পাঁচ পাপড়ির সাদা ফুল, ভেতরের দিকে হলুদ আভা। গাছের উচুঁ ডালে লম্বা সবুজ পাতার মধ্যে উঁকি দেয় থোকায় থোকায়, সঙ্গে মিষ্টি গন্ধ। ফুলটির নাম কাঠকরবী। নান্দনিক আভিজাত্য সম্পন্ন এই ফুলটি সকলের বেশ পরিচিত। কাঠকরবীর আগমনকাল বেশ প্রাচীন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় নাটোর রাজবাড়ির গাছগুলোর দিকে তাকালে। নাটোর শহরের বিভিন্ন জায়গায় এক সময় প্রচুর পরিমানে গাছগুলোর দেখা গেলেও, কালের প্রক্রিমায় বিলুপ্তির পথে আজ কাঠকরবী।
কাঠকরবী নামে পরিচতি ফুলটি কয়েক রকমের দেখতে। কোনটা একেবারেই সাদা। আবার কোনটা হলুদ। তবে হলুদ আভায় রাজকীয়ভাব নিয়ে থাকা এই জাতটিই নাটোরে বেশি দেখা যায়। নাটোরের অনেক ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে থাকা এই গাছগুলো নীরবেই হারিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কোন খেয়ালই নেই কারও। খোদ যাদের হাতে দায়িত্ব সেই হর্টিকালচারের কাছেই নেই কাঠকরবীকে সংরক্ষণ করার কোন উদ্যোগ।
ইতিপূর্বে নাটোর পৌরসভার, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ, মহারাজা হাইস্কুলের সামনে, অনেক মন্দিরের আঙিনায়, লালবাজার, হরেনের মোড়, উপরবাজার পৌর ভুমি অফিসের সামনে, কাপুড়িয়াপট্টি, ঘোষপাড়া ও পুরাতন জেলখানার সামনে কাঠকরবির গাছ ছিল।বর্তমানে দেখা মিলছে না কাঠকরবী গাছের। এখন বিলুপ্ত প্রায় সেইসব স্থানের ফুল গাছগুলো।
চোখে পড়ে কেবল রানীভবানীর রাজবাড়িসহ কিছু জায়গায়। রাজবাড়ির গেটের সামনে ও ভেতরে কয়েকটি কাঠকরবি ফুলগাছ দেখা যায়।নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেখানে কাঠকরবি ফুলগাছ বা চারা পাওয়া যায় না। তবে শহরের চকরামপুরের সুমি নার্সারিতে খোঁজ নিয়ে চারা পাওয়া গেল। নার্সারির মালিক জানালেন- খুব কম চলে এই কাঠকরবি ফুলের চারা। তাই তেমন একটা উৎপাদন করা হয় না।
শীতকালে এই বৃক্ষ পাতা শূন্য থাকে, দেখে মনে হয় যেন কোন শিল্পীর হাতে আঁকা নিপুন ভাস্কর্য। শীত পেরিয়ে বসন্ত এলেও ফুল শূন্য নৈপুন্য কায়ায় ঘুমন্ত থাকে। নতুন কুঁড়ি জাগে চৈত্রের শেষাংশে। ধীরেধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে নতুন পাতা। তারপর শুরু হয় ২-১টা করে ফুল ফোটা। খুব অল্প সময়েই গোটা গাছ ফুলে ছেয়ে যায় । গাছের ডালের উপরাংশে থোকায় থোকায় ফুল আর ফুলের নিচের অংশে থাকে পাতা।
ভোরের স্নিগদ্ধতা যে কারও নজর কাড়ে খুব সহজেই। দেখে মনে হয় কোন কৃষক যেন তার নিজ হাতে তৈরি করে চলেছে এই ফুলের তোরা। তবে লাল রঙের প্রজাতির ফুলগুলো বিশেষ আকর্ষণ করে। পথচারীর ক্লান্ত দৃষ্টি জুড়িয়ে নিতে পারে এক পলকেই। পথিকের মন উদাস করার অসম্ভব ক্ষমতা আছে এই ফুলের গন্ধে। হালকা বাতাসেই ঝরে পড়ে ফুলগুলো, গাছতলায় ঝরা ফুলের সমাহার দেখে মনে হতে পারে ফুলের বাসর।
গাছতলায় শুভ্রতায় ভরে যায়। পূজা-অর্চনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাজানো এবং মেয়েদের খোপায় স্থান করে নেয়া এই ফুলটিকে আশক্সক্ষাজনক হারে হারানোর আগেই কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন নাটোরের মানুষ। আবার অনেকেই মনে করেন যেহেতু গাছের ডাল লাগালেই নতুন গাছ হয় সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অবস্থান থেকেও অনেকে গাছটি লাগাতে পারেন এবং বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে ভুমিকা রাখতে পারেন।
জয় কালিবাড়ির পুরোহিত নিধু চক্রবর্তী জানান, গাছটির নানা অংশের ঔষধি গুণ রয়েছে। নারিকেল তেলের সাথে এই গাছের কষ চর্ম রোগের মহৌষধ। এই ফুল মেয়েদের বাধক সুতিকা রোগের জন্য প্রযোজ্য। পূজার্চনায় বিশেষ প্রয়োজন হয় এই ফুলের তিনি আরও বলেন এই ফুল গাছের দেখা বর্তমানে তেমন একটা মিলেছে না । তবে নাটোর রাজবাড়িতে এখনো এই ফুলের কয়েকটি গাছ আছে, তার মধ্যে তারকেশ্বর মন্দিরের পাশে গঙ্গা স্নান ঘাটের কাছে গাছটি কয়েকদিন আগে ঝরে পড়ে গেছে
গাছটি দ্রুত রক্ষা করা দরকার।
রোজী মোজাম্মেল মহিলা ডিগ্রি কলেজের বোটানিক বিভাগের অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী জানান- কাঠকরবি গাছ আকারে মাঝারি, লম্বায় সাধারণত ১২-৩০ ফুট হয়। আলতো নরম ভঙ্গুর শাখা-প্রশাখা ছড়ানো-ছিটানো থাকে। কষ হয় দুধ রঙের। পাতা বেশ বড় ও লম্বা। ৫টি ছড়ানো পাপড়ির ফুলগুচ্ছ ৫-৮ ইঞ্চি চওড়া হয়। পাপড়ির কেন্দ্রে কিছুটা হলদে বা কমলা রঙের স্পর্শ থাকে। ডাল থেকেই জন্ম হয়।
পশ্চিমা দেশের এই প্রজাতি, নাটোরে আগমন ঘটে রাজপরিবারের হাত ধরে। সেই সুবাদে একে রাজকীয় ফুল বলা চলে। নাটোরে এই ফুলটি ‘কাঠকরবি’ নামে পরিচিত। তবে স্থান ভেদে এই ফুলটিকে নানা নামে ডাকা হয়। যেমন-গুলাচ, কাঠচাঁপা, গোলকচাঁপা, গৌরচাঁপা, চালতাগোলাপ, কাঠগোলাপ, এর ইংরেজি নাম Frangipani এবং বৈজ্ঞানিক নাম Plumeria। এটি Apocynaceae পরিবারের একটি সুপুষ্পক বৃক্ষ। মূলত কাঠকরবির বহু প্রজাতির ও এটা বিচিত্র হয়ে থাকে। জানা যায় মেক্সিকো থেকে এই ফুলের চারা আনা হয়েছিল।
যতদূর জানা যায় নাটোরে এই ফুল এনেছিলেন রাজা যোগেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর। কয়েক বছর আগেও এই ফুল গাছ চোখে পরতো শহরে বিভিন্ন জায়গায়। কিছু প্রজাপতির কাঠকরবি ফুল আছে যেগুলো সারা বছরই ফোটে। তবে ইদানিং এই ফুলগাছ বিলুপ্ত প্রায়। আগের তুলনায় এই কাঠকরবি ফুলগাছ অনেকাংশেই কমে যাচ্ছে। কারণ আগে আমরা দেখতাম আমাদের বাড়ির সামনের জায়গা ফাঁকা থাকতো, অনেকেই বাড়ির আঙিনাতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান করতো।
কিন্তু এখন আমরা আমাদের সীমানা জুড়ে নির্মাণ করছি ইমারত। বাড়ির সামনের জায়গাও আমরা ছাড়ছি না। কাজেই আমরা এখন ছাদের উপর মৌসুমি ফুল করছি। জায়গা সংকীর্ণতার কারণেই বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক প্রজাতির ফুল গাছ। তবে হর্টিকালচার সেন্টার এই প্রজাতির ফুল গাছগুলো সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষন ও প্রসার করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
কাঠকরবী নাটোরে রাজপরিবারের হাত ধরে আগমন ঘটলেও এখনও সেই রাজকীয় ভাব গাম্ভীর্যের ধরে রেখেছে নাটোর রাজবাড়িতে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে রোপনকৃত কাঠকরবী গাছ গুলো নাটোর থেকে হারিয়ে গেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে ও সরকারি সহযোগিতায় এই গাছ মহাসড়কের পাশে সরকারি অফিস-আদালত ও স্কুল প্রাঙ্গণে রোপন করা উচিত বলে মনে করেন নাটোরের বৃক্ষপ্রেমীরা।