ওয়াগনারের বিদ্রোহ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাজানো নাটক ছিল?

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
7 মিনিটে পড়ুন

ওয়াগনারের বিদ্রোহ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাজানো নাটক ছিল?

রুশ প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ৫ দিন পর ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের ব্যাপারে ক্রেমলিনের বিবৃতি ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের বিদ্রোহ এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে আরও রহস্যমণ্ডিত করে তুলেছে।

গত ২৪ জুন, প্রিগোজিনের ভাড়াটে যোদ্ধারা দক্ষিণাঞ্চলীয় রুশ শহর রোস্তভ-অন-দনের সামরিক কেন্দ্রগুলো দখল করে নিয়ে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে মস্কোর দিকে রওনা হয়েছিল।

বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় পরে ওয়াগনারপ্রধান তার বিদ্রোহের ইতি টানতে ও বেলারুশে নির্বাসনে যেতে রাজি হন।

এর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পর সোমবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ২৯ জুনই প্রিগোজিন ও তার তিন ডজন সঙ্গী পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং রাশিয়ার সুপ্রিম কমান্ডারের প্রতি তাদের জোর আনুগত্য ব্যক্ত করেছেন।

- বিজ্ঞাপন -

অথচ ওই একই দিন পেসকভকে ওয়াগনার প্রধান কোথায় তা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল; সেসময় তিনি তার অবস্থান জানেন না বলেই দাবি করেছিলেন।

এখনও একসময়ের দাগি আসামী, পরে ব্যবসায়ীতে পরিণত হওয়া প্রিগোজিনের অবস্থান অজানা, যেমন অজানা ২৩ বছরের প্রেসিডেন্টকালে পুতিন সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তার পেছনে আদতেই কী ছিল, তা।

অস্ত্র হস্তান্তর করছে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা: রাশিয়া
বিদ্রোহের সময় রোস্তভ-অন-ডন শহরে ওয়াগনার যোদ্ধারা। ছবি রয়টার্স

“পুরো প্রিগোজিন পর্ব, এমনকী বিদ্রোহের আগের ঘটনাগুলোও আমার কাছে এক ধরনের প্যারোডি মনে হয়েছে, পশ্চিমাদের জন্য যেটি পুতিন আর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা মিলে মঞ্চস্থ করেছেন,” নিউজউইককে এমনটাই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো কলেজের রাশিয়া বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক অ্যালেক্সি পাভলেঙ্কো।

“এই নাটকের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা বিশ্লেষক আর সমর বিশেষজ্ঞদের বিভ্রান্ত করে দেওয়া এবং পুতিনের আসন্ন পতন নিয়ে তাদের অনুমিত পূর্ভাবাসকে খেলো করে দেওয়া। এই মঞ্চস্থ ঘটনার উদ্দেশ্য ছিল একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের দৌড়ের ওপর রাখা এবং শত্রুপক্ষের গোয়েন্দাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেওয়া,” বলেছেন তিনি।

ইউক্রেইনে যুদ্ধ, আনুষ্ঠানিকভাবে যাকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলা হচ্ছে, তার সমালোচনা করলে রাশিয়ায় ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে অথচ প্রিগোজিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু আর ইউক্রেইন যুদ্ধের কমান্ডার ভ্যালেরি গেরাসিমভের কড়া সমালোচনা করেও মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

- বিজ্ঞাপন -

এই সেই প্রিগোজিন, যিনি এই সেদিনও পুতিনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যাকে ক্রেমলিন কোটি কোটি ডলারের সরকারি কাজ দিয়েছে, যার বাহিনী এতটাই বিশ্বস্ত ছিল যে তাদেরকে বাখমুত দখলের লড়াইয়ে অগ্রভাগে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

এক সময়ের এ দাগি আসামীকে যে হাত খাওয়াতো, ২৪ জুন সেই হাতেই কামড় বসান তিনি। এই ঘটনা নিয়ে কারা কতটুকু জানতো তা নিয়ে এখন নানান প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।

নিউজউইকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক এক কর্মকর্তা রেবেকা কফলারও রাশিয়ার ভেতর ঢুকে মস্কোর দিকে অগ্রসর হওয়া একটি বাহিনী কীভাবে কোনো হতাহত ছাড়াই দ্রুত পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি উপনীত হয়ে যায় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

- বিজ্ঞাপন -

প্রিগোজিনের বিদ্রোহ ছিল আদতে সাজানো নাটক এবং পুরোপুরি ভুয়া মঞ্চস্থ একটি অভিযানের অংশ, বলেছেন তিনি।

ওয়াগনারের বিদ্রোহ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাজানো নাটক ছিল?
রাশিয়ার রোস্তভে বিদ্রোহের সময় ওয়াগনারের যোদ্ধারা। ছবি রয়টার্স

২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে পুতিনহীন রাশিয়ায় পশ্চিমারা আক্রমণ চালাতে পারে এবং দেশে অরাজকতা দেখা দিতে পারে এটা বোঝাতেই ওয়াগনার বাহিনীকে দিয়ে এই সাজানো নাটক নামানো হয়েছে বলে মত তার।

কিইভ পোস্টে লেখা নিবন্ধে স্টিভ ব্রাউন রাশিয়ার সামরিক ডকট্রিনে থাকা ‘ধোঁকা দেওয়ার’ প্রবণতার কথা উল্লেখ করে ওয়াগনারের বিদ্রোহ ‘পুতিনের অপপ্রচারের আরেকটি নজির কিনা’ সেই প্রশ্নও তুলেছেন।

মস্কোর আগে ওয়াগনারকে থামাতে রুশ বাহিনীর অক্ষমতা ঘিরে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করলেও ব্রাউন এই বিদ্রোহ পুতিন যাদের অবিশ্বস্ত বলে মনে করেন তাদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানোর লক্ষ্যে করা হয়েছে কিনা সেই জিজ্ঞাসাও হাজির করেছেন।

রাশিয়ায় পুতিনের শাসনের অবসান চাওয়া দল কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজের ইলিয়া পনোমারেভ সম্প্রতি নিউজউইককে বলেছেন, প্রিগোজিনের পরিকল্পনা সম্বন্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট আগে থেকেই অবগত ছিলেন এবং তাদের ওই বিদ্রোহকে তিনি নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করেছেন।

পুতিন আর প্রিগোজিন মিলে এই পরিকল্পনা সাজিয়েছেন কিনা তা না জানলেও পনোমারেভের বিশ্বাস, পুতিন ‘স্বল্প ক্ষতিতে দীর্ঘমেয়াদী লাভ’ হাসিল করে নিয়েছেন।

ওয়াগনারের এই বিদ্রোহ সাজানো ছিল- এমন ধারণা অনেক রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও অনেকের চোখে তাকে দুর্বল হিসেবে প্রতীয়মান করেছে যে বিদ্রোহ, সেই সম্বন্ধে আগে থেকে জেনেও সেটি সংঘটিত হতে পুতিন কেন দেবেন সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

রুশ প্রোপাগান্ডা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, মিনেসোটারা কার্লেটন কলেজের অধ্যাপক ডায়ানে নেমেক ইগনাশেভ বলছেন, যা ঘটেছে, ক্রেমলিন এখন সে বিষয়ে নতুন ভাষ্য দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।

“ক্রেমলিন যা ঘটেছে তা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঘটনাটি ঘটার সময় গণমাধ্যমে কত ধরনের বিভ্রান্তি, কত উল্টাপাল্টা বার্তা, কত গুঞ্জন। কী হয়েছিল, সে বিষয়ে পুতিনের কোনো ধারণাই ছিল না, এটা এমন একটা ঘটনা ছিল, গণমাধ্যমের কেউই এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না,” বলেছেন ইগনাশেভ।

নর্থ ক্যারোলাইনার মেরেডিথ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক গ্রেগরি ভিতারবো বলেছেন, প্রিগোজিনের মস্কো অভিমুখে অগ্রযাত্রা পুতিনের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, এই ধারণার আলোকে দেখলে বিদ্রোহটি সাজানো ছিল এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ মনে হয়।

“রাশিয়ায় গণমাধ্যম যে কঠোর নিয়মনীতির মধ্যে থাকে, সেই পরিস্থিতিতেও এই বৈপরীত্য ধরা পড়ে, যেখানে পুতিন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া নজিরবিহীন ভাষণে নির্মম প্রতিরোধের অঙ্গীকার করছেন, অপরদিকে কিছুক্ষণ পরেই তার জুনিয়র অংশীদার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিও করে ফেললেন। এটা দেশের ভেতরকার দর্শকদের ধরতে না পারার কথা নয়,” নিউজউইককে বলেছেন ভিতারবো।

ওয়াগনারের বিদ্রোহ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাজানো নাটক ছিল?
রাশিয়া ছেড়েে বেলারুশে যাওয়ার সময় ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগিনি প্রিগোজিন। ছবি এপি

বেলারুশে প্রিগোজিনের নির্বাসন আর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হওয়া আইনি পদক্ষেপ তুলে নেওয়া ছাড়া ওই চুক্তিতে আর কী কী ছিল সে সম্বন্ধে ‍খুব বেশি কিছু জানা যায়নি।

তবে রাশিয়ায় প্রিগোজিনের উপস্থিতি এবং পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে মনে হচ্ছে চুক্তির বিস্তারিত নিয়ে কাজ এবং ভবিষ্যতে ওয়াগনারের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা এখনও চলছে, বলেছেন ম্যাসাচুসেটসের নর্থহ্যাম্পটনের স্মিথ কলেজের ইস্ট ইউরোপ অ্যান্ড ইউরেশিয়ান স্টাডিজের রাশিয়া বিষয়ক সহকারী অধ্যাপক টম রবার্টস।

“শত্রুদের প্ররোচিত করতে বা বিশ্বস্তদের পরীক্ষা নিতে নাটক সাজানো তো দূর পুতিন এই বিদ্রোহ ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আগেভাগে জানতেন সেটাই মনে হচ্ছে না, কেননা এটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতের অনেক বাইরে ছিল,” বলেছেন তিনি।

ওয়াগনারের এই বিদ্রোহে রাশিয়ার বিমান ধ্বংস হয়েছে, রুশ সেনাবাহিনী ও ওয়াগনার উভয়েরই হতাহত হয়েছে।

“ইউক্রেইনে এমন ক্ষয়ক্ষতির পর পুতিন আর প্রিগোজিন মিলে রাশিয়ার ভেতর আরও মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনবেন- এমনটা অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে। প্রিগোজিন হয়তো ভেবেছিলেন রুশ সামরিক বাহিনী এবং এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভেতর তার প্রতি ব্যাপক সমর্থন আছে, কিন্তু বিদ্রোহ চলাকালে সেটা দেখা যায়নি, কেউই তার সমর্থনে নেমে আসেনি,” বলেছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক ফেলো মার্ক টেমনিসকি।

“হতে পারে পুতিন আর তার প্রতি অনুগতরা হামলার খবর জানতে পেরে তড়িৎগতিতে প্রিগোজিনকে সমর্থনকারীদের ক্ষমতা খর্ব করে ফেলেন। এটা ওয়াগনারকে হতভম্ব করে দেয়, কিন্তু সে সময় তাদের অভিযান অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। প্রিগোজিন সম্ভবত ভেবেছিলেন, তিনি আর পেছনে ফিরতে পারবেন না,” বলেছেন তিনি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!