নাটোরে ককাটিয়েল পাখির জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক। কোকাটিয়েল পাখি বর্তমানে নাটোরে অনেকেই পালন করছে । অনেক সৌখিন পাখি পালক কোকাটিয়েল পালনে আগ্রহী হয়েছে এবং তারা লাভবান হয়েছে । তবে নাটোরের সৌখিন পাখি প্রেমিকরা বলছে, কোকাটিয়েলের দাম অনেক বেশি, তাই অনেক সৌখিন পাখি পালকের সখ থাকলেও সাধ্যের মধ্যে থাকছেনা। তবে নাটোরে উৎপাদন যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে কোকাটিয়েলের দাম কমতে পারে বলে মনে করেছে অনেকে।
কোকাটিয়েল একটি রাজকিয় পাখি, বিশ্বব্যপি খাচায় পালন করা পাখির মধ্যে জনপ্রিয়।ককাটিয়েল কাকাতুয়া পরিবারের একটি পাখি, ক্যারিওন এবং উইরো নামেও ডাকা হয়। তবে নাটোরে এটি ”ককাটেল” নামে পরিচিত । বন্য প্রজাতির ককাটিয়েল মূলত অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের এন্ডেমিক প্রাণী, এর বৈজ্ঞানিক নাম Nymphicus hollandicus । একে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কোথাও পাওয়া না গেলেও বিশ্বব্যাপি এটি খাঁচায় পোষা গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালিত হয়।
সহজে বাচ্চা উৎপাদন, সৌন্দর্য ও আরও কিছু কারণে এটি বাজিরিগার‘এর পরে, খাঁচায় পোষা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি ও Nymphicus গণ এর একমাত্র প্রজাতি । পূর্বে এটিকে ঝুঁটিওয়ালা তোতা বা ছোট কাকাতুয়া হিসেবে বিবেচনা করা হত । সাম্প্রতিককালের মলিকিউলার গবেষণা ককাটিয়েলকে এটির নিজস্ব উপগোত্র Nymphicinae তে অন্তর্ভুক্ত করেছে । এটি এখন কাকাতুয়ার পরিবার Cacatuidae গোত্রের ক্ষুদ্রতম উপগোত্র হিসেবে পরিচিত ।
ককাটিয়েলের উৎপত্তি ও বিচরণ অস্ট্রেলিয়ান জলাভূমি, বুনো ঝোপঝাড় ও গুল্মভুমিগুলোতে এদের আবাসস্থল । যেসব অঞ্চলে মরু, বিস্তৃত অনুর্বর ভূমি বা কিছুটা শুস্ক বিস্তীর্ণ ভূমি আছে, সেসব অঞ্চলে এদের বেশি দেখা গেলেও সবসময় পানির কাছাকাছি থাকে । এরা যাযাবর শ্রেণীর পাখি, যেখানে খাবার আর পানির প্রাচুর্য, সেখানে এরা উড়ে যেতে সময় নেয় না । প্রকৃতিতে ককাটিয়েলকে সাধারণত জোড়া বা ছোট ঝাঁক হিসেবে পাওয়া যায় ।
অনেক সময় অনেকগুলো ককাটিয়েলকে একসাথে ঝাঁক বেঁধে পানি খেতে দেখা যায় । অনেক কৃষকের কাছে এরা মূর্তিমান আতঙ্ক, প্রায়ই ক্ষেতে হামলা করে, চাষ করা ফসল খেয়ে আসে । অস্ট্রেলিয়ার অতি উর্বর দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সুবিশাল ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মরুভূমিতে এবং কেপ ইয়র্ক পেনিনসুলা উপদ্বীপে এরা অনুপস্থিত । ককাটিয়েল একমাত্র কাকাতুয়া প্রজাতি যারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম বছরের শেষের দিকেই বাচ্চা দেয়া শুরু করে দেয় ।
নাটোর শহরের আলাইপুর মহল্লার সৌখিন পাখি পালক মো. আমিনুল ইসলাম (সুমন) জানান, কোকাটিয়েল একটি রাজকিয় পাখি । কোকাটিয়েল বিশ্বব্যপি খাচায় পালন করা পাখির মধ্যে জনপ্রিয় পাখি। বর্তমানে নাটোরে এই পাখি পালনে জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। তিনি সখেই খাচায় পাখি পালন করতেন।তবে তিনি বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বানিজ্যক ভাবে পালন করেন। পাখি কেনা বেচা করেন তা থেকে তার বেশ আয় হয়।
তিনি আরো বলেন, কোকাটিয়েল বর্তমানে নাটোরে অনেকেই পালন করেছে । অনেক সৌখিন পাখি পালক কোকাটিয়েল পালনে আগ্রহী হয়েছে এবং তারা লাভবান হয়েছে । কোকাটিয়েল পাখি রং ও জাতে ভিন্নতা আছে সেক্ষেত্রে দামে কম বেশি আছে। যেমন গ্রেটার সর্বনিন্ম একজোড়া বাচ্চার দাম ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত , লুটোনো ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা ,স্বর্ন ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা , এলভিনিয় ৪০০০ থেকে ৪৫০০ টাকায় বর্তমানে নাটোরে কেনা বেচা হচ্ছে।
এছারা ইউমেনো ,লোটনো, নট , পাইল , হোয়াইট, পাল, হোয়াইট ফেজ সিলভারসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রকার ভেদে দাম। তবে ফিঞ্চ , বাজরিগার পাখির তুলনায় কোকাটিয়েলের দাম বেশি। তাই অনেক সৌখিন পাখি পালকের সখ থাকলেও সাধ্যের মধ্যে থাকে না। তবে নাটোরে উৎপাদন যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে দাম কমতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
নাটোরের সৌখিন পাখি পালক, অ্যাড, সৈয়দ মোজাম্মেল হোসেন মন্টু জানান, তিনি সখে পালন করেন পাখি। পাখিদেরকে খাওয়ার দেন পরিচর্চা করেন, তাতে তার মনে প্রফুল্লতা আসে। বাণিজ্যিক ভাবে পাখি পালনের ইচ্ছা তার নেই। তবুও আয় হয় , সেই আয় থেকে পাখির খাদ্য ও ঔষধ কেনার কাজে ব্যয় করেন। তিনি কোকাটিয়েল পাখি একজোড়া ঢাকা থেকে কিনেএনে ছিলেন। এখন তার কাছে ৪ জোড়া কোকাটিয়েল আছে বলে জানালেন তিনি।
রোজি মোজ্জামেল মহিরা কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগিয় প্রধান সায়মা চৌধুরী রোশনী জানান, ককাটিয়েল এখন Cacatuidae পরিবারের জৈববৈজ্ঞানিকভাবে শ্রেণীবিন্যাসকৃত সদস্য । কাকাতুয়া পরিবারের জৈবিক বৈশিষ্ট্য যেমন, খাঁড়া ঝুঁটি, পিত্তাশয়, নিচের দিকের পাউডার পালক, পালকে সাজানো নীল ও সবুজ রঙয়ের মাঝে চাপা মেঘের মত স্তর এবং ঠোঁটের চারপাশে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মুখের পালক যেগুলো Cacatuidae গোত্রের বাইরে খুব কম দেখা যায়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ককাটিয়েলের মধ্যে পাওয়া যায় ।
এখন এটিকে এটির মনোটাইপিক উপগোত্র Nymphicinae এ শ্রেণীবদ্ধ করা হলেও আগে এটিকে লম্বা লেজের তোতাদের গোত্র Platycercinae এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল । পরে এই সমস্যাটি আনবিক গবেষণার মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছিল । তিনি আরো বলেন নাটোরে এই কোকাটেল পাখি শৈখিন ভাবে পালন করা হচ্ছে,যদি এই পাখি বাণিজ্যিক ভাবে পালন করা হয়, খামারিরা খামারে বচ্চা উৎপাদন করে, তবে লাভবান হওয়ার সম্ভবনা আছে । সেক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে প্রচার প্রচারনায় উদ্ভদ্ধ করার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন ।
গোল-ই-আফরোজ কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো.সাইফুল ইসলাম বারনইকে জানান, ১৭৯৩ সালে সর্বপ্রথম স্কটিশ লেখক ও প্রকৃতিবিদ রবার্ট কের ককাটিয়েলের দ্বিপদ নামকরণ করেন । মূলত তিনি ককাটিয়েল বা ককাটিল কে Psittacus hollandicus নামে বর্ণিত করেন । পরবর্তীতে ভাগলার ১৮৩২ সালে ককাটিয়েলকে এটির নিজস্ব গণ Nymphicus এ লিপিবদ্ধ করেন । ককাটিয়েল এর বৈজ্ঞানিক নাম Nymphicus hollandicus হবার পেছনে একটি সুন্দর গল্প আছে ।
ইউরোপের পাখি দেখার দলগুলোর মধ্যে প্রথম দিককার একটি দল, যারা পাখিদের, তাদের নিজেদের বাসস্থানে পর্যবেক্ষণ করতে বেড়িয়েছিল; তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে ককাটিয়েলের গণ নামটি এসেছে । প্রথমবার পাখিটিকে দেখার পর তারা এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে, পৌরাণিক জলপরী নিম্ফের নামে এটির নামকরণ করে ফেলেন । অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক নাম New Holland থেকে ককাটিয়েল প্রজাতির Specific name hollandicus নেয়া হয়েছে ।
প্রোটিন অ্যালোজাইমের উপর ১৯৮৪ সালের একটি গবেষণা থেকে জানা যায় প্রজাতি হিসেবে ককাটিয়েল তোতাদের চাইতে কাকাতুয়ার খুব কাছাকাছি সম্পর্কের । যেহুতু কোকাটেল পাখির বাজার মূল্য বেশি, সেহেতু উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। সৌখিন পাখি পালকদের ক্রয় সীমার মধ্যে থাকলে উৎপাদন বেশি হবে। আর দাম কম হলে অন্য জেলার পাইকার বা ক্রেতা নাটোরে আসবে তাই সরকারি ভাবে ও ব্যক্তি উদ্যোগে পাখিটি সম্পর্কে নাটোরে ব্যাপক প্রচার করা দরকার বলে তার মনে হয়।
নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা সরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক ও প্রvণীবিদ্রা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এ.টি.এম.মাহাবুবুল হান্নান জানান, বর্তমানে নাটোরে অনেকে সখে পালন করছে ককাটিয়েল। খাঁচাবন্দি ককাটিয়েল সাধারণত ১৬ থেকে ২৫ বছর বাঁচে । রেকর্ড অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে ককাটিয়েল ১০ থেকে ১৫বছর বাঁচে; ককাটিয়েলের ৩২ বছর বেঁচে থাকারও রেকর্ড আছে । একটি ককাটিয়েল পাখি অবশ্য ৩৬ বছর বেঁচে ছিল বলে তিনি জানেন।
এগুলো সাধারণত নির্ভর করে খাবার, পরিবেশ আর ওড়ার জায়গার উপর প্রকৃতিতে বাচ্চা ককাটিয়েলকে নর, নারিতে আলাদা করা খুব কঠিন । ডিম ফোটার পর থেকে প্রথম পালক বদলানোর আগ পর্যন্ত, সব বাচ্চা ও অল্পবয়স্ক ককাটিয়েলকে দেখতে, নারির মত লাগে । এদের লেজের পালকের অঙ্কিয় তলে আনুভূমিক হলুদ রঙ্গের, সরু রেখা বা চিকন দাগ দেখা যায় । পাখায় ওড়ার প্রাথমিক পালকের অঙ্কিয় বা নিচের দিকে বিন্দু বিন্দু হলুদ রঙ্গের ফোঁটা থাকে । মাথা ও ঝুঁটি ধূসর রঙ্গের হয় এবং প্রত্যেক বাচ্চার গলায় হাল্কা কমলা রঙ্গের দাগ থাকে ।
বেশিরভাগ পাখিপ্রজাতির মধ্যেই যৌন দ্বিরুপতা বিদ্যমান । প্রাপ্তবয়স্ক ককাটিয়েল যৌন দ্বিরুপী হয় । ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার ছয় থেকে নয় মাসের মাথায়, ককাটিয়েল প্রথমবার পালক বদলায় ।তিনি আরো বলেন নাটোরে অর্থনৈতিক সফলতা আনতে উদ্যোক্তা তৈরি করা দরকার বলে তার মনে হয়। তিনি মনে করেন নাটোরে কবুতর এর সফল ব্যবসা হয়। বিভিন্ন জেলায় নাটোরের উৎপাদিত কবুতর রপ্তানি হয়। তেমনি ভাবে কোকাটেল পাখি থেকে নাটোরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
জেলা প্রানীসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো. গোলাম মোস্তফা জানান, কোকাটিয়েলের সাধারনত তেমন কোন রোগ হয় না। সঠিক সময়ে খাদ্য পরিচর্চা করা হলে সারা বছর সুস্থ থাকে, তবে বছরে সর্বচ্চ তিন বার ব্রিফিং করতে দেওয়া দরকার, যদি বেশি ব্রিফ করে সেক্ষেত্রে কোকাটিয়েল হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়।তিনি আরো বলেন, নাটোরে অনেকে সৌখিনতায় পালন করছে কোকাটিয়েল পাখি। সৌখিন পাখি পালকরা যাদি বানিজ্যিক ভাবে এই পাখি পালন করে তবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যাদি কেউ কোকাটিয়েল পাখির খামার গড়ে, তবে খামারিকে সার্বিক সহযোগীতা করা হবে বলে তিনি জানান।