বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হারানোর শোকাবহ দিন
যার ডাকে মুক্তিকামী বাংলাদেশের মানুষ দেশমাতৃকার জন্য পাকিস্তানিদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে পরোয়া করেনি, ৩০ লাখ বাঙালির জীবনের বিনিময়ে এনেছিল স্বাধীন দেশ; ইতিহাসের সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সেই দিন ফিরে এল অতল বেদনার আবহে।
কৃষক-শ্রমিক আর মেহনতি মানুষ প্রাণের বিনিময়ে সবচেয়ে কম সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পেয়েছিল মুক্ত মানচিত্র, পাকিস্তানের কারাগার থেকে জাতির পিতার প্রত্যাবর্তনে সেই স্বাধীনতা হয়েছিল অর্থবহ। কিন্তু দেশ পুনর্গঠনের নতুন সংগ্রামের মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যা করে দেশের উল্টোযাত্রার সূচনা করেছিল ঘাতকরা।
বেদনাবিধুর শোকের আবহে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ৪৮তম শাহাদাৎবার্ষিকী পালন করছে বাঙালি জাতি।
স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।
তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি।
জাতীয় এই শোকের দিনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে, পালিত হবে নানা কর্মসূচি। পাড়ায়-মহল্লায় ভেসে বেড়াবে জাতির পিতার সেই বজ্রকণ্ঠ, “ভাইয়েরা আমার…”
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি।
এরপর বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ছেষট্টির ছয় দফা প্রণয়নে শেখ মুজিবকে দেখা যায় নেতৃত্বের ভূমিকায়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করলে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা।
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। তার সেই ডাকে বাঙালির রক্তাক্ত সংগ্রামে অভ্যূদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ এর ওই ঘটনার দুই দশকের বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত সেই বঙ্গবন্ধুই থেকে যান অগোচরে, উপেক্ষিত থেকে যায় তার নীতি-আদর্শ। বিকৃত করা হয় ইতিহাস।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর ১৫ অগাস্টকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের পাঁচ বছরে আবারও বাতিল করা হয় সেই শোকের দিবস। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হাই কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সাল থেকে দিনটি আবার জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।
৪৮ বছর আগে সেই রাতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ছাড়াও স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে।
সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকট আত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।
ধানমণ্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাসের নৃশংসতম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচার শুরু হয়। তবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার বিচার চূড়ান্তভাবে শেষ করার পর ২০১০ সালে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০২০ সালে ফাঁসি হয় আরেক খনি আবদুল মাজেদের।
অন্য আসামিদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডায় আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকারের সাড়া মেলেনি।
আরেক আসামি মোসলেম উদ্দিন পাকিস্তানে আছেন বলে তথ্য ছিল ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) কাছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও পাকিস্তান কোনো জবাব দেয়নি। আর রশিদ ও ডালিম এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনও জানতে পারেনি সরকার।
শোক দিবসের আগে দিন সোমবার এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনীদের মধ্যে দুই জনের অবস্থান জানা থাকলেও বাকিদের কোনো খোঁজ নেই। অগ্রগতি নেই যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক খুনি রাশেদ চৌধুরী ও কানাডায় পলাতক খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে।
খুনিদের তথ্য দিয়ে তাদের খুঁজে পেতে সহায়তা করলে সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়া হবে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।