পুলিশের কব্জায় যেভাবে এলেন ফেরার খালিস্তানপন্থী নেতা অমৃতপাল সিং
রবিবার সাতসকালেই পাঞ্জাবের মোগা জেলার রোডে গ্রামটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল পাঞ্জাব পুলিশের বিরাট দল। তাদের কাছে খবর ছিল, গত ৩৭ দিন ধরে পলাতক খালিস্তানপন্থী নেতা অমৃতপাল সিং লুকিয়ে আছেন ওই গ্রামটিতেই।
রোডে গ্রামটি পাঞ্জাবে খুব পরিচিত, কারণ এটিই খালিস্তানি আন্দোলনের জনক জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের জন্মস্থান।
ঘটনাচক্রে গত বছর এই গ্রামেই আয়োজন করা হয়েছিল অমৃতপাল সিংয়ের ‘দস্তরবন্দী’ (নেতৃত্বের পাগড়ি বাঁধার অনুষ্ঠান), যার পর তিনি ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’ গোষ্ঠীর নতুন নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
সেই দস্তরবন্দীর প্রায় সাত মাস পর রোডে গ্রামের গুরদোয়ারাতেই তিনি শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।
এরপরই পাঞ্জাব পুলিশের পক্ষ থেকে টুইটারে পোস্ট করা হয়, অমৃতপাল সিংকে মোগাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।
বিকেলের দিকে পাঞ্জাব পুলিশের আইজি (মহাপরিচালক) সুখচেইন সিং গিল বলেন, “অমৃতপাল সিং যে রোডে গ্রামেই আছেন, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “তাকে এমনভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছিল যে অমৃতপাল সিং-য়ের পালানোর কোনও উপায় ছিল না।”
অর্থাৎ পুলিশ প্রধান দাবি করেছেন, অমৃতপাল সিং স্বেচ্ছায় নন – বরং বাধ্য হয়েই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
গ্রেপ্তারের পরই ডিব্রুগড়ে
অমৃতপাল সিং আত্মসমর্পণ করার কিছুক্ষণ পরই তাকে দেশের অন্য প্রান্তে আসামের ডিব্রুগড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিব্রুগড়ের শতাধিক বছরের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সবচেয়ে সুরক্ষিত জেল হিসেবে পরিচিত। সেখানেই রাখা হয়েছে হাই-প্রোফাইল বন্দী অমৃতপাল সিংকে ।
অমৃতপাল সিংয়ের আটজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীকে গত মাস থেকেই গ্রেপ্তার করে ওই জেলে রাখা হয়েছে এবং তাদের আটক রাখা হয়েছে ন্যাশনাল সিকিওরিটি অ্যাক্টের (জাতীয় নিরাপত্তা আইন) আওতায়।
এই কঠোর আইনটির বলে কোনও চার্জ না-এনেই যে কোনও ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়। খালিস্তানপন্থী নেতা অমৃতপাল সিংয়ের বিরুদ্ধেও একই আইন প্রয়োগ করা হবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইতিমধ্যে পাঞ্জাব পুলিশ অবশ্য রাজ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
তারা আরও বলেছে, ভালভাবে যাচাই-বাছাই না-করে কেউ যেন কোনও তথ্য শেয়ার না-করেন এবং ‘ফেক নিউজ’ না-ছড়ান। গ্রেপ্তারের পর অমৃতপাল সিংকে পাঞ্জাব পুলিশ যখন আজ নিজেদের হেফাজতে নিচ্ছে, সেই সময়কার ছবিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওই ছবিতে অমৃতপাল সিংকে শিখদের সাদা ধর্মীয় উত্তরীয় (রোব) পরিহিতি অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এর আগে গত ১৮ মার্চ থেকে অমৃতপাল সিংয়ের সন্ধানে পাঞ্জাব পুলিশ কার্যত গোটা দেশে তল্লাসি অভিযান চালাচ্ছিল।
১৮ মার্চ বিকেলে জলন্ধরের কাছে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই খালিস্তানপন্থী এই নেতা লাপাত্তা ছিলেন। অবশেষে ৩৭ দিনের মাথায় তার সন্ধান মিলল।
কে এই অমৃতপাল সিং
মাত্র মাসকয়েক আগেও বাকি ভারতে কেন, এমনকী পাঞ্জাবেও কেউ অমৃতপাল সিংয়ের নাম শোনেননি। অমৃতসরের কাছে জাল্লুপুর খেড়া গ্রামের এই যুবক স্কুলের গন্ডি পেরিয়েই বছরদশেক আগে পরিবারের ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা দেখতে দুবাই পাড়ি দিয়েছিলেন। ভারতের পাসপোর্টধারী হলেও তিনি কানাডারও পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট।
ভারতে কৃষক আন্দোলনের সূত্র ধরে যিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন, পাঞ্জাবের সেই গায়ক অ্যাক্টিভিস্ট দীপ সিধু ইতোমধ্যে ২০২১র শেষ দিকে ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন বা এনজিও তৈরি করেছিলেন।
পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় দীপ সিধুর মৃত্যু হলে ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’তে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সংগঠনটি ভেঙে একাধিক টুকরোও হয়ে যায়।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’-র একটি গোষ্ঠী তাদের নতুন নেতা হিসেবে বেছে নেয় অমৃতপাল সিং-কে, যিনি তার মাত্র কিছুদিন আগেই ভারতে ফিরে এসেছিলেন।
ভিন্দ্রানওয়ালের নামাঙ্কিত গুরদোয়ারাতেই সেদিন ব্যবস্থা হয়েছিল লঙ্গরের, যেখানে হাজার হাজার লোক ‘সেবা’ পেয়েছিলেন।
সেদিনের পর থেকেই অমৃতপালের অনুগামীরা তাকে ভিন্দ্রানওয়ালের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছেন, মিডিয়াতেও তাকে ভিন্দ্রানওয়ালে ২.০ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একাধিক সাক্ষাৎকারে ও বক্তৃতায় এই তরুণ নেতা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি গুরু ভিন্দ্রানওয়ালের মতোই খালিস্তানের পক্ষে লড়ে যাবেন। তাঁর ধর্মীয় বক্তৃতা শুনতে সভায় প্রচুর ভিড়ও হচ্ছে।
সভা-সমিতিতে বা জলসায় অমৃতপাল সিং বারেবারে একটা কথাই বলছেন, “শিখদের মধ্যে গত দেড়শো বছর ধরে ক্রীতদাসের মনোভাব ঢুকে গেছে। আগে তারা ছিল ব্রিটিশদের দাস, এখন তারা হয়েছে হিন্দুদের দাস – এই অবস্থা পাল্টে দিয়ে শিখ শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে।”
সব সময় খুব ঘনিষ্ঠ দশ-পনেরোজন অনুচর পরিবৃত হয়ে ঘোরাফেরা করতেন অমৃতপাল সিং, তার কনভয়েও থাকত অন্তত আধাডজন এসইউভি। আর ভিন্দ্রানওয়ালের মতোই সব সময় তার কোমরে থাকত তরবারির সাইজের পেল্লায় একটি কিরপান।
গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি এই অমৃতপাল সিংয়ের বেশ কয়েকশো সশস্ত্র অনুগামী অমৃতসরের কাছে আজনালাতে তাদের এক সহকর্মীকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশ থানায় আক্রমণ চালায়। হামলার সময় তাদের মুখে ছিল খালিস্তানের স্লোগান।
আগ্নেয়াস্ত্র ও কিরপান নিয়ে চালানো সেই হামলায় বহু পুলিশ কর্মী ও কর্মকর্তা আহত হন।
এর কিছুদিন পরেই কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাঞ্জাবের আম আদমি পার্টি সরকার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় অমৃতপাল সিংকে ধরার জন্য অভিযান চালানো হবে। এরপর আজ (রোববার) তাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
সূত্র: বিবিসি বাংলা