নদী তীরের শহর বরিশাল হতে পারে উৎপাদনশীল ও বাণিজ্যিক একটি শহর। পর্যটন শিল্পকে বাদ দিলেও এখানের নদী তীর এলাকা হতে পারে উইন্ডমিলের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। পেয়ারা কাঠাল ও নারিকেল হতে পারে শিল্পকারখানা স্থাপনের উপকরণ। অথচ রাজনৈতিক অবিবেচনা ও দূরদর্শিতার অভাবে পরনির্ভরশীল জাতি আমরা বরিশালবাসী।
সরেজমিনে গত একমাস বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ও জেলার কয়েকটি উপজেলা ও ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া গেছে তা যদি কবির ভাষায় বলি তাহলে বলতে হয়—–
উন্নয়নের রাজনীতি: হায় বরিশাল!
প্যাক আর কাদায় জোঁকের বিস্তার
অগভীর জলে হাঙরের সাঁতার।
এখন প্রশ্ন হতে পারে প্যাক আর কাদাতো বুঝলাম, অগভীর জলও না হয় বুঝে নেব কিন্তু জোঁক আর হাঙর বুঝি কি করে?
পুরো লেখাটি পড়লে আপনার বুঝে চলে আসবে এটা নিশ্চিত। শুধু জানুন জোঁকের কাজ কি আর হাঙর কি করে?
প্রথমেই সিটি কর্পোরেশন এর উন্নয়ন চিত্র দেখুন। কয়েকটি সড়কের চাকচিক্য ছাড়া আর কি আছে এই বিভাগীয় শহরে। কিন্তু অভিযোগ আছে, বিস্তার অভিযোগ মেয়রের বিরুদ্ধে। সব অভিযোগ কিন্তু আড়ালে আবডালে। প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস মেয়ের সাদিক সেরনিয়াবাত এর মামারও নেই। তার দালান ভাঙার মামলা ঝুলন্ত আছে এই শহরে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন: ২৪.৯১ বর্গ কিমি। জনসংখ্যা ২২৪৩৮৯; পুরুষ ১২৩৪০২, মহিলা ১০০৯৮৭। বলা যায় প্রায় ৩ লাখ। (মেয়র হিরণের সময়ের পরিসংখ্যান) সীমানা: উত্তরে কাউনিয়া ও এয়ারপোর্ট থানা, দক্ষিণে বন্দর থানা এবং নলছিটি ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে কাউনিয়া ও বন্দর থানা, পশ্চিমে এয়ারপোর্ট ও কোতোয়ালী থানা এবং নলছিটি উপজেলা।।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী কীর্তনখোলা নদী বেষ্টিত চমৎকার সম্ভাবনাময় একটি শহর এই বরিশাল। রয়েছে প্রাচীণ গর্বিত ইতিহাস। চন্দ্রদ্বীপ, বরি সল্ট থেকে বরিশাল হওয়া, আগা বাকের খানের বাকেরগঞ্জ হওয়া। অতঃপর বরিশাল পৌরসভা। পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৭০ সালে এবং বরিশাল সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয় ২৫ জুলাই ২০০২ সালে বিএনপির শাসনামলে।
বর্তমানে ৩ টি থানা, ৩০ টি ওয়ার্ল্ড এবং ১২৫টি মহল্লা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকা। রাজধানী ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে এখানের হাউজিং ট্যাক্স ও বাড়ি ভাড়া। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়েনা মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন। গত বিশ বছরের উন্নয়ন চিত্রে দেখা যায়, সম্প্রতি পায়রা বন্দর ও লেবুখালী ব্রীজের মূলা ঝুলিয়ে রাখাটাই একমাত্র দর্শন। যা কর্মসংস্থান হিসেবে মোটেই ভূমিকা রাখেনা। তবে কাজ সম্পন্ন হলে এটা অবশ্যই উপকারী হবে। কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা অনিশ্চিত।
রাজনীতির মাঠ বরিশাল সবসময় সরগরম। দেশভাগের সময় থেকেই বিশ্ব তথা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বরিশাল উল্লেখযোগ্য নাম। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশ গঠিত হবার পর ৭৫ পরবর্তী একটা সময় গেছে যখন বরিশাল অঞ্চলে আওয়ামী লীগের কোনো উল্লেখ হতোনা। যদিও হতো তা ছিলো ঝালকাঠি আমির হোসেন আমু এবং গৌরনদী হাসনাত আব্দুল্লাহ এর আপ্রাণ চেষ্টায়।
বর্তমান বরিশালের রাজনীতির মাঠ আপাতদৃষ্টিতে সম্পুর্ণ ই আওয়ামীলীগের দখলে। অন্য কোনো দল আছে বলেই মনে হয়নি গত একমাসে। মাঝেমধ্যে বিএনপির সাবেক সাংসদ ও বরিশালের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ার এর উঁকি ঝুঁকি দেয়া ছাড়া। আর হ্যাঁ, বামজোট বাসদ এর ডা. মনীষা চক্রবর্তী একাই সাহসের সাথে বিরোধীদলীয় ভূমিকা বাঁচিয়ে রেখেছেন এই বরিশালে। সহ্য করছেন পথ চলছেন অসংখ্য বাধাবিপত্তি।
এখানে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, মেয়র বরিশাল সিটি করপোরেশন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসানাত আব্দুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস। এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভপতি মনিরুল ইসলাম ছবি সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন খান।
মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার, সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার। জেলা বিএনপিতে আছেন য়েবায়দুল হক চাঁন ও আবুল কালাম শাহিন।
অন্যান্য রাজনীতির দলের তেমন ভুমিকা এখানে নেই তবে চরমোনাই পীরজাদা সৈয়দ রেজাউল করিম কখনো সখনো হাতপাখার বাতাস বিলির চেষ্টা করেন গরমের সময়।
আওয়ামী লীগের এই মানুষগুলোর ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা বর্তমান আওয়ামী লীগের কর্মী সংখ্যা জেলার জনসংখ্যার সমান। যা অনেকটা জোঁকের বিস্তার বলা যায়। কেননা সবখানেই কর্মীদের খুশি রাখতে কিছু না কিছু ত্যাগস্বীকার করতেই হয় নেতাদের। আর এই ত্যাগ যদি হয় সড়ক বা ব্রীজের কন্ট্রাক্ট তাহলেই ফুলে ফেঁপে ওঠা কর্মী নিজেই বড় নেতা হয়ে ওঠেন। কাজের মান দেখে তখন স্বয়ং মেয়র সাদিক বলে উঠেন – এটা কি রাস্তা বানাইছো, এখানেতো আমিও ডুবাইতে পারমু। গত ২৭ মে সিটি করপোরেশন এলাকার ঠাকুরবাড়ি সড়ক পরিদর্শন করে মেয়র এ কথাই বলেছেন।
উপজেলা সভাপতি ও চরকাউয়ার চেয়ারম্যান ছবির এলাকার চিত্রতো আগেই জেনেছি। কর্ণকাঠী ও চরকরন্দি সড়ক তার প্রমান।
বরিশাল সিটি করপোরেশন বিসিক এর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই উন্নয়ন বাজেটে। সব সিটি করপোরেশন এলাকায় বাজেট আছে, বরিশালে কেন নেই? সেও এক রহস্য বটে। তবে গুজব রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ বরিশালের মেয়র এর কাজে।
তাহলে উপজেলার চিত্র কি?
জেলার মোট আয়তন ২,৭৮৪.৫২ বর্গ কি.মি.। দশটি উপজেলা । বরিশাল সদর, বাকেরগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, আগাইলঝাড়া, উজিরপুর, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী, বানারীপাড়া, গৌরনদী। এই দশটি উপজেলার রয়েছে ৮৭টি ইউনিয়ন এবং১,১১৬টি গ্রামের প্রায় ২৩,২৪,৩১০ ( ২০১১ পরিসংখ্যান অনুযায়ী) লোক নিয়ে বরিশাল জেলা। এই ১১১৬টি গ্রামের চিত্র কি! ৬ টি সাংসদীয় আসনের কোন প্রতিনিধি ঘুরে দেখেছেন কখনো? আগে তবু নির্বাচন সময়ে হলেও প্যাক-কাদা মেখে সাংসদপ্রার্থী ঘুরতেন গ্রামে।গ্রামে। এখনতো নির্বাচনে কারো আস্থাই নেই। লোকবল ও টাকাই এখন সব।
কিন্তু এই গ্রাম যদি না বাঁচে বাঁচবে কি শহর?
করোনা মহামারী চাপে কর্মহীন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী। গ্রামীণ জনপদে আয়ের উৎস তৈরি হলে এই সুযোগে শহরমুখী চাপ কমবে। বরিশাল বিভাগের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। নতুন নতুন উৎপাদনশীল শিল্পকারখানা তৈরির রয়েছে বিস্তর সুযোগ। ডক ইয়ার্ড, অপসোনিন আর খানসন্স দখল করছে নদীর পাড় এলাকা। সরকারি উদ্যোগ এখানে কি পথ দেখাতে পারেনা? প্রয়োজন সিটি মেয়রের আন্তরিকতা ও উদ্যোগ।
অগভীর জলে হাঙরের সাঁতার কথাটা এখানেই প্রয়োজনীয় শব্দ। রাজনীতির বাইরের মানুষগুলো শুধু টাকা আর ক্ষমতার জোরে সংসদে যাবেন। আর রাজনৈতিক মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব করে শেষ হবেন। হবেন হাঙরের খাবার নয়তো সমাজে উপহাসের পাত্র। যেমনটা হয়েছেন বরিশালের বেশিরভাগ সাংবাদিক বন্ধুরা। চেয়ারম্যান ছবি হাওলাদার বা বরিশাল চেম্বার কমার্সের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু কেন সাংবাদিক দেখতে পারেন না! তা পরিষ্কার হলো দুইজন তেলবাজ চেয়ারম্যান এর আচরণে। এখানের সাংবাদিকদের কাছে এই তেলবাজ চেয়ারম্যান ভালো। কারণ গেলেই পকেটে কিছু দিতে চান তারা।
পরিশেষে বলছি দলীয় বা পেশীশক্তির আস্ফালন নয়, উন্নয়ন ও ভালোবাসা দিয়ে করুন বরিশাল কে জয়। বরিশালের মানুষ ভালোবাসার কাঙাল, ক্ষমতা বা টাকার নয়।