ভারতের হরিয়ানায় যেভাবে হামলা চালানো হয় মন্দির ও মসজিদে
থানা চত্বরে দাঁড়িয়ে শাদাব আনোয়ার মোবাইলে তার ২২ বছরের ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে বলছিলেন, “মঙ্গলবার বিহারে দেশের বাড়ি যাওয়ার টিকিট কাটা ছিল ভাইয়ের।“
মি. আনোয়ারের ভাইয়ের দেহ তখন মর্গে, ময়না তদন্তের অপেক্ষায়। দিল্লি লাগোয়া গুরগাঁও শহরে যে মসজিদের নায়েব ইমামকে দাঙ্গাকারীরা মঙ্গলবার রাতে মেরে ফেলেছে, সেই মুহম্মদ শাদ-ই মি. আনোয়ারের ভাই।
“যদি মসজিদের সঙ্গে কারও শত্রুতা থেকেই থাকে, তাহলে ওকে কেন মারল? ও তো চাকরি করছিল এখানে,” কান্না ভেজা গলায় বলছিলেন শাদাব আনোয়ার।
গুরগাঁওয়ের সেক্টর ৫৭তে অবস্থিত মসজিদের হামলার আগের দিনই নূহ্ জেলার নলহরে মহাদেব মন্দিরের সামনে দাঙ্গায় নিজের চাচাতো ভাই অভিষেককে চোখের সামনে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেছেন আদতে হরিয়ানারই পানিপথ শহরের বাসিন্দা মহেশ কুমার।
তারা দুই ভাই নলহরে এসেছিলেন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দল আয়োজিত ‘জলাভিষেক যাত্রা’য় অংশ নিতে।
“চারদিক থেকে গুলি চলছিল। মন্দিরের ঠিক বাইরে অভিষেকের বুকে একটা গুলি এসে লাগে। ও সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে পড়ে যায়। ওকে তুলতে পারি নি,” বিবিসিকে বলছিলেন মি. কুমার।
হরিয়ানায় গত সোমবার থেকে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত ছয় জনের মধ্যে অন্যতম মুহম্মদ শাদ আর অভিষেক। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন দুজন পুলিশ হোমগার্ডও। গুলি, পাথর বা ছোরার আঘাত নিয়ে বহু মানুষ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলছেন ১১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পলাতকদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।
মসজিদে হামলার প্রত্যক্ষদর্শীরা
গুরগাঁওয়ের যে মসজিদটিতে হামলা হয়েছে মঙ্গলবার মাঝরাতে, সেখানে গেলে বোঝার উপায় নেই যে আগের রাতে কী নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল মুহম্মদ শাদকে।
ওই মসজিদের কাছে গিয়ে বিবিসির সংবাদদাতা জুবেইর আহমেদের চোখে পড়ে মসজিদের নিরাপত্তার জন্য একদল পুলিশের উপস্থিতি ছাড়া বাকি সব কিছুই যেন স্বাভাবিক। আশপাশে গগনচুম্বী আবাসিক ভবন আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ঝাঁ চকচকে দপ্তর। দোকান বাজার খোলা, যান চলাচলও স্বাভাবিক।
সেক্টর ৫৬ থানায় গিয়ে ঘটনার তিন প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে পায় বিবিসি।
থানার ভেতরে একটি ঘরে তারা শুয়ে ছিলেন। দেখে মনে হয় যে পুলিশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
ওই তিনজনের অন্যতম মি. শাহাবুদ্দিন বলছিলেন হামলার রাতে তিনি মসজিদের ভেতরেই ঘুমিয়ে ছিলেন। হামলার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় আর তিনি দেখেন যে নায়েব ইমাম মি. শাদকে মারধর করা হচ্ছে।
তার কথায়, “অনেক লোক এসেছিল। আগুন ধরিয়ে দেয় তারা, গুলি চলে। আমি ভেতরের দিকে ছিলাম, তাই হামলাকারীদের চিনতে পারি নি।“
নূহ্ জেলায় হিন্দুদের ওপরে হামলা হওয়ার পরে যে এই মসজিদে হামলা হতে পারে, সেই আশঙ্কা করে সোমবার বিকেল চারটে থেকে পুলিশ পাহারা বসানো হয়।
এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, মাত্র নয়জন পুলিশ কর্মী মসজিদের পাহারায় ছিলেন, আর হামলাকারীদের সংখ্যা ছিল প্রায় একশো। তাই পুলিশের বিশেষ কিছু করার ছিল না।
তবে নায়েব ইমামের এক সহকারী বলছেন, পুলিশ চাইলে হামলাকারীদের মোকাবিলা করতে পারত।
“নায়েব ইমামের ওপরে ছোরা আর তলোয়ার নিয়ে হামলা হয়েছে। গুলিও চলে তাকে লক্ষ্য করে। তার শরীরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। তখনই পুলিশ তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে চলে যায়,” জানাচ্ছিলেন মি. শাহাবুদ্দিন।
মসজিদটি নিয়ে আগে থেকেই আপত্তি ছিল পার্শ্ববর্তী টিগরা গ্রামের হিন্দু বাসিন্দাদের।
গ্রামের বিজেপি নেতা মি. সচিন বিবিসিকে বলছিলেন, “আমাদের এই সেক্টর ৫৭-র টিগরা গ্রামে হিন্দুরাই বাস করেন। এখানে কোনও মুসলমান নেই। যেখানে কোনও মুসলমান পরিবার থাকে না, সেখানে মসজিদ কেন থাকবে?”
মন্দিরে আশ্রয় নিয়েও বাঁচেন নি অভিষেক
পানিপথের বাসিন্দা মহেশ কুমার আর তার ভাই অভিষেক আট-নয় মাস আগে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলে যোগ দিয়েছিলেন।
দলের হয়েই নলহরে ‘জলাভিষেক যাত্রা’য় যোগ দিতে এসেছিলেন তারা।
বিবিসি সংবাদদাতা অভিনব গোয়েলের সঙ্গে কথা বলার সময়ে মহেশ কুমার বলছিলেন, “কয়েক হাজার মানুষ যাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন। নারী আর শিশুরাও অনেকে ছিলেন। নলহর শিব মন্দির থেকে যাত্রা শুরু করে দুই কি তিন কিলোমিটার যাওয়ার পরেই পাথর ছোঁড়া হতে থাকে।
“তখনও অভিষেক আমার পাশেই ছিল। আমরা কোনমতে পালিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা হয় মন্দিরের বাইরে। সেখানে যেসব গাড়ি দাঁড়িয়েছিল, সেগুলোতে আগুন লাগানো শুরু হল। এরপর চারদিক থেকে গুলি চলা শুরু হল,” জানাচ্ছিলেন মি. কুমার।
তখনই একটা গুলি ছুটে এসে মি. অভিষেকের বুকে লাগে।
মাটিতে পড়ে যেতে মি. মহেশ কুমার ভাইকে তোলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন, এমনটাই বিবিসির অভিনব গোয়েলকে জানিয়েছেন মি. কুমারদের আরেক সঙ্গী মি. অনুপ।
ওই মন্দিরের পূজারি দীপক শর্মা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “বাইরে যখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল, সেই সময়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ মন্দিরের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাইরে গুলিগোলা চলছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ পুলিশ এসে সবাইকে বার করে নিয়ে যায়। তারপরে আর গণ্ডগোল হয় নি।“
দাঙ্গায় মনু মানেসরের নাম কেন আসছে?
গুরগাঁও আর নুল্হরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মনু মানেসর নামে এক হিন্দুত্ববাদী নেতার নাম উঠে আসছে।
মি. মানেসরের আসল নাম মোহিত যাদব। তিনি নিজেকে বজরং দলের গোরক্ষক বাহিনীর নেতা বলে দাবি করেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে গরু পাচার করার সন্দেহে দুই মুসলিম, রাজস্থানের বাসিন্দা জুনেইদ এবং নাসিরকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেন মনু মানেসর আর তার সঙ্গীরা।
এবছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জুনেইদ এবং নাসিরের জ্বলে যাওয়া মৃতদেহ পাওয়া যায় হরিয়ানার ভিওয়ানিতে।
তাকে কখনই গ্রেপ্তার করা যায় নি।
নুল্হরের যে ‘জলাভিষেক যাত্রা’ থেকে অশান্তির শুরু তার আগে সামাজিক মাধ্যমে মনু মানেসর বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে দেন। সেখানে সাধারণ মানুষকে ওই যাত্রায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ‘জলাভিষেক যাত্রা’য় তিনি নিজেও থাকবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন।
ওই যাত্রায় মনু মানেসর আর তার সঙ্গীদের যোগ দেওয়া নিয়েই নূহ্ মুসলমানদের আপত্তি ছিল।
বুধবার হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলেছেন, “মনু মানেসরের বিরুদ্ধে আগের মামলাটা দায়ের করেছিল রাজস্থান সরকার। আমরা তাদের জানিয়েছি এ ব্যাপারে যা সহায়তা দরকার, তা করা হবে। রাজস্থান পুলিশ তাকে খুঁজছে, কিন্তু আমাদের কাছে কোনও খবর নেই যে তিনি কোথায় আছেন।“
সংবাদ সংস্থা এএনআই বলছে, মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, সেটা রাজস্থানের পুরনো মামলাটির বিষয়ে, এর সঙ্গে নূহ্-র দাঙ্গার কোনও সম্পর্ক নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা