ভারতে বিয়েতে বেড়েছে যৌতুক
গত কয়েক দশকে ভারতে পুরুষদের মধ্যে শিক্ষা ও কাজের সুযোগ যেমন বেড়েছে, বিয়ের সময় যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
ওই গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া দক্ষিণ এশিয়ার শতাব্দী পুরনো রেওয়াজ, যেখানে বিয়ের সময় কনের পরিবার নগদ অর্থ, ঘড়ি এবং স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন দামি উপহার দেয় বরের পরিবারকে।
১৯৬১ সালে এই প্রথা ভারতে বেআইনি ঘোষণা করা হলেও যৌতুক বা পণ নেওয়া হয়নি, বরং বেড়েছে। এই যৌতুক অসংখ্য নারীকে ঠেলে দিয়েছে পারিবারিক সহিংসতা, এমনকি মৃত্যুর দিকে।
সময়ের ব্যবধানে যৌতুকের বিবর্তন বোঝার জন্য ১৯৩০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে ভারতের ৭৪ হাজারেরও বেশি বিয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ইউনিভার্সিটি অফ সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার জেফরি ওয়েভার এবং ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার গৌরব চিপলুঙ্কার।
বর ও তার পরিবারকে দেওয়া নগদ অর্থ ও উপহার এবং কনের পরিবারকে দেওয়া বরের পরিবারের উপহারের পার্থক্য হিসাব করে তারা ‘নিট যৌতুক’ বের করেছেন।
ভারতের গ্রামীণ অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সমীক্ষার তথ্যের ওপর নির্ভর করে দেশটির সবচেয়ে জনবহুল ১৭টি রাজ্যে একটি প্যানেল সমীক্ষা চালিয়েছেন এই গবেষকরা।
বিবিসি লিখেছে, ভারতের বেশিরভাগ বিয়ে এখনও পারিবারিকভাবে হয়। বয়স ২০ এর কোঠা শেষ হওয়ার আগেই বেশিরভাগ নারীর বিয়ে হয়ে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৯০ শতাংশ বিয়েতেই যৌতুক লেনদেন হয়েছে। আর্থিক হিসাবে, ১৯৫০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে যৌতুকের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি ডলার।
গবেষণার বরাতে জেফরি ওয়েভার বিবিসিকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যত মজবুত হয়েছে, যৌতুক লেনদেনের চর্চাও বেড়েছে। বিশেষ করে এই প্রবণতা বেশি বেড়েছে ১৯৪০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। এই সময় ধরে অনেক বেশি পুরুষ শিক্ষিত হয়েছে, ভালো মানের চাকরি পেয়েছে; ফলে যৌতুকও বেড়েছে।
গবেষণা বলছে, যৌতুকের বিবর্তন সবচেয়ে কার্যকরভাবে বোঝা যায় বরের অবস্থার পরিবর্তন দিয়ে; যা বরের শিক্ষা ও উপার্জন বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারতের কর্মশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ কম, ফলে পুরুষদের জন্য তা আরও বেশি এবং ভালো কাজ বা চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে।
সহজ করে বললে, ‘উচ্চ মানের বর’, যারা সুশিক্ষিত ও ভালো চাকরিতে আছে, তাদের যৌতুকের চাহিদা অনেক বেশি। বিয়ের বাজারে শিক্ষিত বরের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় অংকের যৌতুক নেওয়া কমেছে, যা আবার অনেক বেশি শিক্ষিত বরেরা গ্রহণ করছে।
ওয়েভার ও চিপলুঙ্কার বলেন, যৌতুক লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কনেপক্ষ যদি যৌতুক দিতে অস্বীকার করে, তাদের জোটে ‘নিম্নমানের’ বর। যৌতুক নেওয়ার ক্ষেত্রে বরের পরিবারেরও অন্য অর্থনৈতিক ভাবনা থাকে; বিশেষ করে যদি বরের পরিবারের কোনো কনের বিয়েতে যৌতুক দিতে হয়, কিংবা বরের শিক্ষায় খরচ যদি পুষিয়ে নিতে চায়।
একনজরে ভারতে বিয়ে
ভারতে বিয়ে বিচ্ছেদের হার ১ শতাংশেরও কম
পাত্র/পাত্রী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বাবা-মা। ১৯৬০-২০০৫ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে অভিভাবকরাই পাত্র/পাত্রী পছন্দ করেছেন।
বিয়ের পর ৯০ শতাংশের বেশি নারী স্বামীর পরিবারের সঙ্গে থাকেন।
৮৫ শতাংশের বেশি নারী নিজ গ্রামের বাইরের কাউকে বিয়ে করেন।
একই জেলার মধ্যে বিয়ের হার ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
[সূত্র: ভারতের মানবোন্নয়ন জরিপ-২০০৫, জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য জরিপ-২০০৬ এবং রেডস ১৯৯৯]
যৌতুক লেনদেনের এই চিত্র কি কেবল ভারতের? ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিওয়ান অ্যান্ডারসন আরেক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ইউরোপসহ অনেক উন্নত সমাজে সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌতুক দেওয়া কমেছে। কিন্তু ভারতের মত যেসব দেশে বর্ণপ্রথা বা সামাজিক বিভাজন রয়েছে, সেখানে সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যৌতুক দেওয়ার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওয়েভার ও চিপলুঙ্কার জানান, যৌতুক প্রথার প্রসার নিয়ে তাদের গবেষণায় প্রচলিত যে ব্যাখ্যাগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায় খুব কমই।
একটি তত্ত্ব হল, যৌতুকের প্রচলন ছিল উচ্চবর্ণের পরিবারগুলোর মধ্যে। এরপর নিম্নবর্ণের লোকেরা তাদের সামাজিক গতিশীলতা উন্নয়নে এই প্রথা অনুকরণ করে। তবে নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়; কারণ যৌতুকের প্রচলন উঁচু ও নিচু উভয় গোষ্ঠীতে একই সময়ে শুরু হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, নিম্নবর্ণের নারীদের উচ্চবর্ণের পুরুষদের বিয়ে করার আকাঙ্ক্ষা যৌতুকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে।
যদিও ওয়েভার এ বিষয়টিকে ‘ভুল’ বলে মনে করেন। তার কথায়, বর্ণ বা গোষ্ঠীর বাইরে গিয়ে বিয়ের সংখ্যা অনেক কম। ভারতের হিন্দু পরিবারের ৯৪ শতাংশ বিয়ে তাদের বিস্তৃত বর্ণ বা গোষ্ঠীর ভেতরেই হয়।
কিন্তু নারীরা যখন আরও বেশি শিক্ষিত হচ্ছে, তখনও যৌতুক থাকবে?
ওয়েভার বলেন, গত দুই/তিন দশক ধরে ভারতে উল্লেখযোগ্যভাবে নারী শিক্ষা বেড়েছে, অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় এগিয়েও থাকছে নারীরা। এই ধারা চললে যৌতুক প্রথা কমে আসতে পারে বলে কেউ কেউ ধারণা করতে পারেন, তবে এর পক্ষেও সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি এলাকায় যত বেশি নারী শিক্ষিত হয়েছে, যৌতুকের অংক সেখানে কমেছে। যদিও এক বছরে পুরুষদের গড় শিক্ষা বৃদ্ধির তুলনায় একইসময়ে নারীদের গড় শিক্ষা বৃদ্ধির প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এর কারণ সম্ভবত, শিক্ষিত এসব নারীদের কাজ করার প্রবণতা কম এবং এভাবে তারা শিক্ষার মাধ্যমে শ্রমবাজার থেকে অর্থনৈতিক উপযোগিতা পান।
তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হল, নারী শিক্ষার প্রচার ও কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি যৌতুকের অভিশাপ মোকাবেলায় তাদের সাহায্য করতে পারে।