ভারতের শাসক দল বিজেপির নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্টরা একটা কথা খুব গর্বের সঙ্গে বলে থাকেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের যে প্রান্তেই প্রচারে যান না কেন – একার ক্ষমতায় তিনি প্রায় দশ থেকে পনেরো শতাংশ ভোট ‘সুইং’ করাতে পারেন।
বিগত প্রায় এক দশকে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসাম, মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিমবঙ্গ – নানা রাজ্যেই এ জিনিস বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে, রীতিমতো পরিসংখ্যান দিয়ে তারা সেটা দেখিয়েও থাকেন।
কিন্তু দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কর্নাটকে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে সেই তথাকথিত ‘মোদী ম্যাজিক’ যে একেবারেই কাজ করেনি, সেই হিসেবও কিন্তু আছে হাতের কাছেই।
ভোটমুখী কর্নাটকে নরেন্দ্র মোদী বারে বারে ফিরে গিয়েছিলেন, গোটা রাজ্যে তিনি মোট কুড়িটি জনসভা আর রোড শো করেছিলেন।
একটি রাজ্য পর্যায়ের ভোটে দেশের প্রধানমন্ত্রী এতটা সময় আর শক্তি ব্যয় করছেন, যা ছিল বেশ অস্বাভাবিক। কর্নাটক দখলে রাখতে তিনি যে মরিয়া ছিলেন, বোঝা যাচ্ছিল সেটাও।
অথচ এর মধ্যে রাজধানী ব্যাঙ্গালোর ছাড়া বাকি কোথাও বিজেপি দাগ কাটতে পারেনি। ব্যাঙ্গালোরের তিনটি আসন বাদ দিলে রাজ্যের যে আরও ১৭টি কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী প্রচার চালিয়েছেন, বিজেপি তার মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে জিততে পেরেছে।
বস্তুত কর্নাটক নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, ২০২৪-এ দেশের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা কতটা ব্যহত হতে পারে – ওই রাজ্যের ফলাফল সেই প্রশ্নও কিন্তু তুলে দিয়েছে।
কর্নাটকে কংগ্রেসের বিপুল বিজয়ের মধ্যে দিয়ে গোটা দক্ষিণ ভারত থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বিজেপি – ভারতের একটা বিরাট অংশে মোদীর দলের যে আবেদন বা গ্রহণযোগ্যতা নেই, সেটাও এখন স্পষ্ট।
বোধহয় তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হল, সফল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র পর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যেভাবে কর্নাটকে জয় ছিনিয়ে এনেছেন – সেটা তাঁকে মোদীর সত্যিকার চ্যালেঞ্জার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেবে বলেও অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন।
কিন্তু কর্নাটক ভারতে বিরোধী দলগুলোর ঐক্য প্রশস্ত করতে পারবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না – নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির জন্য সেটা অবশ্যই আশার কথা।
‘দ্য সাউথ ইন্ডিয়া স্টোরি’
দাক্ষিণাত্যের পাঁচটি বড় রাজ্যের মধ্যে (তামিলনাডু, কেরালা, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র) বিজেপি আজ পর্যন্ত শুধু কর্নাটকেই ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। গত ১৩ই মে দক্ষিণের সেই শেষ দুর্গও তাদের হাতছাড়া হল।
এখন তামিলনাডুতে ডিএমকে, কেরালায় সিপিআইএম, তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি, অন্ধ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং কর্নাটকে কংগ্রেস ক্ষমতায় – ভারতের রাজনীতিতে যে দলগুলোর সবই বিজেপির বিরোধী।
ব্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এস ওয়াই সুরেন্দ্র কুমার মনে করেন, দক্ষিণ ভারতে পায়ের তলায় শক্ত জমি খুঁজে পেতে বিজেপি যে জোরালো চেষ্টা চালাচ্ছিল কর্নাটকের পরাজয়ে তা বড় ধাক্কা খাবে।
“আঞ্চলিক নেতারা এখন নতুন উদ্যমে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন। তেলেঙ্গানায় অন্য পার্টি থেকে নেতাদের ভাঙিয়ে এনে বিজেপি যে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছিল, সেটাও অবধারিতভাবে হোঁচট খাবে”, বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে সব মিলিয়ে মোট ১৩০টি লোকসভা আসন আছে, যার মধ্যে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি মোট ২৯টি আসনে জিতেছিল।
অর্থাৎ সারা দেশে তাদের একার শক্তিতে পাওয়া মোট ৩০৩টি আসনের মধ্যে দশ শতাংশেরও কম এসেছিল দাক্ষিণাত্য থেকে। ২৯টির মধ্যে আবার কর্নাটক একাই বিজেপিকে দিয়েছিল ২৫টি আসন।
পরিসংখ্যান বলছে, এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ধারা লোকসভা ভোটেও অব্যাহত থাকলে আগামী বছর কর্নাটক থেকে বিজেপির ৬টি বা ৭টির বেশি লোকসভা আসন পাওয়া সম্ভব নয়।
ড: সুরেন্দ্র কুমারের মতে, “সংখ্যার বিচারে বিজেপির ক্ষতিটা হয়তো তত বিরাট হবে না, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সর্বভারতীয় আবেদনে এটা যে একটা বিরাট কালো দাগ তাতে কোনও সংশয় নেই।”
যে প্রধানমন্ত্রী উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতে বিজেপির চিরাচরিত প্রভাব বলয়ের বাইরেও দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন – পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব ভারতেও দলকে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছেন – তিনি কেন দেশের একটা বড় অংশে দাগ কাটতে পারছেন না এই প্রশ্নটা এখন উঠবে বলেই পর্যবেক্ষকরা অনেকে মনে করছেন।
কর্নাটকের ফলাফল বেরোনোর পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রেন্ড করছে ‘দ্য সাউথ ইন্ডিয়া স্টোরি’ – যাতে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণের কোনও রাজ্যেই কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় নেই।
এই ‘মিমে’র নামটাও ধার করা হয়েছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ থেকে – যে বিতর্কিত ছবিটির হয়ে প্রচার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে!
‘টিনা’ ফ্যাক্টরে ফাটল?
বিগত এক দশকে ভারতের রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর যে অপ্রতিরোধ্য ইমেজ গড়ে উঠেছে, তার একটা বড় দিক হলো ‘টিনা’ ফ্যাক্টর – অর্থাৎ ‘দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ’।
বিরোধী নেতাদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর টক্কর নেওয়ার মতো কোনও উপযুক্ত নেতাই নেই, বিজেপিও খুব সযত্নে ও সচেতনভাবে এই ন্যারেটিভটিকে প্রোমোট করে এসেছে।
মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিও ভারতের বিগত দু’টি সাধারণ নির্বাচনকে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের চেহারা দিতে অনেকটাই সফল হয়েছিল।
ফলে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের প্রধান নেতা কে, সেই প্রশ্নটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল – এবং সত্যি বলতে কী বিরোধী দলগুলোর কাছে তার কোনও জুৎসই জবাবও ছিল না।
কিন্তু কর্নাটকের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের পর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী নিজেকে মোদীর বিকল্প হিসেবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত তিনি যে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ করেছিলেন, সেই অভিনব জনসংযোগ সারা দেশেই যে কংগ্রেসকে উজ্জীবিত করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র একটা বড় অংশ গিয়েছিল কর্নাটকের ওপর দিয়ে, আর দেখা যাচ্ছে সে সব এলাকায় কংগ্রেস রীতিমতো ভাল ফল করেছে। রাহুল গান্ধী ভোটের প্রচারেও ওই রাজ্যের মাটি কামড়ে ছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস রাজনীতি কভার করছেন দিল্লির সাংবাদিক স্মিতা গুপ্তা। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “এমন কী বিজেপির নেতাকর্মীরাও কিন্তু রাহুল গান্ধীকে আর ‘পাপ্পু’ বলে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে পারছেন না। কারণ তারা জানেন, দেশ তাঁকে এখন সিরিয়াসলি নিচ্ছে।”
ফলে রাহুল গান্ধী একজন ‘পার্ট-টাইম পলিটিশিয়ান’ কিংবা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার অভাব আছে – কর্নাটকের ফলাফল তাঁর বিরুদ্ধে এই সব সমালোচনাকে হয়তো থামাতে পারবে।
এবং আগামী লোকসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদীও হয়তো প্রথম পাবেন সত্যিকারের একজন ‘চ্যালেঞ্জার’।
দুর্বল হবে ‘আইওইউ’?
দু’হাজার চোদ্দ এবং ২০১৯য়ে পরপর দুটি সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি সারা দেশে মোট প্রদত্ত ভোটের যথাক্রমে ৩১ শতাংশ ও ৩৭.৪ শতাংশ পেয়েছিল। কিন্তু তাতে একক ক্ষমতায় গরিষ্ঠতা পেতে তাদের কোনও সমস্যাই হয়নি।
রাজনৈতিক পন্ডিতরা অনেকেই বলে থাকেন, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভোট ভাগাভাগিই বিজেপির এই সাফল্যের একটা বড় কারণ।
‘বিরোধী ঐক্যের সূচক’ বা ‘ইনডেক্স অব অপোজিশন ইউনিটি’ (আইওইউ) যত দুর্বল হয়, ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ প্রথায় সবচেয়ে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীন দলটির জয় ততই সহজ হয় বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়।
এই মুহুর্তেও ভারতের বিভিন্ন বিরোধী দল আগামী সাধারণ নির্বাচনে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলায় লড়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে, অর্থাৎ বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিটি আসনে একজন বিরোধী প্রার্থীকে দাঁড় করাতে চাইছে।
কিন্তু কর্নাটকের নির্বাচনী ফলাফল সেই চেষ্টাকে সহজ করার বদলে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। কারণ, ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দল বিজেপিকে হারাতে চাইলেও কংগ্রেসও তাদের অন্যতম প্রতিপক্ষ।
বিরোধী জোট তৈরি হলেও সেটা কংগ্রেসের নেতৃত্বে হোক, এটা মমতা ব্যানার্জি, নীতিশ কুমার, অখিলেশ যাদব বা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মতো রাজ্য স্তরের নেতারা অনেকেই চান না। বিরোধীরা গরিষ্ঠতা পেলে এঁদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রিত্বেরও দাবিদার।
ফলে কর্নাটকে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব সাফল্য ওই দলটিকে বিরোধী জোটে নেতৃত্বের দাবিদার করে তুলবে – এই আশঙ্কাটা তাঁদের আছে পুরো মাত্রাতেই।
সম্ভবত এই কারণেই কর্নাটকের জয়ের পরও কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানায়নি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল। কে চন্দ্রশখর রাও বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা কংগ্রেসের বিজয়ে খুশি হয়েছেন, এমনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ফলে কর্নাটকে কংগ্রেসের বিজয় আগামী বছর বিরোধী ঐক্যের চেহারাকে আরও ছিন্নভিন্ন করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই – যেটা হয়তো নরেন্দ্র মোদীর জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দেবে!
সূত্র: বিবিসি