চতুর্থ পর্ব – প্রেমে পড়েছি? না তাকে ভালোবেসেছি?
ভালোবাসা নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন `ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখ তোমার মনেরও মন্দিরে।’
তিনি এই ধরনের কথা বলেছিলেন কেননা আবেগধর্মী ভালোবাসা সাধারণত গভীর হয় এবং বিশেষ কারো সাথে নিজের সব অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া হয়। যার নামটি মনের মন্দিরে লিখে রাখা যায় মানুষ তাকেই ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসার জন্য আপনার কাছে মনে হতেই পারে পৃথিবী অনেক সুন্দর।
কাউকে ভালোবাসা আর কারো প্রতি প্রেমে পড়া আসলে এক বিষয় নয়। কাউকে ভালবাসা এবং কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া একই রকম অনুভূতি কিন্তু তার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান পার্থক্য রয়েছে।
কারো প্রতি প্রেমে পড়া বলতে বোঝায়, কারো মায়ায় পড়া, কাউকে নিজের করে কাছে পাওয়ার অনুভূতি এবং তাকে নিজের কাছে পাওয়ার এক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়া। আর কাউকে ভালোবাসা মানে শারীরিক সম্পর্ক উপেক্ষা করে কাছে পাওয়ার অনুভূতি।
ভালোবাসা এবং কারো প্রতি প্রেমে পড়া দুটো সম্পূর্ণ আলাদা অনুভূতি। আপনি সঙ্গীর যত্ন নিচ্ছেন কিন্তু তার প্রতি আপনার কোনো কামনা নেই। তার যত্ন নিচ্ছেন কিন্তু কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না, সঙ্গীর যত্ন নিচ্ছেন কিন্তু তার প্রতি আলাদা কোনো উত্তেজনা বোধ করছেন না। তাহলে বুঝবেন আপনি আপনার সঙ্গীকে ভালোবাসেন কিন্তু তার সঙ্গে আপনার কোনো প্রেমের সম্পর্কে নয়।
ভালোবাসা আর প্রেম। শব্দদুটোর মধ্যে আসলে পার্থক্য কোথায়?
আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? নাকি তাকে ভালোবেসেছি? প্রেমে পড়েছি এই ‘পড়েছি’ শব্দটির মধ্যেই কেমন যেন একটা আপত্তি থেকেই যায়। ‘পড়েছি ‘ শুনলেই আমার কেন জানি মনে হয় কোনো খাদে পড়েছি , তার চেয়ে ‘ভালোবেসেছি’ ‘শব্দটি কতো মধুর।
প্রেমে পড়েছি শব্দটির মধ্যে ‘তাৎক্ষনিক’ কিছু একটা শব্দ লুকিয়ে থাকা বোঝায়। অনেকেই ঝটপট প্রেমে পড়েন। কাউকে দেখে ভাল লাগল, ব্যস ঝুপ করে প্রেমে পড়ে গেল। কিম্বা কারো গান শুনে ভাল লাগল, অমনি দুহাতে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসলো।
কিছু কিছু পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায় তারা নারীদের বাহ্যিক সৌন্দর্যে ভীষণরকম আকৃষ্ট হন। তাই তারা অনায়াসে তাদের ‘প্রেমে পড়ে যান’।
আবার কিছু নারীর ক্ষেত্রে আভিজাত্য, ভাল চাকরি, গাড়ি, বাড়ি এসব দেখেও ঝুপ করে কোনো পুরুষের ‘প্রেমে পড়ে যান’।
অনেকের ক্ষেত্রে শারীরিক চাওয়া পাওয়ার অন্য নামই প্রেম আর একেই বলে প্রেমে পড়া। কারো ক্ষেত্রে টাকা পয়সা আভিজাত্যের অন্য নাম প্রেম , তাদের কাছে একেই বলে প্রেমে পড়া।
কারো কারো ক্ষেত্রে প্রেম মানে বিনিময় প্রথা বা লেনদেন। অর্থাৎ এর বিনিময়ে এটা পাওয়া যাবে। চাকরিতে পদোন্নতি, পরবর্তী সিনেমায় সুযোগ বা যে কোনো একটি কাজের সুযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর ভালোবাসা?
ভালোবাসার কোনো কারণ নেই। আমি তাকে ভালোবাসি, কারণ? তাকে ভালোবাসি বলেই ভালোবাসি।
ভালোবাসার কখনো মৃত্যু হয়না, ভালোবাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। ভালোবাসা কোনো দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা কোনো লেন দেন এর খেলা নয়। সে যেখানেই থাকুক তার জন্যে, তার পরিবারের জন্যে মন থেকে ভাল চাওয়া, তার সুস্থতা কামনা করা, একেই বলে ভালোবাসা।
কিন্তু যে বা যিনি বলেন ‘প্রেমে পড়েছি’, সে আবার ছেড়ে চলেও যেতে পারে। কারণ সেই মানুষটির প্রেমে পড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল। মানুষটি নারী বা পুরুষ যে কেউই হতে পারে।
তখন সেই চলে যাওয়া মানুষটির জন্যে হা হুতাশ করে জীবন শেষ করে দেওয়া বা সেই মানুষটির জন্যে হতাশার অন্ধকারে ডুবে না গিয়ে বরং মনে করে উচিত এই মানুষটি আমার যোগ্যই নয়; আর এই অযোগ্য মানুষটি জীবন থেকে চলে যাবার জন্যে ঈশ্বরকে বারবার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে নেই, ভালোবাসার জন্য আকুতি মিনতি করাও কিন্তু একরকম ভিক্ষা চাওয়ারাই নামান্তর।
শব্দদুটো ভীষণ কাছাকাছি, কিন্তু তবুও একটা পার্থক্যতো আছেই। ভালোবাসা মানুষের আবেগ অনুভূতির একটা স্বাভাবিক রূপ। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোলাগা, শ্রদ্ধাবোধ থেকেই মূলত ভালোবাসার উৎপত্তি। অবশ্য ভালোবাসার সংজ্ঞাটা আরো ব্যাপক, এটা যে কোন ঘটনা, ব্যক্তি, প্রাণী, স্মৃতি, বিষয় ইত্যাদির ব্যাপারেও হতে পারে। বিশেষ কোন ‘বিষয়’ এর ব্যাপারে মানুষের বিশেষ অনুভূতির নামই ভালোবাসা। সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য সেটা হলো, ভালোবাসা সাধারণত এক-তরফা হয়, তবে দু’তরফাও হতে পারে। যেমন কেউ আকাশ ভালোবাসেন, কিন্তু আকাশতো সেই মানুষটিকে ভালোবাসতে পারেনা, পারলেও শুধু সেই মানুষটিকে নির্দেশ করে সে (আকাশ) তার অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারছেনা বা পারেনা। একটা ব্যাপার হলো ভালোবাসলেই ঐ সম্পর্কে প্রেমের অবস্থান থাকবে এমন না, কিন্তু প্রেম করলে ঐ সম্পর্কে ভালোবাসার অবস্থান কিছুটা হলেও থাকবে। ভালোবাসা ছাড়া প্রেম হয়না এটা ঠিক। ভালোবাসাটা হলো প্রাথমিক অনুভূতি যেখানে চাওয়া-পাওয়া বলে কিছু থাকেনা। ‘ভালোবাসা’ শব্দটির অর্থ গভীর এবং বিশাল। সবাই ভালোবাসতে জানেনা। ভালোবাসি, এমনটা অনেক সময় মনে হয়। কিন্তু সেটাকে ভালোবাসা বলেনা। এটা ‘মোহ’। মোহ ক্ষনিকের, ভালোবাসা শাশ্বত, চিরস্থায়ী। ভালোবাসায় কোনও দেনা পাওনা থাকতে নেই। কোনও সংস্কার থাকতে নেই। যে জিনিষটিকে ভালোবাসেন তা যদি আপনার কাছ থেকে দুরে সরেও যায়, সত্যিকার ভালোবাসা কিন্তু তাকে ছেড়ে যায়না। তার মঙ্গলাকাঙ্খা দুর থেকেও আগলে রাখে তাকে। এই যেমন আকাশের কথাই ধরা যাক। রাতের আকাশ তো ঢেকে থাকে অন্ধকারে , দেখাই যায়না; তাই বলে কি আকাশকে ভালোবাসায় কোনও ঘাটতি পড়ে যায়? যায়না। অধরা, অদেখা রাতের আকাশকে আরো বেশি করে কি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না ?
আকাশ, বাতাস, চাঁদ, কবিতা, দেশ, পশু পাখি সবকিছুর প্রতিই ভালবাসা আসতে পারে এবং এই যে ভালোবাসা এর একটা আলাদা রূপ আছে, আলাদা ছন্দ আছে। সেই রূপ বা ছন্দটা হচ্ছে এই ভালোবাসার মধ্যে কোনো পাওয়া বা দাবির ব্যাপার নেই।
আর প্রেমের রূপ বা ছন্দ একেবারেই আলাদা। সবার সাথে কিন্তু প্রেম হয় না, বোধহয় হবেও না। প্রেমে দুজনের সম্মতির একটা রূপ থাকে। প্রেমের গভীরতা বা আবেদন আর ভালোবাসার গভীরতা বা আবেদন দুটো একেবারেই আলাদা। একজন মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতেই পারে, তবে তাকে প্রেম বলা যাবে না।
প্রেম তখনই হবে যখন বিষয়টি দু’দিক থেকেই আসবে। তবে অবশ্যই সেটা ভালোবাসা থেকে আলাদা। আমরা প্রচলিত অর্থে এর মাঝে একটা নৈকট্য বুঝি যার অধিকাংশটাই জুড়ে থাকে মন এবং শরীর দুটোই। এখানে ভালোবাসার চেয়েও আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে, সেটি হলো ‘আকর্ষন’। তাকে ভালোবাসা বলে ভুল করা অন্যায়।
ভালোবাসা আর প্রেম দু’টোকেই ঠিক ঠিক বুঝতে হলে চাই নিজেকে ভালভাবে জানা আর নির্মল উদার একটা হৃদয়। হতে পারে ব্যাপারটা এরকম যে সব প্রেমই ভালবাসা কিন্তু সব ভালবাসাই প্রেম নয়।
তবে মূল কথা হলো উদারতার দিক থেকে ভালবাসা বড়। প্রেম নয়। প্রেম অনেক সময় হারিয়ে যায় কিন্তু ভালোবাসা কখনোই হারিয়ে যায় না।
(চলবে)
প্রথম পর্ব প্রকাশিত ২২ মে ২০২১