শরতের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আজও দেখা হয়। কত কথা হয়েছিল। আজও কত কথা হয়। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু শরৎ! শরৎ তো যুবতী! ওর শিউলি ফুল নিয়ে নাকছাবি বানায়। নীলআকাশ নিয়ে ও নীলশাড়ি তৈরি করে। আসন্ন রাত্রিকালে মাথার খোঁপা খুলে দেয়। ঝিকিমিকি তারার ফুল ফুটে ওঠে তখন। ওর স্নিগ্ধ নদী টলটলে ঊরুর মতন। ঝাঁপ দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। প্রেমের পদ্ম ফুটে উঠলে ভ্রমর হবার সাধ জাগে। একা একা উদাসীন হয়ে বসে থাকি। গোধূলি রাঙা বিকেল সন্ধ্যার দিকে চলে যায়। দূর থেকে কারা যেন মনভুলানিয়া ডাক দেয়। শরৎ, সত্যি বলি, কবে তোর প্রেমে পড়ে গেছি। আমার যুবক বয়স, আমার মধ্যবয়স, আমার এই বাণপ্রস্থ সবই তোকে উৎসর্গ করলাম।
একটু দাঁড়া, স্মৃতিগুলি খুঁড়ে দেখি: কত আলো, কত বাতাস, কত প্রতিমার মুখ সেখানে যাওয়া-আসা করে। বাজনা বেজে ওঠে। হলুদ ফ্রকের লাল নীল ফুলগুলি পাপড়ি মেলে দেয়। প্রথম চোখ প্রথম চোখে পড়ে। আর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। প্রথম ছোঁয়া প্রথম শিহরণ তোলে। আর বুকের ভেতর তরঙ্গের অভিঘাত শুরু হয়। তারপর প্রথম চুমু আসে। গোপন হ্রদের মিষ্টি জলে প্রথম স্নান। তারপর! তারপর কবে আলতা পরা পা নূপুর বাজাতে বাজাতে সম্মোহনের দরজা খুলে দেয়। ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে আমার প্রথম কদম বনে। হ্যাঁ কৃষ্ণ হই আমি। আমার কৃষ্ণজন্ম হয়। আমার এই লীলাভূমি তখন বৃন্দাবন। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁই তাকে। বাজাতে পারি না বাঁশি। তবু বাঁশি বাজে। নিশি রাতে ডাক পাই জ্যোৎস্নার। অলৌকিক এক জাগরণ আসে। জাগরণগুলি শব্দে শব্দে বাঁধি। কিশোর চেতনা আর চঞ্চল দুর্মতি মিশে যায়। এত আছে! এত ভরা সাম্রাজ্য তার! তবু শূন্যতা ঘর বাহির করে। একতারায় কেটে কেটে যায় অনন্তের সুর। আমি শুধু আমি! আমাকে ঘিরেই স্বপ্ন সমারোহ! আমাকে ঘিরেই বন্দনা আমার! আত্মরতির ঘোর অভিলাষ। অন্ধ করে দিতে থাকে। শব্দ হাতড়াই শুধু। শব্দে শব্দে জীবনের এই সেতু। সেতুর উপরে দাঁড়াই:
‘কত জল, হেলেঞ্চা ফুলের গান
গ্রামের পুকুর পাড়ে শৈশব খুঁজে পাই
টুকরো টুকরো আকাশ নেমে আসে
শরতের শুভ্র হাসি, বিহঙ্গের নতুন উড়ান
মায়ের আঁচল ধরে থাকি
অনন্ত সময়ের তীরে মায়ের নিখুঁত মুখচ্ছবি
বহু ঢেউ, বহু রজনীর ঘুমভাঙা চোখ
সকাল হয়, সকালে সকালে নামে আলোর কপোত
সোনালি মার্বেলগুলি গড়ে যেতে থাকে
পুজো মণ্ডপের দিকে, জলরঙের ছবি হয়
স্মৃতির উঠোনে।’
(শৈশব)
মার্বেলগুলি সোনালি রঙের। তারা পূজামণ্ডপের দিকে চলে যেতে থাকে। তাদের পেছনে পেছনে যাই। কখনো মনে হয় আলোর কপোত। ঝাঁক ঝাঁক নেমে এসেছে। খুঁটে খুঁটে খেয়ে নিচ্ছে আমাদের বোধ। অনুভূতি ও স্বপ্নগুলির তখন অঙ্কুরোদগমের সময়। আমরা নিজের ভেতর তার শিহরণ টের পাচ্ছি। পদ্মদীঘির পুকুরে স্নান করতে গিয়ে কাজল কালো জলের দিকে চেয়ে থাকছি দীর্ঘক্ষণ। ভেজা শরীর ভেজা কাপড়ে লেপটে উঠে আসছে জলপরী। জলের বিন্দুগুলি সোনালি মার্বেল হয়ে গড়ে গড়ে যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধির দোলাচল উন্মন করে দিচ্ছে। মানবী হয়ে যাচ্ছে দুর্গা। মনের উঠোনে পুজোর মণ্ডপ সাজিয়ে ১০৮ টা নীলপদ্ম তুলে আনছি। তারপর সত্যি সত্যি প্রতিমা আসছে, রক্তমাংসের জীবন্ত প্রতিমা। প্রতিমা তখন আকাশ হয়ে, পদ্মদীঘি হয়ে, শান্ত স্নিগ্ধ ভোর হয়ে, গোধূলি রাঙা বিকেল হয়ে, অদ্ভুত এক স্বপ্ন হয়ে মাথার ভেতর ঘুরপাক দিচ্ছে। আমাদের দুঃখগুলি, না পাওয়াগুলি, মনখারাপ ও কষ্টগুলি শরতের আয়নায় বারবার মুখ দেখে নিচ্ছে। ভালো নেই তবুও ভালো আছি। শিউলি-কাশের সমারোহে ঠাণ্ডা বাতাসে মন-মাতোয়ারা আমরা যেন রাজপুত্তুর। জয় করতে এসেছিলাম রাজকন্যা। আমাদের সব ঠিকানা হৃদয়পুর। প্রথম চুম্বনের শিহরণ নিয়ে আজও কেঁপে উঠি। স্বরলিপি খুঁজে খুঁজে বাজে:
‘ও চুম্বন ,
বিশ্বাসের নদী পেরিয়ে
জাগরণের রাত্রি পেরিয়ে
চলে যাচ্ছি দূরে
শিহরনের ফুল ফুটছে
আমার শরীরে
পাপড়িঠোঁটে কী বিস্ময় আলো
স্বপ্নের ভ্রমর এসে
আমার হৃদয়ে গান রেখে গেল
সমস্ত সময় ধরে প্রেমের প্রবাহ
তোমারই স্পর্শে বেজে ওঠে
সে এক ভাষাহীন অনুভূতি
সে এক ভাষাহীন দাহ!’
(প্রথম চুম্বন)
শরৎ যাপনে এ এক ভাষাহীন দাহ। প্রকৃতির কোলে নিজেকে উজাড় করে কোনো তপস্বীর মতো চেয়ে থাকা অনন্তের পানে। মানবজীবনের সবচেয়ে রসালো মধুর স্বপ্নময় এ এক গভীর পর্যটন। শৈশব থেকে বাণপ্রস্থ পর্যন্ত তার বাঁক পরিবর্তন করে, কিন্তু রহস্য থেকেই যায়। চঞ্চলতা থেকে নির্জনতা, মুখরতা থেকে নীরবতা একে একে ফিরে আসে। আজ সব সীমানা অতিক্রম করে নিসর্গ বিলাসের কোনো আধ্যাত্মলোকে মনোরথ পৌঁছে গেছে। প্রতিমাগুলির উত্তরণ ঘটেছে। কোথাও গৃহিণী, কোথাও মাতৃমূর্তি জননীতে পরিণত হয়েছে। অনন্তের সমুদ্রের কিনারে যে শরৎ আজ দরজায় কড়া নাড়ে, তা রোমান্টিকতার শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলে কর্তব্যপরায়নী নারায়ণীর মতো শ্বেতশুভ্র চন্দনের ফোঁটা ভালে নীল কলেবর চর্চিত দেহে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পবিত্রতম হাসিতে মুগ্ধতা থাকলেও আজ আর চঞ্চলতা নেই। আত্মরতির নিবিড় সংযমে যার উষ্ণতায় ব্যাকুল হয়ে উঠতাম, তা আজ অনেকটাই ঠাণ্ডা। আরতির মন্ত্রপাঠের আকুতির মতো প্রেরণা এখন। হাত দুটি ছুঁয়ে দেখি: শিরা-উপশিরাময় জাদুহীন এক স্পর্শ লেগে আছে। নস্টালজিক হয়ে তখন পিপাসার কাছে যাই:
‘শরৎ তোমার কাছে
আমার অনেক ঋণ আছে’
মন কখনো বৃদ্ধ হয় না বুঝতে পারি। একবার মণ্ডপ ঘুরে আসি। আলো-আঁধারি রাস্তায় যুবক-যুবতীর কোলাহল। রাঙা চপ্পলের শব্দ। চুলের ঘ্রাণ। বাতাসে ছুটে আসা প্রাচীন কম্পন। বাড়ি ফিরে এসে আমার সেই প্রাচীন বাজনার কাছে বসি। কিছুক্ষণ জেগে জেগে কাটে। স্বপ্ন আর আসে না দুয়ারে। গোপনে গোপনে ইশারায় ডাকে না। আলো নিভিয়ে দিলে দেখি:
‘স্মৃতির সরোবর জুড়ে
পদ্মেরা ফুটেছে
ভ্রমর উড়ছে দলে দলে
জলের আয়নায় আমারই অতীতমুখ
চেয়ে চেয়ে আমাকেই দ্যাখে।’
এইটা দেখার হয়তো শেষ নেই। এই দেখার মধ্যে দিয়েই নস্টালজিক এক শরৎ যাপন চলতেই থাকবে আমৃত্যু।
যে শব্দগুলি জীবনচেতনার সেতু গড়ে দিত, আজ তা আধ্যাত্মিক প্রচ্ছায়ায় এক ভিন্ন দর্শনের পথ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। চলমান জীবন প্রবাহ ঋতুযাপনের শরৎপ্রবাহে তা জাগতিক ক্রিয়া নির্মাণ করে দেয়। তখন অভিব্যক্তির এক নতুন বিন্যাসে শব্দগুলিও চালিত হয়। ‘সোনালি কপোত’ ‘হেমবর্ণ ঈশ্বরে’ পরিণত হয়:
‘এখন অনুমান করে নিতে পারছি
সব রমণীরাই এক একটি সাদা ঘোড়া
প্রেমিকেরা তাদের পিঠে চড়ে চলে যাচ্ছে
দূর নক্ষত্রের দেশে
আমরা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকছি
মাঠময় আমাদের কুঁড়ে ঘর
ঘরে ঘরে কোলাহল জেগে আছে
অভিব্যক্তির চড়া রোদে শুকিয়ে নিচ্ছি ব্যঞ্জনা
আর কৌশলগুলি নিরর্থক বহ্নিশিখা
আগুন জ্বালাবার তালে আছে
এক একবেলা মেঘের পাহাড়ে
কল্পনার ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করে
প্রেমিক প্রেমিকারা তাদের দিকে রুমাল ছুঁড়ে দেয়
সেইসব টুকরো রুমালে নৈসর্গিক ভাষা
চিকচিক করে ওঠে
আমরা সদর্থক জীবন ভিক্ষা পাই
আমরা গোধূলির পাঠশালায় হেমবর্ণ ঈশ্বরকে দেখি
যে আমাদের প্রত্যয় জাগায় প্রত্যহ’
(হেমবর্ণ ঈশ্বর)
‘কল্পনার ছেলেমেয়ে’ নিয়ে নৈসর্গিক ভাষায় জীবনের প্রত্যয় অন্বেষণই এই যাপনের মূল ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ‘গোধূলির পাঠশালা’য় ‘হেমবর্ণ ঈশ্বরে’র সঙ্গে তখন দেখা হয়ে যায়। আধ্যাত্মিকলোকেও রোমান্টিকতার স্পর্শ শরৎকে এক নতুন ব্যঞ্জনায় উত্তরণ ঘটায়। সদর্থক ভাবনাগুলি কাম-কামনাবিহীন হলেও জীবনের বাঁকে বাঁকে উজ্জীবনের ধারাপ্রবাহ আঁকতে থাকে।#