কিছুদিন পরপর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদেরকে অর্থাৎ, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে স্যার ডাকা না ডাকা নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বেশ কিছুদিন সরগরম থাকে এই ইস্যুতে। সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক রংপুরের ডিসি কে আপা সম্বোধন করায় তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং শিক্ষকের ভাষ্যমতে তাঁকে অপমান করেন।এইটা এমন একটা ইস্যু যে ইস্যুতে কথা বললে জনসমর্থন দারুণভাবে পাওয়া যায়। তার মানে আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের প্রতি জনতার মধ্যে দারুণ ক্ষোভ বিরাজমান। কিন্তু একটু গভীরে গেলে আমরা একটা উল্টোচিত্র দেখতে পাব। যখন ক্ষোভপ্রকাশের শোরগোল উঠে, তখন আমরা সবাই একসাথে গলা মেলালেও আমাদের মনোজগতে কিন্তু প্রজাতন্ত্রের এই কর্মচারিদের প্রতি রয়েছে দারুণ সমীহবোধ। নইলে আমরা যেকোনো পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আয়োজনে ডিসি, এসপি, ইউএনওকে অতিথি করার জন্য মুখিয়ে থাকি কেন? আমি যদি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকের কথাও বলি, যতদূর জেনেছি তিনি একটা সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য ডিসিকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন। আসলে ডিসিরা তো কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না, তারা আসেন অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করতে উদ্বোধক হয়ে, প্রধান অতিথি হয়ে। আমরাও তাদেরকে সেভাবেই আহবান জানাই এবং তারা সম্মত হলে আমরা প্রীত হই, তারা এলে আমরা ধন্য হই। এ এক দারুণ মনোজাগতিক দ্বিচারিতা। ব্যক্তিগতজীবনে, পারিবারিক জীবনেও এর এই দ্বিচারিতার প্রভাব দারুণভাবে বিদ্যমান। একটা উদহারণ দিয়ে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করি। যে ধরনের পেশা বা কর্মকান্ডকে আপনি মনে মনে অপছন্দ করেন, ঘৃণা করেন যেমন ধরুন, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, আপনি কখনো চাইবেন আপনার ছেলেমেয়ে কিংবা কাছের মানুষেরা এইসব পেশায় আসুক? কিন্তু আপনি, আমি, আমরা সরকারের যে কর্মচারিদেরকে অপছন্দ করি, ঘৃণা করি, পরিবারের কোনো সদস্য পদে সরকারি চাকুরি পেলে দারুণভাবে খুশি হই, আর যদি সেই চাকুরি হয় এডমিন ক্যাডারে, পুলিশে তাহলে তো কথায় নাই। এখন তো একটা শ্লোক-ই প্রচলিত হয়ে গেছে, মাছের রাজা ইলিশ আর জামাইয়ের রাজা পুলিশ। বউ পুলিশ হলে অবশ্য আবার আমাদের এই গর্ববোধ টা সেই মাত্রায় থাকে না। পাওয়ার এবং পুরুষ সমর্থক। নারীর জন্য মাস্টারিই ভাল। সেইটা অন্য আলাপ।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এঁর একটা গল্প বলি। তিনি একবার দেশের বাইরের একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। তিনি অংশগ্রহণকারি মাত্র। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতিবিদদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের কাজ হল কেবল শুনে যাওয়া। কারণ কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুনিয়ার তাবৎ পন্ডিত ব্যক্তিরা। তিনি একটু রসিকতার মধ্য এই ঘটনার ইতি টেনেছেন, এভাবে যে, হত যদি এটা বাংলাদেশ, তাহলে আমাকেও নিশ্চয় এই কনফারেন্সে দু-কথা বলতে হত। এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করলাম এই কারণে আমাদের তাবৎ কাজে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদেরকে কেন ডাকতে হয়? ভবন থেকে টয়লেট উদ্বোধন, পারিবারিক, সামাজিক, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক যাবতীয় অনুষ্ঠানে আমাদের জেলা, উপজলা পর্যায়ের আরাধ্য ব্যক্তি হলেন ডিসি, এসপি, ইউএনও। তারা কি তাবৎ বিষয়ে বিশেসজ্ঞ? রাজনৈতিক বা দলীয় কর্মসূচি হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এখন কথা হল, উনারা যদি আমাদের আরাধ্য ব্যক্তি হন, তাহলে যে দেবতা যাতে সন্তুষ্ট সেই নীতি অবলম্বন করুন। আর যদি, মনে করেন না উনাদেরকে আমন্ত্রণও জানাব আবার স্যারও ডাকব না, তাহলে উনাদেরকে কেন আমন্ত্রণ করবেন এবং কেন স্যার ডাকবেন না সেইটা পরিস্কার হয়ে নেওয়া জরুরী। এখন এই যে পরিস্কার হয়ে নেওয়া, এটা তো একদিনে সম্ভব নয়; কারণ আমরা অনেক কিছুই আমাদের কাছে দারুণভাবে পরিস্কার কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি না। কারণ আমাদের মনোজগৎ ওইভাবেই তৈরি হয়ে গেছে। তাই তো একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমাদের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশ বলেন, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব তারা বিশ্বাস করেন না এবং আমাদের রাস্ট্রযন্ত্রও তাদের সেই বিশ্বাসের প্রতি দারুণভাবে শ্রদ্ধাশীল। আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকদের একাংশও দারুণভাবে এত হৈচৈ করছেন কিন্তু তারাও কতটা মুক্ত সেই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা’র উল্লেখ করি। বাংলাদেশের প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ন আজাদকে তাঁর এক ছাত্র একবার মজা করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হুমায়ন আজাদ, আপনি কেমন আছেন? প্রত্যুত্তরে হুমায়ন আজাদ খুব রাগান্বিত স্বরে বলেছিলেন, আমি তোমার শিক্ষক। তুমি কিভাবে আমাকে নাম ধরে ডাক? হুমায়ন আজাদের সেই ছাত্র জবাব দিয়েছিলেন, আপনি তো কবি শামসুর রাহমানের মত একজন সিনিয়র মানুষকে নাম ধরে ডাকেন। আপনি মুক্তমনা একজন মানুষ। উত্তরে হুমায়ন আজাদ যেটা বলেছিলেন, তাতে বোঝা যায় তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর ছাত্রের যুক্তিতে। হুমায়ন আজাদ বলেছিলেন, শামসুর রাহমা বিএ পাশ, আমি এমএ পাশ। এই প্রসঙ্গ আমি এখানে উল্লেখ করতে চাইনি। এটা একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার অংশ। করলাম এই কারণে আমাদের শিক্ষকেরা কিন্তু স্যার ডাক শুনতেই পছন্দ করেন, ব্যত্যয় ঘটলে নাখোশ হন।
তাহলে এর সমাধান কোথায়? আপাতত সমাধান নাই। মনোজাগতিক পরিবর্তন ছাড়া। দীর্ঘ সময়ের ঔপনিবেশিক শাসনামলে আমাদের মনোজগতে শাসকের প্রতি যে সমীহবোধ তৈরি হয়েছিল, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও তা ম্লান হয় হয় নাই, মুছে যায় নাই। আজকের বাংলাদেশে শাসক যে সেবক সেই বোধ যেমন সেবকদের তৈরি হয় নাই, প্রজাতন্ত্রের মালিকদেরও সেই মালিকানার বোধ তৈরি হয় নাই। অন্যভাবে বললে, মালিকানার যে বোধ সেটা তৈরি হতে দেওয়া হয় নাই। এই মালিকানার বোধ তৈরি করার মূল দায়িত্ব হল রাজনীতিবিদদের। শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সেখানে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে মাত্র। কিন্তু আমাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতারা এখানে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তো এক একটি ঘটনা ঘটে এবং আমাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলেন, স্যার না ডাকলে মাইন্ড করার কিছু নেই। এইটা একটা পরোক্ষ বাক্য। রাজনীতিবিদদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হলে প্রজাতন্ত্রের মালিকদের কথিত প্রতিনিধিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদেরকে নির্দেশনা জারি করতেন, আপনাদেরকে নয়, বরং আপনারাই জনগণকে স্যার সম্বোধন করবেন। এর আগেও তিনি এ রকম পরোক্ষ বাক্যের মাধ্যমে তাঁর দায় সেরেছেন। কেবল নির্দেশনা জারি করলেই সব সমস্যার সমাধা হয়ে যাবে? না, এর জন্য দরকার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংস্কার। এগুলি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু শুরু করতে হবে এখনই। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামলীগ যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শও যথাযথভাবে অনুসরণ করত, তাহলেও এই বিতর্ক আজ পর্যন্ত চলতে পারার কথা না। আওয়ামলীগ কেবল ৭ মার্চের ভাষণই প্রচার করেন, যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মচারিদেরকে বলছেন, কৃষক, মজুর, খেটে খাওয়া মানুষদেরকে ইজ্জত দিয়ে কথা বলবেন, সেই ভাষণ আমরা পাড়া মহল্লাতে তেমন শুনি না। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদেরকে জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তারা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। এই মনোভা নিয়ে তাঁদেরকে কাজ করতে হবে। এখানে বঙ্গবন্ধুর কথিত চেতনাধারী আওয়ামলীগ এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারিরা যদি ন্যুনতম এই বক্তব্যটুকু ধারণ করতে পারতেন তাহলেও আজ সরকারি কর্মচারিদের সাথে জনতার সম্পর্ক অন্যরকম হত।
আবারও বলি, হয় নাই বলে হবে না, এমন তো নয়; সেখানে সকলকেই ভূমিকা রাখতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এই দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদেরও ভূমিকা রয়েছে। আমরা সত্যকারের নাগরিক হয়ে উঠতে পারলে, তবেই না আমরা আমাদের মালিকানা বুঝে নিতে পারব। সেইটা একক প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়, রাজনৈতিক দলগুলি হল প্ল্যাটফর্ম সম্মিলিত প্রচেষ্টার। আজকে তারা ব্যর্থ হলেও নিশচয় বোধোদয় হবে কিংবা গড়ে উঠবে বিকল্প। সেই দিনের প্রত্যাশায় রইলাম।#