অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে ‘পশ্চিম দিকে’ মুখ ফেরাচ্ছেন এরদোয়ান
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে এ সপ্তাহেই একটা বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
যে সুইডেনকে নেটোর সদস্যপদ দেবার বিরোধিতা করছিলেন তিনি মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও – সেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানই গত সোমবার আচমকা ঘোষণা করেন তিনি এই সামরিক জোটে সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তার দীর্ঘকালের আপত্তি তুলে নিচ্ছেন। তার এই ঘোষণায় তার নেটো মিত্ররাই অবাক হয়ে যান।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের এই দ্রুত কৌশল পরিবর্তন, এমন এক সময়ে ঘটলো যখন তিনি তার দেশের দীর্ঘ এবং ক্রমাবনতিশীল অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজছেন।
মি. এরদোয়ান অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলেন যে সুইডেন, তার ভাষায়, সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না এবং সে জন্যই লিথুয়ানিয়ায় নেটো সম্মেলনে আসার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও তিনি স্টকহোমের সমালোচনা করেছিলেন।
তার এই দিক পরিবর্তন থেকে বোঝা যায়, তুরস্কের নতুন পুননির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এখন পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক মেরামত করতে কতটা ব্যগ্র। তুরস্কের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য গত কয়েক বছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুরস্ককে পরিত্যাগ করেছিল, কিন্তু এরদোয়ান চাইছেন এই বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে।
“এই হচ্ছে ‘ক্লাসিক’ এরদোয়ান, যেখানে নীতি বা কথার সুর অকস্মাৎ বদলে যেতে পারে – কোন পূর্বাভাস ছাড়াই” বলছেন বাতু কোসকুন, আংকারা-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাদিক ইনস্টিটিউটের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
“এরকম একটা ইউ-টার্ন নিলে অন্য যে কোন রাজনৈতিক নেতাকে ভুগতে হতো, কিন্তু এরদোয়ানে কোন সমস্যাই হচ্ছে না।“
এর কারণ হলো – তার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের প্রতিদান হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, নেটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন – সবার কাছ থেকেই কিছু অঙ্গীকার আদায় করে নিয়েছেন।
তুরস্ক এখন আশা করছে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অচিরেই এফ-১৬ জেটবিমানের চালান পাবে -যার জন্য তারা বহুকাল ধরে প্রতীক্ষায় ছিল।
মি. এরদোয়ান বলছেন, বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে তুরস্কের যোগদান এবং ভিসা উদারীকরণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি – এ দুটি প্রশ্নে ব্রাসেলস এখন ‘ইতিবাচক মনোভাব’ দেখাচ্ছে।
তবে এত দ্রুতগতিতে মি. এরদোয়ান তার অবস্থান পরিবর্তন করাকে দেখা হচ্ছে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে – যে তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান মিত্রদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গী নিচ্ছেন। তার এই মিত্ররা অনেক দিন ধরেই উদ্বিগ্ন ছিল যে তুরস্কে গণতন্ত্র ক্রমশঃ পেছন দিকে যাচ্ছে।
নেটো শীর্ষ সম্মেলনে এরদোয়ানের ফটো-অপ ছিল অনেকগুলো। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের সাথে ছবি তুলেছেন তিনি।
বেশ কয়েক বছর কিছুটা দূরে দূরে থাকার পর এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও মি. এরদোয়ানের সাথে তার বৈঠকটিকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন।
“আমার মনে হচ্ছে, নির্বাচনের পর মি. এরদোয়ান এখন অপেক্ষঅকৃত আত্মবিশ্বাসী বোধ করছেন – বিশেষত রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্ব উভয়ের সাথেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে, “ বলছেন বাতু কোসকুন।
বাইরে আত্মবিশ্বাসী দেখালেও দেশের ভেতরে এখন এরদোয়ানের জন্য জরুরি চ্যালেঞ্জ হলো তুরস্কের নেতিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। গত মে মাসের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত তুরস্কের নির্বাচনের ঐতিহাসিক দ্বিতীয় রাউন্ডে মি. এরদোয়ানের বিজয়ের সময় এটা ছিল সবচেয়ে বড় ইস্যু।
“ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়,” বলছেন বুরহান মরকজ, একজন রুটি প্রস্তুতকারক যিনি দিনে ১৭ ঘন্টা রুটি বানানোর চুলোর সামনে কাজ করেন।
“সমস্ত জিনিসের দাম এত বেড়ে গেছে … যেসব লোক দুটো রুটি কিনতো, তারা এখন কিনছে একটা। চাহিদা কমে গেছে।“
এর কারণ মুদ্রাস্ফীতি। ২০২২ সালের অক্টোবরে মুদ্রাস্ফীতি উঠেছিল ৮৫.৫ শতাংশে। এখন সেটা কমে ঠিক ৪০%-র নিচে ঘোরাফেরা করছে।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার মুল্যমান রেকর্ড পরিমাণ নেমে গেছে।
সারা দুনিয়াতেই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অর্থনীতির এসব গোঁড়ামিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তার কথা হলো, সুদহার বাড়িয়ে দিলে জিনিসপত্রের দাম আরো বেড়ে যাবে। তার পরিবর্তে তিনি তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন যেন তারা সুদের হার অর্থাৎ ব্যাংক থেকে ঋণ নেবার খরচ কম রাখে।
ইস্তুাম্বুলের এই কাদিকোই এলাকায় বুরহান মরকজ তার ছোট বেকারিটি চালান তার তিন ভাইকে নিয়ে। এই এলাকায় গত দেড় বছরে বাড়ি ভাড়া ৪০০% বেড়ে গেছে, বলছেন তিনি।
এই একই সময়ে তার বেকারি চালানোর অন্যান্য খরচও আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছে। কাঠের দাম বেড়েছে ৯০০%, ময়দার দাম প্রায় ৫০০%, খামির দাম বেড়েছে ২৫৫% আর সিসেমি সীডের দাম বেড়েছে ১৫০%।
এ পরিস্থিতি সামলাতে তুরস্কের অর্থমন্ত্রী মেহমেত সিমসেক বলেছেন, তিনি “যৌক্তিক অর্থনৈতিক নীতি” পুনপ্রতিষ্ঠা করবেন।
মি. সিমসেক ও নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর হাফিজে গায়ে এরকান – এ দুজনেই আগে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করেছেন। মেহমেত সিমসেককে মি. এরদোয়ান নিয়োগ দিয়েছেন গত মাসেই।
এই দুজনের সহযোগিতায় তিনি গত ২৭ মাসের মধ্যে এই প্রথম সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন – ৮.৫% থেকে ১৫%-এ।
কিন্তু ইস্তাম্বুলের রুটি বিক্রেতা মরকজ মনে করেন, তার মত ব্যবসায়ীদের অবস্থা যে কত সংকটাপন্ন তা রাজনীতিবিদরা বোঝে না।
“এখানে এই চুলোর সামনে ১৮-২০ ঘন্টা দাঁড়িয়ে দেখুন। আমি তিন ঘন্টা ঘুমাই, বাকি সময় কাজ করি। মেহমেত সিমসেক চেয়ারে বসে সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে এই কাজ করতে বলুন – এসব কাজ এভাবে হয় না,“ বলেন তিনি।
লিথুয়ানিয়ায় নেটো সম্মেলন থেকে ফেরার পথে বিমানে সংবাদিকদের মি. এরদোয়ান বলছেন, তুরস্কের জনগণের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনার দিকেই এখন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
“আমরা মুদ্রাস্ফীতি এক অংকে কমিয়ে আনবো,” বলেন তিনি।
তুরস্কের ৯০,০০০ কোটি ডলারের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য অনেক সময় ও ধৈর্য দরকার, বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
“এর কোন চটজলদি সমাধান নেই,” বলছেন মুরাত গুলকান ইস্তাম্বুলভিত্তিক একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ওএমজির প্রধান। “এ জন্য আপনাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কমিয়ে আনতে হবে যা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাঙ্খিত নয়।“
তুরস্কের জন্য আরো দরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
দেশটির চলতি হিসেব ঘাটতি এ বছর প্রথম পাঁচ মাসে ৩,৭৭০ কোটি ডলারে উঠেছে তা এক নতুন রেকর্ড। আর এর অর্থ হলো তুরস্ক রপ্তানি পণ্য যতটা বিক্রি করছে – তার চেয়ে অনেক বেশি আমদানির জন্য খরচ করছে।
অর্থনীতিবিদ আইরিস চিবরে বলছেন, “আমরা আরো একবার পশ্চিমের দিকে মুখ ফেরাচ্ছি। আমাদের পেছনে রয়েছে রাশিয়া।“
গত সপ্তাহশেষে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তার পাঁচজন কম্যান্ডারকে নিয়ে দেশে ফিরে যাবার সুযোগ করে দেন – যাদের এ বছরের বাকি সময়টা তুরস্কেই থাকার কথা ছিল। এরদোয়ানের এই পদক্ষেপ রাশিয়াকে ক্রুদ্ধ করে।
ক্রেমলিন তাকে সতর্ক করে দেয় “তুরস্ক যেন ইউরোপিয়ানদেরকে গোলাপী চশমার ভেতর দিয়ে না দেখে।“
কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পরিকল্পনা রয়েছে তিনি আগস্ট মাসে ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাগত জানাবেন। তার আশা, ইউক্রেনকে শস্য রপ্তানি করার সুযোগ দিয়ে যে কৃষ্ণসাগর চুক্তি হয়েছিল – তা টিকিয়ে রাখতে রাশিয়াকে তিনি রাজি করাতে পারবেন। আগামী সপ্তাহেই এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
বাতু কোসকুনের মতে এগুলো সবই হচ্ছে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার জন্য তুরস্কের নেতার চেষ্টা। কারণ তিনি রাশিয়াকে তার পক্ষে রাখতে চান।
পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক বাড়তে থাকলেও তা রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের জায়গা নিতে পারবে না – বলেন মি. কোসকুন।