১০০ বছরে পা দিল নজরুলের কবিতা- ‘বিদ্রোহী’
এ বছরই কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি শততম বর্ষে পদার্পণ করল। ইতিমধ্যেই এই ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নজরুলের অনুগামীরা সারা পৃথিবী জুড়ে বর্ষব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের কলকাতার মৌলালি অঞ্চলের কাছে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে বসেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র বাইশ বছর আট মাস বয়সেই লিখে ফেলেন এই কালজয়ী কবিতা।
কবিতাটির প্রথম শ্রোতা ছিলেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফফর আহমদ। এই কবিতাটি প্রসঙ্গে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, কবিতাটি শুনে আমি কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনি। তাতে নজরুল মনে মনে আহত হয়েছিল নিশ্চয়। আমার মনে হয়, নজরুল হয়তো শেষ রাত্রে কিংবা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে অত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।
তিনি আরও জানিয়েছেন, নজরুল সম্ভবত প্রথমে কবিতাটি পেনসিলে লিখেছিল। নজরুল সাধারণত দোয়াত-কলমে কবিতা লিখত। দোয়াতের কালিতে বার বার কলমের নিব চুবিয়ে সে কবিতা, গল্প, গান লিখত। কিন্তু এই কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাটি ও লিখেছিল পেনসিল দিয়ে।
কবিতা লেখার জোশ একেবারে পরিপূর্ণ ধরে রাখার জন্যই নজরুল হয়তো পেনসিল ব্যবহার করেছিলেন। বার বার দোয়াতে কলম চুবিয়ে লিখতে গেলে জোশ হারিয়ে যাবে, কবিতার সুর-তাল কেটে যাবে, খেই হারিয়ে যেতে পারে, সম্ভবত এই আশঙ্কা থেকেই নজরুল পেনসিল দিয়ে কবিতাটি লেখেছিলেন।
মাত্রাবৃত্ত মুক্তকছন্দে এই কবিতাটি লিখে নজরুল দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। কবিতাটি প্রথমে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, মানে বাংলার ২২ পৌষ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দে।
যদিও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য ওই পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হককে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘মোসলেম ভারত’-এর সেই সংখ্যাটি বেরোতে নানান কারণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
কবিতাটি প্রকাশ হওয়া মাত্রই এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, একই সপ্তাহে প্রকাশককে পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হয়। দু’বার মিলিয়ে সেই সংখ্যাটি ঊনত্রিশ হাজার কপি ছাপতে হয়েছিল। সে সময়ে এই বিপুল সংখ্যক পত্রিকা লেটার প্রেসে ছাপানো ছিল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং অভাবনীয় কাণ্ড। এর পরে মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (১৩২৮ বঙ্গাব্দ) ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবার ছাপা হয়।
একই বছরে এটি মাসিক ‘প্রবাসী’ এবং মাসিক ‘বসুমতী’ এবং পরের বছর (১৩২৯ বঙ্গাব্দ) মাসিক ‘সাধনা’য় আবার ছাপা হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এই বারবার পুনর্মুদ্রণই প্রমাণ করে দেয় কবিতাটির তুমুল জনপ্রিয়তা।
১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় এই ‘বিদ্রোহী’টি আরও বারোটি কবিতার সঙ্গে স্থান পায়। ‘অগ্নিবীণা’ এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে, প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন অনেকেই। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন— ‘অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মনপ্রাণ যা কামনা করছিল এ যেন তাই; দেশব্যাপী উদ্দীপনার এই যেন বাণী’।
প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন— ‘এ কবিতা যে বাংলাদেশকে মাতিয়ে দেবে তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে’।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন— ‘একে নতুন কবি? নির্জীব দেশে একার বীর্যবাণী?… আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ ঊর্ধ্ব মেরুদণ্ডে দাঁড়াল।’
নজরুল নিজেও উৎসুক হয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন! কবিতাটি শুনে রবীন্দ্রনাথ শুধু মুগ্ধই হননি, ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলেন।
কিন্তু বিদ্রোহী কবিতাটি ভীষণ ভাবে জ্বালা ধরিয়েছিল নজরুল-বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে। তাই ওই চক্রটি নজরুলকে তো বটেই, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকেও কাটাছেঁড়া করেছিলেন।
ওই সময় ‘শনিবারের চিঠি’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় নজরুলকে ব্যঙ্গ করে বেশ কয়েক জনের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি ছাপা হয়েছিল। সজনীকান্ত দাসের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি— ‘আমি ব্যাঙ / লম্বা আমার ঠ্যাং / আমি ব্যাঙ / আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই / আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।’
এমনকী, কবি গোলাম মোস্তফাও তাঁর ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামের কবিতায় কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাটিকে আঘাত হানার চেষ্টা করেছেন এ ভাবে— ‘ওগো ‘বিদ্রোহী’ বীর! / সংযত কর, সংহত কর উন্নত তব শির / তুই যদি ভাই বলিস চেচিয়ে— উন্নত মম শির, / আমি বিদ্রোহী বীর, / সে যে শুধুই প্রলাপ, শুধুই খেয়াল, নাই নাই / তার কোন গুণ, / শুনি স্তম্ভিত হবে ‘নমরুদ’ আর ‘ফেরাউন’!’
কিন্তু সজনীকান্ত, গোলাম মোস্তফার মতো নজরুল বিরোধীরা বহু চেষ্টা করেও নজরুলের ‘বিদ্রোহ’ কবিতাটির জনপ্রিয়তা সামান্যতমও খর্ব করতে পারেননি। নজরুলের কাঠ পেনসিলে লেখা কালজয়ী সেই বিদ্রোহী কবিতাটি আজও চির উন্নত মম শির হয়ে আছে।
আজও সেই কবিতাটি লোকের মুখে মুখে ঘোরে। আবৃত্তি করার জন্য বাচিকশিল্পীরা যে গুটিকতক কবিতাকে সবার উপরে রাখেন, তার মধ্যে অন্যতম হল এই বিদ্রোহী কবিতা।
সেই কবিতাটিরই শতবর্ষ উদযাপন খুব ঘটা করে শুরু হয়ে গেল এ বছর।