এক
জয়তুন দুই মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট একটা ছনের ঘরে থাকে। আকাশটা কাঁদলে পিচ্ছিল হয়ে যায় তার ঘরের মেঝে। পিচ্ছিল হয়ে যায় তার জীবন। জয়তুনের স্বামী রতন মিয়া সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া গিয়ে এখন নিখোঁজ। দালাল শাহিদ আলীকে রতনের কথা জিজ্ঞেস করলেই সে ভীষণ খেপে যায়। বাল্যপাঠের মুখস্ত ছড়ার মতো আওড়ায়- মালয়েশিয়া গিয়ে রতন মালয় এক তরুণীকে কুকাম করে এখন জেলের ঘানি টানছে। এসব কথা অবশ্য জয়তুনের বিশ্বাস হয় না। মানুষটার জন্য রাতের আঁধারে টলটল করে চোখ থেকে জল পড়ে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আরো একটা সকাল আসে। আরো একটা দিন শেষ করার যুদ্ধে নামে জয়তুন।
দুই
একুশের ঘরেই দুই সন্তানের মা-জয়তুন। বাল্যবিয়ে ও অভাব তার মুখের জ্যোতিটা আড়াল করেছে বটে। তবে এখনো তাকে অবিবাহিত তরুণী বলে হরহামেশাই চালিয়ে দেয়া যাবে। মাতুব্বর বাড়িতে সারাদিন খেটেখুটে যা পায় তা দিয়েই চলে অভাবের সংসার। মাতুব্বরের বউ আছমা বানুকে বড়’মা বলে ডাকে জয়তুন। এই মায়ার ডাক শুনে আছমা বানু তাকে কিছু সুবিধাও দেন। করোনাভাইরাসের জন্য সরকার সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করছে। খুব ছোঁয়াচে নাকি রোগটা! তাই এই ক’দিন বড় মা জয়তুনকে কাজে আসতে মানা করেছে।
গত দুইদিনের ক্ষুধায় অবুঝ মেয়ে দুটো শিকড়কাটা লাউয়ের ডগার মতোই নেতিয়ে পড়েছে। মেয়েদের কান্নাকাটি জয়তুনের বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হচ্ছে। ছেঁড়া শাড়ির আঁচল টেনে বড় একটা গোমটা দিয়ে ত্রাণের জন্য স্কুল মাঠে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায় সে। কিন্তু মেম্বারের কুপ্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বলে লাইন থেকে বের করে দিয়েছে। বাকিতে যে দু’মুঠো চাল কিনবে- তার কোনো ব্যবস্থা নেই। করিমের মুদিঘর বন্ধ। উপায় না পেয়ে মাতুব্বর বাড়ির দিকেই হাঁটে জয়তুন। মোমেন মাতুব্বর বারান্দায় বসে পান খাচ্ছিলেন। জয়তুনকে দেখেই মাতুব্বর লুঙ্গি টেনে একটু নড়েচড়ে বসলেন।
– বড় মায়রে দেখতাছি না, চাচা! মায় কই?
– বড় মাইয়ার প্রসবের বেদনা উঠছে নাকি। তারে দেখতে রসুলপুর গেছে। কিয়ের লাইগা আইছোত? আমারে ক।
– চাচা, আপনি তো আমার বাবার মতোই। আপনেরেই কই। ঘরে দুইদিন ধইরা কোনো দানা নাই। মাইয়া দুইডার কান্দোন আর সহ্য করতে পারতাছি না। তাই যদি কিছু চাইল……
– আইচ্ছা, দুই ডিব্বা চাইল আর চাইর পাঁচডা আলুও দিমু নে। একটা কাম কর, যাওয়ার আগে আমার বাম পাওয়ে একটু গরম তেল মালিশ কইরা দিয়া যা। পুরান বাতের বেদ্নাডা মাতা চাড়া দিয়া উঠছে রে, জয়তুন। তুই ছাড়া এই বেদ্না কমতো না।
তিন
জয়তুন মাতুব্বর বাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যাচ্ছে। তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। নিজের শরীরের বিরুদ্ধে বাড়ির দিকে সে দৌঁড়াচ্ছে। আঁচলে চাল আর আলু।বাড়িতে এসেই হাঁড়িতে চাল দেয়। চুলাতে আগুন ধরে। গরম ভাতের গন্ধটা জয়তুনের বেশ ভালো লাগে। মেয়ে দুটো পেট ভরে ভাত খাচ্ছে। মা হিসেবে এই দৃশ্যটা দেখা ভীষণ আনন্দের। সন্ধ্যায় মেয়েরা ভাত ঘুমে বিভোর। মেয়েদের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে জয়তুন। মেয়ে দুটো পরীর মতো। দেখলেই খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু ঘৃণায় হাত সরিয়ে নেয় সে। বমি বমি লাগছে তার। শরীরটা যেন ঘুলিয়ে আসছে । সন্ধ্যার অন্ধকার মিশে যাচ্ছে পুকুরে। সেই জলে জয়তুনের নিজের মুখটা খুঁজে। ছোট ছোট ঢেউয়ে কাঁপে একটা অস্পষ্ট মুখ। বড়ই অচেনা সেই মুখ। আঁতকে উঠে জয়তুন। গলা পানিতে নেমে যায় সে। ইচ্ছেমত ডুব দেয়। তবুও নিজেকে খুব অপরিষ্কার লাগছে। নিজের বাড়ন্ত শরীরের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে খুব। মুখ ভরে থুতুর দলা আসছে।
সকালে জয়তুনের ঘরের সামনে শ’খানেক মানুষের ভীড় করে আছে। দু’জন কনস্টেবল ঘরের আড়া থেকে তিনটা ঝুলন্ত লাশ নামিয়ে মাটিতে রেখেছে। এই লাশ জয়তুনকে দেখে বড্ড ভয় করছে মেম্বারের। তার কামুক চোখে এখন কোনো উত্তাপ নেই। মাংসল শরীরের জয়তুনকে গতকালের মত জোর করে আজ আর চাটতে চাচ্ছে না মাতুব্বর। বরং জয়তুনের জিহ্বা বের করা লাশ দেখে সেও ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ফাঁসের মানুষ নাকি ভূত হয়ে আবার ফেরত আসে! মাতুব্বর মাথার টুপিটা ঠিকঠাক করছে। তজবিহতে রাখা তার আঙুলগুলো দ্রুত লয়ে চলছে। সাংবাদিকেরা বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তুলছে। আগামীকাল হয়তো খবরের কাগজের শিরোনাম লেখা হবে-‘দুই মেয়েসহ অভাবী মায়ের গলায় দড়ি।’
অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন, প্রিয়জন।