নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পুরস্কার প্রাপকের বিভিন্ন বই নানান ভাষায় অনুবাদ হতে দেখা যায়। দেখা যায়, বড় কোনও পুরস্কার তো নয়ই, এমনকী ছোটখাটো দেশীয় পুরস্কার না পেলেও কিংবা তেমন জনপ্রিয়তা না জুটলেও, মোটামুটি লিখতে পারলেই বহু লেখকের বই, অন্য ভাষায় না হলেও অন্তত ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম— গ্যাব্রিয়েলা মিস্তাল।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্মান পাওয়ার প্রায় এগারো বছর পরেও কেবল একটি ছোট্ট সংকলন ছাড়া তাঁর আর কোনও বইই ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি। শুধু তাই-ই নয়, তাঁর নিজের দেশীয় স্প্যানিস কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ সংকলনগুলোতেও, যেখানে সদ্য লিখতে আসা একদম তরুণ কবিদের কবিতাও ঠাঁই পায়, সেই সব সংকলনগুলিতেও তাঁর কোনও কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় না। আরও বিস্ময়ের কথা, বাস্ক ও আমেরিন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত এই কবির অনেক লেখাই আজও বিভিন্ন কাগজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গ্রন্থিত হয়নি। প্রামাণ্য রচনাবলি তো দূরের কথা। অথচ ১৯১৪ সালে তাঁর Sonetos de la Muerte বা মৃত্যুর সনেট নামক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাহিত্য জগতে হইচই পড়ে যায়। তখনই তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেন।
১৯৫৭ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি যখন দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগে মারা যান, তখনও তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রথম শ্রেণির দৈনিকগুলোতে তো নয়ই, অনেক সাহিত্য পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়নি। হয়নি কোনও শোকসভাও।
১৯৪৫ সালে প্রথম লাতিন আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও, নিজের দেশে এবং বিদেশে আর কোনও কবি বা লেখককে তাঁর মতো এমন ভাবে উপেক্ষিত হতে দেখা যায়নি।
তাঁর পুরো নাম ছিল— লুসিলা দে মারিয়া দেল পেরপেতুও সোকোরো গোদোয় আলকায়াগা। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলা মিস্তাল নামেই তিনি বেশি পরিচিত। না, তিনি শুধু একজন কবিই ছিলেন না, ছিলেন কূটনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং প্রথম সারির একজন নারীবাদী কর্মীও।
তবু ১৮৮৯ সালের ৭ এপ্রিলে জন্মগ্রহণ করা এই কবি কিন্তু নিজের নামে কবিতা প্রকাশ করতে রাজি হননি। কারণ তিনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন, তাঁর প্রেমিকের হঠাৎ আত্মহত্যার বেদনাতে কেন্দ্র করে।
এই সময় একটি কবিতা প্রতিযোগিতায় এই বিষয়ের ওপরেই তিনটি সনেট লিখে পাঠিয়ে দেন তিনি। তাঁর ভয় ছিল, এই রকম বিষয় নিয়ে কবিতা লেখার জন্য তাঁর অবৈতনিক বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রীর চাকরিটি খোয়া যেতে পারে। তাই তিনি ছদ্মনাম গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু কী নাম নেবেন তিনি? অনেক ভেবেও তেমন কোনও নাম ঠিক করতে না পেরে, অবশেষে তিনি তাঁর দুই প্রিয় লেখকের নাম থেকে বেছে নেন একটি করে শব্দ। একজনের নাম আর একজনের পদবি— এই নিয়ে তৈরি করে ফেললেন তাঁর নিজের নাম। ছদ্মনাম।
এ দু’জনের একজন হলেন ইতালির বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল দান্নুনৎসিও আর অন্য জন হলেন ফ্রান্সের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ফেডেরিক মিস্তাল। ফলে তিনি লেখা শুরু করলেন— গ্যাব্রিয়েলা মিস্তাল নামে।
বলতে বাধা নেই, দক্ষিণ আমেরিকার কবিতায় আধুনিকতার সূচনা যাঁদের হাতে, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম তিনি। কত কবি লেখক যে তাঁর কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার হিসেব নেই। স্বয়ং পাবলো নেরুদা পর্যন্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই মহিলা কবির কবিতা থেকে। অথচ তাঁর মতো উপেক্ষিত আর কাউকে হতে দেখা যায়নি।