তখনও আমি আনন্দবাজারে ঢুকিনি। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি বোধহয়। আনন্দমেলা, সানন্দা এবং দেশ পত্রিকায় লিখি। মাঝে মাঝে আনন্দবাজারে। রমাপদ চৌধুরীর সামনের টেবিলে খবরের কাগজ পেতে প্রচুর মুড়ি মাখা হতো। সঙ্গে তেলেভাজা। আর খানিক পর পর একটি ছেলে ট্রলি করে দিয়ে যেত চা। সেই টেবিল ঘিরে আড্ডা দিতেন তাবড় তাবড় কবি-লেখকেরা। সেই আড্ডা বিকেল থেকে সন্ধে গড়িয়ে যেত। সে রকমই এক আড্ডায় রমাপদবাবু আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সমরেশ মজুমদারের। আমার নাম শুনে সমরেশদা বলেছিলেন, সিদ্ধার্থ সিংহ! সিদ্ধার্থ মানে তো গৌতম বুদ্ধ। অহিংসার প্রতীক। আর সিংহ হচ্ছে হিংস্র। এই দুটো একসঙ্গে কী করে হয়! সে বছরই আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে তিনি যে ধারাবাহিক উপন্যাসটি লিখেছিলেন, সেই উপন্যাসে নায়কের নাম দিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ সিংহ।
সমরেশ মজুমদারের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির গয়েরকাটায়। ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ। বাংলা ১৩৪৮ সনের ২৬শে ফাল্গুন। বাবা কৃষ্ণদাস মজুমদার আর মায়ের নাম শ্যামলী দেবী।
তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে। ভবানী মাস্টারের পাঠশালায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। এর পর বিদ্যালয়ের পাঠ জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তিনি ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক। ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’-এর মতো বহু উপন্যাস বাঙালি পাঠককে তিনি উপহার দিয়েছেন। বেশ কিছু জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের কাহিনিকারও তিনি। শহরকেন্দ্রিক জীবনের ঘটনা বারবার উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। যে কারণে তাঁকে আপাদমস্তক ‘আরবান’ লেখক বলেও অনেকে বর্ণনা করেছেন।
তিনি তাঁর লেখালেখির জন্য ১৯৮৪ সালে পান সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ২০০৯ সালে বঙ্কিম পুরস্কার এবং ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বঙ্গবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত হন। পেয়েছেন আইয়াইএমএস পুরস্কারও।
চিত্রনাট্য লেখক হিসাবেও ১৯৮২ সালে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির শ্রেষ্ঠ স্ক্রিপ্ট রাইটার এওয়ার্ড।
কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা‘ লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসাবে, আর সেখান থেকেই তাঁর লেখকজীবনের শুরু।
তাঁর লেখা অন্যমাত্রা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল দেশেই ১৯৭৫ সালে। তিনি শুধু গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখাতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আন্দলিত করে। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা তাঁর কলমে উঠে এসেছে রক্ত-মাংস নিয়ে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’ বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁকে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী করেছে।
কিছুদিন আগেই, যে পত্রিকার আমি কলকাতার প্রতিনিধি, আমাদের সেই উড়ালপুল পত্রিকার সর্বময়কর্তা, আমেরিকানিবাসী গৌতম গ্যারি দত্ত বিজনেস ক্লাসের ফ্লাইটের টিকিট পাঠিয়ে সমরেশদাকে এ বছরের ৩০ জুন, ১ এবং ২ জুলাই, মোট তিন দিনের জন্য নর্থ আমেরিকা বাঙালি কনফারেন্স ২০২৩-এ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
‘পত্র ভারতী’র কর্ণধার, ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক এবং কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের কথা শুনে সমরেশদা বলেছিলেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু অতটা পথ, প্রায় ১৮ ঘণ্টার ফ্লাইট, নাহ্, পারব না। তুমি বরং আমাকে বাংলাদেশের ভিসাটা করিয়ে দাও। আধঘণ্টার ফ্লাইট, ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ থেকে বারবার বলছে, শুনলাম তোমরাও যাচ্ছ, তোমাদের সঙ্গে যাব।
ত্রিদিবদা বলেছিলেন, সে করিয়ে দিচ্ছি দাদা, পাশাপাশি আমেরিকার ভিসাটাও হয়ে থাকুক না!
তিনি বলেছিলেন, যা ভাল বোঝো, করো। শুধু শুধু ওদের একগাদা টাকা খরচ করাচ্ছ।
এক বছরের বাংলাদেশ ভিসা হয়ে এল। তিনি খুব খুশি। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ দুর্বলতা। সমরেশদা ৯৪ বা ৯৫ সালের দিকে একবার ঢাকায় গিয়েছিলেন। তাঁকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আড্ডায় শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, সমরেশ মজুমদারের বেশিরভাগ বইই তাঁর পড়া। সাতকাহনের দীপাবলী চরিত্র নিয়েও কথা বলেছিলেন। সমরেশদা খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, আপনি এখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী হলে যা চাইব তা কি পাব?
শেখ হাসিনা বলছিলেন, লেখক যা চাইবে তাই দিয়ে দেব। সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, তা হতে সাদা কাগজে লিখে দিন আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলাদেশে প্রবেশে সমরেশ মজুমদারের কোনও ভিসা লাগবে না।
শেখ হাসিনা কাগজ কলম নিলেন এবং লিখে দিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হলে লেখক সমরেশ মজুমদারের বাংলাদেশে প্রবেশে ভিসা লাগবে না। নীচে সাক্ষরও করে দিলেন।
না, ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। সমরেশদা ৯৭ সালের বইমেলায় ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে পাসপোর্টের পরিবর্তে ইমিগ্রেসনে জমা দেন শেখ হাসিনার লেখা সেই কাগজ। অফিসারের চোখে বিস্ময়। কী করবেন এখন? তিনি সিনিয়র অফিসারকে ডেকে নিয়ে এলেন। সিনিয়র অফিসার আবার সমরেশ মজুদারের ভক্ত। বললেন, দাদা জাতির জনকের কন্যার পক্ষেই সম্ভব, এভাবে একজন লেখককে সম্মান জানানো। বাইরে আপনার লোকজন অপেক্ষা করছেন। সমরেশদা পাসপোর্ট বের করে দেন। শেখ হাসিনার সেই লেখা এখনও তাঁর বাড়িতে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে।
শেষ জীবনে সিওপিডিতে ভুগছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল স্লিপ অ্যাপনিয়াও। মানে ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতেন মাঝে মধ্যেই। কিন্তু অসম্ভব মনের জোরে ফিরে এসেছেন বারবার, আবার লিখতে শুরু করেছেন। একবার তো বাংলা অক্ষরই ভুলে গিয়েছিলেন! নতুন করে অ আ ক খ প্র্যাকটিস করে লেখায় ফিরে এলেন। ভাবা যায়!
২০২৩ সালের ২৫ই এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার কারণে সমরেশদাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অসুস্থতার কারণে খুব কম দেখা হতো। শ্যামপুকুরের বাড়িতেও আমার আর যাওয়া হতো না। শুধু ফোনে কথা হতো। তবু তারই মধ্যে কথা দিয়েছিলেন শরীর একটু ভাল হলেই আমাদের পত্রিকার জন্য তিনি লিখবেন। কিন্তু ৮ই মে, সোমবার, স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে কলকাতার একটি হাসপাতালে, তাঁর ৮১ বছর বয়সে যা ঘটল, তাতে সেই লেখা আমাদের আর কোনও দিনই পাওয়া হবে না। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি তো শুধু একা গেলেন না, সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন যীশু দাশগুপ্তকেও। যেটা ছিল সমরেশদার আর একটা ছদ্মনাম।#