আমেরিকা প্রবাসী ছেলের ফেসবুকে লেখার কারনেই কি খুলনায় মা গ্রেপ্তার?
যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি গবেষণারত একজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কারণে পুলিশ খুলনার একটি বাড়ি থেকে তার মা এবং আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ও জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৪ই অগাস্ট সোমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
পুলিশ বলছে, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা ‘জামায়াত-শিবিরের কর্মী’ এবং ‘রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তারা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নন।
বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এর আগেও বিদেশে অবস্থান করে সামাজিক মাধ্যমে সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে বাংলাদেশে থাকা পরিবারকে ‘হেনস্তা করার’ উদাহরণ রয়েছে।
খুলনায় যা ঘটেছে
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক তানজিলুর রহমান একটি ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেছেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজায় তার মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালির উপস্থিত হওয়া নিয়ে তিনি কয়েকদিন আগে একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন।
১৭ই অগাস্ট একটি ফেসবুক পোস্টে মি. রহমান লিখেছেন, ”দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে নানা হেনস্থার শিকার হওয়ার পরেও তিনি তার জানাজায় অংশ নিয়েছেন। যা প্রমাণ করে, তার ভাই বিসা বালির হত্যাকাণ্ডে সাঈদী জড়িত ছিলেন না।”
তার অভিযোগ, এরই জের ধরে গত রোববার দুপুরের দিকে খুলনায় হাজী ফয়েজউদ্দিন সড়কে তার নানা বাড়িতে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি হামলা করে এবং ভাংচুর করে, যারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত।
সে সময় তার মা আনিছা সিদ্দিকা এর প্রতিবাদ করায় পুলিশ তাকে ধরে খালিশপুর থানায় নিয়ে যায়। ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা দুজন শিক্ষার্থী এগিয়ে আসায় তাদেরও পুলিশ ধরে নিয়ে যায় বলে ফেসবুক পোস্টে তিনি দাবি করেছেন।
পরে সারা রাত আটকে রেখে ‘রাষ্ট্র বিরোধী গোপন বৈঠক’ করার অভিযোগ এনে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তানজিলুর রহমান।
‘’বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি আমার মা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। আজ আমার মা গ্রেফতার হয়েছে, কাল আপনার মাকে ধরে নিয়ে যেতেও পুলিশ দুই বার ভাববে না,” লিখেছেন তানজিলুর রহমান।
তানজিলুর রহমানের পিতা ও গ্রেপ্তার হওয়া আনিছা সিদ্দিকার স্বামী আলমগীর শিকদার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘’রোববার সকালে জানতে পারি, কারা যেন আনিছার বাবার বাড়িতে হামলা করেছে। সেই খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিল আমার স্ত্রী। ভাংচুরের প্রতিবাদ এবং পুলিশের সঙ্গে তর্ক করায় পুলিশ আনিছাকে আর মেসের দুজন ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পেরেছি, মামলা দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।‘’
পুলিশ কী বলছে?
লেখালেখির জের ধরেই আনিছা সিদ্দিকা এবং অন্য দুজনকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ অস্বীকার করছে খুলনার পুলিশ।
পুলিশের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গ্রেপ্তারকৃতরা জামায়াতে ইসলামী এবং শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। ‘রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের বৈঠক’ করায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
খুলনার খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুনীরুল গিয়াস বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে, ৫/১ হাজী ফয়েজউদ্দিন সড়কের বাসাটা জামাতের নায়েবে আমির সিদ্দিক হেলালের বাসা। সেই বাসায় জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা সমবেত হয়ে কোন ষড়যন্ত্রমূলক মিটিং করছে। এরকম তথ্যের ভিত্তিতে আমরা সেখানে অভিযান চালাই। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে কয়েকজন পালিয়ে যায় আর আমরা তিনজনকে আটক করতে সক্ষম হই।‘’
‘’দুইজন পুরুষের একজন ওয়ার্ড শিবিরের সভাপতি, একজন কর্মী আর মহিলা ১৬ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা জামাতের রোকন, এরকম তথ্য আমরা পেয়েছি। ওই বাড়িটি জামায়াতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণে মওদুদী সাহেবের বই, ধর্মীয় বই, জামায়াতে ইসলামীর প্রচারপত্র, ব্যানার-ফেস্টুন নথিপত্র, তিনটা ল্যাপটপ, চারটা মোবাইল ফোন জব্দ করি,‘’তিনি বলেন।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী কোন নিষিদ্ধ দল নয়, রাজনৈতিক দল হিসাবে কিছুদিন আগেই তারা ঢাকায় একটি বড় ধরনের সমাবেশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে ওসি মুনীরুল গিয়াস বলছেন, ‘’জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ দল না হলেও যে উদ্দেশ্যে সেখানে মিটিং হচ্ছিল, সেটা ছিল নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড। আমরা তো গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অনেক অভিযান পরিচালনা করি। অন্তর্ঘাতমূলক কোন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য ওখানে মিটিংয়ে বসেছিল তারা, এমন তথ্য পেয়েছি আমরা। ‘’
লেখালেখির কারণে মা এবং অন্য দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এই বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘’আমাদের বিরুদ্ধে এরকম কথা তার বলছে, কিন্তু ওনার ছেলে কবে কোথায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এটা আমাদের নলেজে আদৌ ছিল না। গতকাল আমরা জেনেছি, তার ছেলে আমেরিকায় থাকে, তিনি একটা বিষয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। কিন্তু আমরা অভিযান চালিয়েছি তার আগের দিন।‘’
অতীতের কিছু ঘটনা
প্রবাসে থেকে লেখালেখি বা মতপ্রকাশের পর দেশে থাকা পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা, হুমকি বা হেনস্থার অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। এর আগে একাধিকবার এসব অভিযোগ উঠেছে।
খুলনার এই ঘটনার সাখে আগের অতীতের কিছু ঘটনার মিল দেখতে পাচ্ছেন অধিকার কর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক কনক সরওয়ার ২০২১ সালের অক্টোবরে অভিযোগ করেছিলেন, তিনি বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেন বলেই তার বোনকে হেনস্থা করা হচ্ছে।
মি. সরওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে র্যাব আটক করেছিল এবং তখন দাবি করা হয়েছিল যে তার কাছ থেকে মাদক পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়।
নুসরাত শাহরিন রাকাকে আটকের পর তখন র্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছিল যে তিনি ‘রাষ্ট্র বিরোধী অপপ্রচারকারী ও ষড়যন্ত্রকারী চক্রের’ একজন সক্রিয় সদস্য।
এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী তাসনিম খলিল অভিযোগ করেছিলেন, তার লেখালেখির কারণে বাংলাদেশে একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তার মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে ‘ভয়ভীতি প্রদর্শন’ করেছেন।
এছাড়া ২০২০ সালে ফ্রান্সে থাকা অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য অভিযোগ করেছিলেন, বগুড়ায় তার বৃদ্ধ মা এবং মামাকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
হেনস্তা করাই ছিল উদ্দেশ্য?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন। এই সংগঠনের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ফারুক ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, অন্য ঘটনাগুলোর সাথে তিনি খুলনার ঘটনার মিল দেখতে পাচ্ছেন।
“বাংলাদেশের সব নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার আছে। সেটা সরকারের পছন্দ না হতে পারে। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী মারা গেছেন, হয়তো কেউ কেউ তাতে দুঃখিত হয়েছেন, সেই দুঃখ পাওয়ার বা প্রকাশ করার অধিকার তাদের আছে,” বলেন মি. ফয়সাল।
‘তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, প্রতিটা নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারের কথা, চিন্তার অধিকারের কথা বলা আছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অতীতেও লেখালেখির জের ধরে দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের আটকের পর মাদক, রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। যদিও পরবর্তীতে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হতে দেখা যায় না। এসব ঘটনা হেনস্তা করার উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে বলে তারা মনে করছেন।
মানবাধিকার সংগঠন নূর খান লিটন বলছেন, ‘’এখন পর্যন্ত দেশে ধারাবাহিকভাবে যেসব ঘটনাগুলো ঘটে চলছে, এটা প্রথম বা শেষ বলার সুযোগ নেই। খুলনার খালিশপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তার সন্তান ফেসবুকে হয়তো কিছু মন্তব্য করেছেন, সেই কারণে দেশে থাকা তার বৃদ্ধা মাকে আটক করা বা জিজ্ঞাসাবাদ করার মতো আইনগত কোন সুযোগ নেই।‘’
‘’দেশের বাইরে থেকে কেউ মন্তব্য করা বা দেশের ভেতর বসেও কেউ মন্তব্য করলে তার আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের আটক করা- সেটা আইনের চোখে একেবারে অচল। পুলিশ হয়তো জাস্টিফাই করার জন্য এক ধরনের ব্যাখ্যা দিতে পারে, কিন্তু এরকম ব্যাখ্যার গ্রহণযোগ্যতা নেই,‘’ বলছেন মি. খান।
সূত্র: বিবিসি বাংলা