বাংলাদেশের আরেকটি বড় হার, মাহমুদউল্লাহর শতকের সৌরভ
কাগিসো রাবাদার বলটা ফাইন লেগে খেলে ছুটলেন মাহমুদউল্লাহ। রান পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রথমে দুই হাত উঁচিয়ে ধরলেন, মুষ্টিবদ্ধ একটি হাত ছুঁড়লেন বাতাসে। পরে দিলেন সিজদাহ। ৩৭ বছর বয়সে এসে, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপে তার তৃতীয় শতকের উদযাপন সারলেন এভাবে। ম্যাচে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে এটুকুই। নির্বিষ বোলিং আর অন্যদের হতশ্রী ব্যাটিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও সঙ্গী হলো বড় হার।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার বাংলাদেশের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় ১৪৯ রানে।
এই ম্যাচ যখন শেষ হলো, বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে পার হচ্ছিল ঘূর্ণিঝড় হামুন। বাংলাদেশের বোলারদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে যায় আরও কয়েক ঘন্টা আগে! তিন দিন আগে যে মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৯৯ রান করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, সেখানেই এবার তারা করে ৩৮২ রান।
যেখানে অগ্রণী ভূমিকা কুইন্টন ডি ককের। ১৪০ বলে ১৫ চার ও ৭ ছক্কায় ১৭৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা তিনিই।
বিশ্ব মঞ্চে আগের দুই আসর মিলিয়ে ১৭ ইনিংসে যার ছিল না কোনো শতক, সেই ডি কক এবার প্রথম ৫ ইনিংসেই করে ফেললেন তিনটি!
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৭ বলে ১০৯ রানের পর এবার ৪৯ বলে ৯০ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন হাইনরিখ ক্লাসেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার রান পাহাড়ের জবাবে ৮১ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশের সামনে চোখ রাঙাচ্ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয়। সেই শঙ্কা কাটে মাহমুদউল্লাহর দুর্দান্ত ওই শতকে। সতীর্থদের ব্যর্থতার মাঝে ১১১ বলে ১১ চার ও ৪ ছক্কায় ১১১ রানের ইনিংস খেলেন তিনি ছয় নম্বরে নেমে। বাংলাদেশ অল আউট হয় ২৩৩ রানে।
জয়ে আসর শুরুর পর টানা চার ম্যাচ হেরে সেমি-ফাইনালের স্বপ্ন আরও ফিকে হয়ে গেল বাংলাদেশের। পাঁচ ম্যাচের চারটি জিতে, নিউ জিল্যান্ড টপকে পয়েন্ট টেবিলের দুই নম্বরে উঠে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের যে জীর্ণ দশা, তাতে ম্যাচের সম্ভাব্য ফল একরকম নিশ্চিত হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের পরই। রেকর্ড রান তাড়ার চ্যালেঞ্জে নেমে সাবধানী শুরু করেন তানজিদ হাসান ও লিটন দাস। এরপর ৮ বলের মধ্যে বিদায় নেন তিন জন।
মার্কো ইয়ানসেনের পরপর দুই বলে ফেরেন তানজিদ ও শান্ত। দুজনই লেগ স্টাম্পের বলে ধরা পড়েন কিপারের গ্লাভসে। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ‘গোল্ডেন ডাক’ এর তেতো স্বাদ পান শান্ত। লিডাজ উইলিয়ামসের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে আলগা শটে সাকিবও ক্যাচ দেন কিপারের হাতে।
বিনা উইকেটে ৩০ থেকে বাংলাদেশের স্কোর যায় ৩ উইকেটে ৩১।
সেই ধাক্কা সামলে উঠবে কী, মুশফিকুর রহিমও পারেননি বেশিক্ষণ টিকতে। ছক্কার চেষ্টায় উইকেট বিলিয়ে আসেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। লিটন এলবিডব্লিউ হয়ে যান ৪৪ বলে ২২ রানের মন্থর ইনিংস খেলে।
মিরাজ যখন ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে বিদায় নেন, বাংলাদেশের দেড়শ কিংবা একশ হওয়া নিয়েই তখন শঙ্কা। সেখান থেকে লেজের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে মাহমুদউল্লাহর ওই ইনিংস।
প্রথমে তিনি নাসুম আহমেদের সঙ্গে ৪১ ও হাসান মাহমুদের সঙ্গে ৩৭ রানের জুটি গড়েন। এরপর মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে নবম উইকেটে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের রেকর্ড ৬৮ রানের জুটির পথে চতুর্থ ওয়ানডে শতক তুলে নেন মাহমুদউল্লাহ। তার এই ইনিংসে পরাজয়ের ব্যবধানই কমে শুধু।
অথচ গল্পটা অন্যরকমও হতে পারত। ম্যাচের শুরুতে ছিল দারুণ কিছুর ইঙ্গিত। আগের দিন টস জেতার জন্য সবাইকে দোয়া করতে বলেছিলেন অধিনায়ক সাকিব। টস ভাগ্যকে পাশে না পেলেও বোলিংয়ে শুরুটা ভালোই করে বাংলাদেশ। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে মিরাজের বলে স্লিপে জীবন পেলেও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি রিজা হেনড্রিকস। সপ্তম ওভারে দারুণ এক ডেলিভারিতে তাকে বোল্ড করে দেন শরিফুল ইসলাম।
মিরাজ এরপর টিকতে দেননি রাসি ফন ডার ডাসেনকে। এই দুজনকে হারিয়ে পাওয়ার প্লেতে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলতে পারে কেবল ৪৪ রান।
প্রোটিয়াদের ওপর সেই চাপ যদিও ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। টানা বোলিং করে যাওয়া মিরাজের বিপক্ষে শুরু থেকে সাবধানী খেলা ডি কক পরে নিজেকে মেলে ধরেন স্বরূপে। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন এইডেন মার্করাম।
বাংলাদেশের আলগা বোলিংয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুজনের জুটি শতরান স্পর্শ করে ১০৭ বলে। মার্করামকে (৬৯ বলে ৬০) ফিরিয়ে মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা জুটি (১৩৭ বলে ১৩১) ভাঙেন অবশেষে সাকিব। তাতে বিপদ যেন আরও বাড়ে!
এসেই আগ্রাসী ব্যাটিং শুরু করেন ক্লাসেন। ডি ককের সঙ্গে তার জুটি হয়ে ওঠে আরও বিধ্বংসী। ডি কিক ২০তম ওয়ানডে শতক স্পর্শ করেন ১০১ বলে। মাইলফলক ছোঁয়ার পর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন তিনিও। একশ থেকে দেড়শতে যেতে তার লাগে কেবল ২৮ বল।
৪৬তম ওভারে ডি কককে থামিয়ে ৮৭ বলে ১৪২ রানের জুটি ভাঙেন হাসান। বাংলাদেশের বোলারদের স্বস্তি তাতে খুব একটা মেলেনি। হাসান, মুস্তাফিজ, শরিফুলদের কচুকাটা করে টানা দ্বিতীয় শতকের সম্ভাবনা জাগান ক্লাসেন। হাসান সেটি হতে না দিলেও ক্লাসেনের ওই খুনে ইনিংস আর ডেভিড মিলারের ১৫ বলে ৩৪ রানের ঝড়ে চারশর দুয়ারে পৌঁছে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
বাংলাদেশ যেতে পারল না ধারেকাছেও।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৫০ ওভারে ৩৮২/৫ (ডি কক ১৭৪, হেনড্রিকস ১২, ফন ডার ডাসেন ১, মার্করাম ৬০, ক্লসেন ৯০, মিলার ৩৪, ইয়ানসেন ১; মুস্তাফিজ ৯-০-৭৬-০, মিরাজ ৯-০-৪৪-১, শরিফুল ৯-০-৭৬-১, সাকিব ৯-০-৬৯-১, হাসান ৬-০-৬৭-২, নাসুম ৫-০-২৭-০, মাহমুদউল্লাহ ৩-০-২০-০)
বাংলাদেশ: ৪৬.৪ ওভারে ২৩৩ (তানজিদ ১২, লিটন ২২, শান্ত ০, সাকিব ১, মুশফিক ৮, মাহমুদউল্লাহ ১১১, মিরাজ ১১, নাসুম ১৯, হাসান ১৫, মুস্তাফিজ ১১, শরিফুল ৬*; ইয়ানসেন ৮-০-৩৯-২, উইলিয়ামস ৮.৪-১-৫৬-২, কুটসিয়া ১০-০-৬২-৩, রাবাদা ১০-১-৪২-২, মহারাজ ১০-০-৩২-০)
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ১৪৯ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: কুইন্টন ডি কক