫৭, কিন্তু পরে ব্যাট করে এসেছ ৯ উইকেটে ১৮৮।
এর মধ্যে আবার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের সেই ডাবল সেঞ্চুরিও আছে, যা এখন ক্রিকেট ইতিহাসের একটা স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে থাকবে।
এর কারণ নতুন বল ফ্লাডলাইটের আলোর নিচে বেশি সুইং পাচ্ছে এবং দীর্ঘ সময় এর প্রভাব থাকছে।
পার্থক্যটা সুষ্পষ্ট।
ব্যাটাররা প্রথম ইনিংসে যে সুবিধা পান সেটা দ্বিতীয় ইনিংসে পাওয়াটা কঠিনই।
যেহেতু ম্যাক্সওয়েল প্রতিদিন এমন ইনিংস খেলবেন না এবং সব দলে ম্যাক্সওয়েল নেই।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করবেন যারা তাদের খেলতে হবে টেস্ট ম্যাচের মতো।
বিশেষত প্রথম ১৫টা ওভার, যখন বল সবচেয়ে বেশি সুইং পাবে।
এই সময়ের মধ্যে ২ উইকেটের বেশি না হারানোর চেষ্টা করবে রান তাড়া করতে নামা দল।