বইয়ের ভাঁজে ছবিটা পেয়েই মোবাইলে ছবি তুলে নিয়েছিলাম। অফিসে গিয়ে সম্রাটকে দেখাতেই সম্রাট থ’। একটু লজ্জাও পেয়ে গেল। কারণ, ওর গায়ে তখন কোনও জামাকাপড় নেই। আমার কোলে।
আসলে এই ছবিটি কবে তোলা হয়েছিল আমার এখন আর মনে নেই। আমি তখন সম্ভবত ইলেভেন-টুয়েলভে পড়ি। শান্তনুদা, মানে কাস্তেকবি দিনেশ দাসের ছেলে শান্তনু দাস তখন বাংলা কবিতা এবং পত্রপত্রিকা শাসন করছেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে প্রথম অফসেটে ছাপা বাংলা পত্রিকা— ক্ল্যাপস্টিক। সেই পত্রিকার সম্পাদক শান্তনু দাস। আমি সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। শান্তনুদার সঙ্গে যেতাম সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবনারায়ণ গুপ্ত, উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী, শিবনারায়ণ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি।
শীর্ষেন্দুদা তখন থাকতেন যাদবপুরের কালীবাড়ি লেনে। আমি, শান্তনুদা এবং আমাদের পত্রিকার ফোটোগ্রাফার যখন ওই বাড়িতে ঢুকছি, ফোটোগ্রাফার নিয়ে যাওয়ার কারণ, শান্তনুদাই প্রথম শুরু করেছিলেন কবি-লেখকদের ছবি-সহ লেখা প্রকাশ করা। তাই, আমরা ঢুকতেই যখন দেখলাম একটি বছর খানেকের ছোট্ট ছেলেকে দরজার সামনে বসে গামলায় করে স্নান করাচ্ছেন শীর্ষেন্দুদা, তখন আমাদের ফোটোগ্রাফার সঙ্গে সঙ্গে সেটার ছবি তুলে নিয়েছিল।
লেখা নিয়ে কথাবার্তা বলার পর শুরু হল ছবি তোলা। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, তখনও মোবাইল আসেনি। ছবি তোলা ছিল বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। শীর্ষেন্দুদার মেয়ের বয়স তখন নয় কি দশ। বৌদি-সহ গ্রুপ ছবিও তুলেছিলাম। শীর্ষেন্দুদার ছেলেকে যখন আদর করে কোলে তুলে নিয়েছিলাম, আমাদের ফোটোগ্রাফার ঝপ করে সেই ছবিটাও তুলেছিল।
এই কিছুদিন আগে সম্রাটের মুখে এই ছবির কথা শুনে শীর্ষেন্দুদা আমার কাছে এক কপি চেয়েওছিলেন।
তাঁর জীবনের প্রথম দু’টি গল্প দেশ পত্রিকার দপ্তর থেকে ফেরত এসেছিল। তখন ভীষণ ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলেন তিনি। জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমনকী একসময় আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্তও নেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর মা-বাবা তাঁকে মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য্য শ্রীশ্রী অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের কাছে নিয়ে যান। ঠাকুরের সান্নিধ্যে জীবন বদলে যায় তাঁর। তিন নম্বর গল্পটি পাঠানোর পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এটা যদি ছাপা না হয়, তা হলে তিনি আর লেখালেখি করবেন না। ‘জলতরঙ্গ’ নামে সেই তৃতীয় গল্পটিই অবশেষে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেটাই ছিল শীর্ষেন্দুদার প্রথম মুদ্রিত গল্প।
সাগরময় ঘোষের তাগাদায় প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ লিখেছিলেন তিনি। আসলে ঘুণপোকার শ্যামল চরিত্রটি অনেকটা তাঁর নিজের আদলেই গড়া।
শিশু-কিশোরদের জন্য কোনও কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল না শীর্ষেন্দুদার। কিন্তু আনন্দমেলার তৎকালীন সম্পাদক ও বিশিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে লেখা শুরু করেন প্রথম কিশোর গল্প। এমনকী নীরেনদা অনেকটা জোর করেই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেন প্রথম কিশোর উপন্যাস, যেটা পরবর্তিকালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যায়— ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’। এই উপন্যাসের ঠাকুরমার চরিত্রটিও সরোজিনী দেবী নামে তাঁর এক বিধবা ঠাকুরমার আদলে গড়া।
শীর্ষেন্দুদার তিনটি বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস— ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’, ‘ছায়াময়’ ও ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ নিয়ে বানানো হয়েছে তিনটি সিনেমা এবং তিনটিই বক্স অফিস মাৎ করেছে। তাই তাঁর লেখায় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের প্রভাব সবচেয়ে গভীর ও ব্যাপক। তিনি নিজেই বলেছেন, আমার জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছেন তিনি। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে ঠাকুর আমার জীবনের প্রধানতম উপকরণ। তবে আমার লেখার মধ্যে সেটা প্রকটভাবে থাকে না। মানে এমন নয় যে, আমাকে একটা প্রচারকের ভূমিকা নিতে হবে। মানুষের নানারকম বিচ্যুতি-ব্যথা, দুঃখ-বেদনা, পাপ-পুণ্য, প্রেম-ভালবাসা— ঠাকুর তো সবখানে জড়িয়ে আছেন। মানুষের কথা যখন বলছি, তখন ঠাকুরের কথাই বলা হচ্ছে।
শীর্ষেন্দুদা এই মুহূর্তে প্রথিতযশা লেখক হয়ে উঠলেও তিনি কিন্তু সারাক্ষণ লেখা নিয়ে বসে থাকেন না। এ ব্যাপারে তিনি ভীষণ অলস। লেখার অনুরোধ এলে তার পরই তিনি ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন। আরও অনেক পরে লেখায় হাত দেন এবং আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, উনি লেখা জমা দেন সবার শেষে। তাই শীর্ষেন্দুদাকে নিয়ে রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাগরময় ঘোষদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না।
শীর্ষেন্দুদার সমসাময়িক লেখক বন্ধুদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তবে তুই-তোকারির সম্পর্ক ছিল শুধু সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সঙ্গে। মুস্তাফা সিরাজের অতিমাত্রায় ‘কর্নেল সিরিজ’-এ ঝুঁকে পড়াকে মানতে পারেননি শীর্ষেন্দুদা। এ জন্য সিরাজকে তিনি মাঝে মধ্যে ভর্ৎসনাও করতেন। কারণ তিনি মনে করতেন,‘কর্নেল সিরিজ’ লেখা কমিয়ে দিলে সিরাজের কাছ থেকে ‘অলীক মানুষ’-এর মতো আরও ভাল ভাল লেখা পাওয়া যেত।
সুনীলদা, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে রবিবার রবিবার আড্ডা দেওয়ার সময়, সুনীলদা আমাদের সবার সামনেই একদিন বলেছিলেন, শীর্ষেন্দু আমার থেকে অনেক অনেক বড় মাপের লেখক। এটা শুনে কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন, এটা বন্ধুকৃত্য। সুনীলদার উদার মনের পরিচয়। কিন্তু সুনীলদা যে সত্যি সত্যিই শীর্ষেন্দুদাকে খুব বড় মাপের লেখক মনে করতেন তা আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রমাণ পেয়েছি।
মনে আছে, একবার শীর্ষেন্দুদা মিনিবাসে করে ফিরছিলেন। যোধপুর পার্কে নামবেন বলে ঢাকুরিয়া বাসস্টপ থেকে সিট ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন লোক এমনভাবে দাঁড়িয়েছিলেন যে শীর্ষেন্দুদার পক্ষে দরজার কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁকে জায়গা দিতে বললেও তিনি এতটুকুও না সরায় শীর্ষেন্দুদা জোর করে নামতে যাচ্ছিলেন। এই নিয়ে বচসা বাধে। যে লোকটি শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে অভব্য আচরণ করছিলেন, তাঁর হাতে ধরা ছিল শীর্ষেন্দুদারই একটি উপন্যাস। সেটা দেখে রূপক, মানে আমার এক সময়ের সহকর্মী, কবি রূপক চক্রবর্তী বলে উঠেছিল, আপনি কি জানেন আপনি কাকে এই সব কথা বলছেন? সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষেন্দুদা ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে রূপককে ঈশারা করে তাঁর নামটি বলতে বারণ করেছিলেন।
শীর্ষেন্দুদার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে। সেই শৈশবস্মৃতি তিনি খুব সুন্দর ভাবে লিখেছেন তাঁর ‘উজান’ উপন্যাসে। ওই উপন্যাসের মধুসূদন মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রটি আসলে তাঁর নিজেরই চরিত্র।
‘পার্থিব’ উপন্যাসে তিনি লিখেছিলেন, ‘মাটি থেকে ইট হয়, ইট থেকে বাসা— বাসা পুরাতন হয়ে ভেঙে যায়।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ওপার বাংলার ময়মনসিংহ থেকে বাসাবাড়ি গুটিয়ে একদিন পরিবার-সহ চলে আসেন কলকাতায়। এই কলকাতাতেই তাঁর লেখক হয়ে ওঠা। ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরের বছরই তিনি তাঁর বান্ধবী সোনামন চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন। তাঁর এক মেয়ে আর এক ছেলে। এই ছেলের নামই সম্রাট। সম্রাট মুখোপাধ্যায়। যার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখা।
নিজের লেখালিখি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন— হঠাৎ একটা লাইন এসে যায়। ওই যেমন তুলোর থেকে একটা একটা করে সুতো বেরিয়ে আসে, তেমনি ওই লাইন থেকে শব্দেরা ভিড় জমায়। ভাবনা শুরু হয়, চরিত্র আসে, ঘটনা আসে। আমি শব্দ দিয়ে ছবি দেখতে আরম্ভ করি।
১৯৭৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরিজীবন শুরু করার আগে মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড়ের একটি বিদ্যালয়ে তিনি কিছু দিন শিক্ষকতা করেছিলেন। তার পর ১৯৬১ সালে তাঁর প্রকৃত কর্মজীবন শুরু হয় কালীঘাট ওরিয়েন্টাল একাডেমিতে। যদিও সেই স্কুলবাড়িটি এখন আর নেই। বহুতল বাড়ি হয়ে গেছে।
শীর্ষেন্দুদার জন্যই সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যের মুকুটে নতুন একটি পালক জুড়ল। সাহিত্য অ্যাকাডেমির ‘ফেলো’ নির্বাচিত হয়েছেন ‘মানবজমিন’-এর স্রষ্টা। ‘অমর সাহিত্যের স্রষ্টা’দের এই বিরল সম্মানে ভূষিত করে সাহিত্য অ্যাকাডেমি। বলা যায়, এটি সাহিত্য অ্যাকাডেমির সর্বোচ্চ সম্মান। এর আগেও একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বিদ্যাসাগর পুরস্কার (১৯৮৫), আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩ ও ১৯৯০)। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গবিভূষণ সম্মানও পান গোয়েন্দা কাহিনির এই ভক্ত।#