হস্টেল থেকে মা-কে
আঁকার ক্লাসের বাইরে ঠিক দাঁড়িয়ে আছো তুমি,
চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পাই!
আর সেই বিছানার এক কোণে পড়ে থাকা
জ্বরজ্বর কয়েকটি মাস
তুমিই ছিলে ছায়াতরু।
রাতের পর রাত ছিলে
কঠোর প্রহরায়।
কিংবা যেদিন স্কুল-ফেরত
রক্তফুল ফুটে উঠল আমার গোপন পৃথিবীতে,
তুমিই হয়ে উঠেছিলে শুশ্রূষার একান্ত চাবিকাঠি,
হাতে ধরে চিনিয়েছিলে নতুনতর জীবন!
তুমি ঠিক কোন রঙের সুতোয় বোনা, মা?
আমরা তো আটপৌরে সুতো আর কাঁচা রঙেই বোনা!
সহজেই ময়লা ধরে আমাদের গায়, আর রঙও
উঠে যেতে চায়। বারংবার সাবান-কাচা হয়েও,
গরম ইস্ত্রির নীচে বুক পেতে দিয়ে তবেই কোনওক্রমে
ঝলমলে থাকি!
তোমার তো কিছুই লাগেনা এসব….
তুমি ঠিক কোন রঙের সুতোয় বোনা মা?
এবারের জন্মদিন তো কেটেই গেল হস্টেলে!
একা বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি।
বই নয়, বন্ধুরাও নয়, সত্যিই তুমি ছাড়া কেউ নেই কাছে!
চুপিচুপি বলি,
সামনের জন্মদিনে কিন্তু পায়েস খেতে চাইব না তোমার কাছে।
তুমি শুধু পাশে বসিয়ে
তোমার পাতের অন্ন নিজ হাতে
পেট পুরে খাইয়ে দিয়ো আমাকে!
দেবে তো?
সার্থকতা
পাথরের সঙ্গে পাথর ঘষে
আগুন জ্বালিয়েছিলাম একদিন। তারপর
সেই আগুনে
তীর-ধনুক দিয়ে মারা বন্য পশুকে ঝলসে
তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছি
গুহার ভেতর।
বাকলের আচ্ছাদন সরিয়ে
পৃথিবীতে এনেছি নতুন প্রাণের স্পন্দন।
তলোয়ার উঁচিয়ে যুদ্ধে গেছি ঘোড়ায় চড়ে।
হেঁটে হেঁটে উঠেও গেছি দুর্গম পর্বতশৃঙ্গে।
আর আজকাল তো ককপিট থেকে নেমে এসে
শুশ্রূষায় জড়িয়ে রাখি তোমাদের!
দেশ চালানোর গুরুভার কাঁধে নিয়ে
বনমায়া হরিণীর মত ছুটতে ছুটতে,
এই নারীজন্ম শুধু একবার
কোনো এক মুজিবের বঙ্গে
গুলিবিদ্ধ হতে চায়!
পাথরের গল্প
যে কোনো মুহূর্তেই শুরু করতে পারি….
অঞ্জলি দিতে এগিয়ে রাখা হাতদুটির ওপর
তলোয়ারের কোপ এসে পড়েছিল।
রক্ত নয়,
সেদিন পাথর ঝরেছিল শুধু!
বুক চিরে চিরে তোমাদের বসাতে চেয়েছি
চিরকালীন আসনে। তুমি তো আসোনি,
ঘূর্ণি বাতাস তছনছ করে দিয়ে গেছে
রঙিন জানালা! আর পাথর,
পাথর ঝরেছে খুব।
এসব ভুলেই কি গেয়ে উঠব গান?
এই অন্ধ রাত্রি আর শিকড়-ছেঁড়া জীবন
যদি মুক্তি পায়! দেখি, একটি তীক্ষ্ণ বর্শা
অব্যর্থ নেমে আসছে আমার কণ্ঠ লক্ষ করে…
পাথর, পাথর…
যে কোনো মুহূর্তেই শুরু করতে পারি
এইসব পাথর সজোরে ছুঁড়তে থাকা,
ঠিক বিপরীত দিকেই, হ্যাঁ
ঠিকঠাক বিপরীতে!
বেহুলা
তখন সে বুঝলো, ভয় করে ভুল করেছে সে!
যেমন ঝড় এলেই,
সে লুকিয়ে পড়তো বন্ধ ঘরে।
আর জীবনের পদক্ষেপ ভুল হলে
সারাজীবন ধরে তার মাসুল গুণতে হয়!
পথ যখন দিশেহারা
নদীতেই ভেসে যাক জীবনের ভেলা
বাবা
মধ্য রাত্রির অনন্ত জিজ্ঞাসার মতন
অবাক করা ছন্দ যেন বাবা!
ঘন মেঘে বৃষ্টি নামলে,
ইচ্ছেরা মনের ভেতর বাসা বাঁধে।
বাবা বলেন, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
শান্তি আর সুখের স্মারক খুঁজতে থাকো।
কিংবা রঙিন চিরকুট উড়িয়ে দাও
দুঃসহ জ্বালা-ধরা
শিশুদের আর্তনাদে!
নীলাভ আকাশ, সবুজ শস্যখেত, পাখির গান
আর নদীর কলতান যেন বাবা।
কিংবা নিঃশব্দ দুস্তর পথ, আরাধনা
জলছবি, আর সম্প্রীতির গানও যেন বাবা!
শুধুই এগুলিকে সঙ্গে করে পথ চলা,
বাবারই সাথে…
দোলনা
আমার বিকেলগুলি দুলে ওঠে অস্থির দোলনায়…
মনে হয়, যেন কোটি কোটি বছর ধরে,
এভাবেই দুলতে থাকা,
আর এই দোলনা-যাপনে অনুচ্চারিত বর্ণমালার
জীবনস্রোতে ভাসা।
দোলনা ভাসিয়ে নিয়ে যায় রক্তিম আকাশে,
আবার ফিরিয়ে আনে সান্ধ্যকালীন শূন্যতায়!
চেয়ে চেয়ে দেখি– কীভাবে
দূর চলে আসে নিকটে, নিকট চলে যায় বহুদূর
দোলনা উড়িয়ে নিয়ে যায়
শ্রাবণ মেঘের ঘনঘোরে,
তার বিদ্যুৎ ছোঁয়ার আগেই
ফিরিয়ে আনে ঘাসের রেখায় রেখায়,
যেখানে পা ফেলতেও ভয়, ওদের সঙ্গে
নিজেই কুঁকড়ে যাই অসীম যন্ত্রণায়।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মুক্ত চূড়ায় ডানা রাখার আগেই
দোলনা ফিরিয়ে আনে শর্তহীন আত্মসমর্পণে…
জীবন দুলতে থাকে অদৃশ্য কোনো দোলনায়
দারুন