আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা ঘটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পটভূমিতে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে রাজপথে বয়ে দিয়েছে রক্তের গঙ্গা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে অভিযান চালায়। রাতে ঘুমিয়ে থাকা নিরীহ ও নিরস্ত্র প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগমুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেইসাথে তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। এরপর দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করে। আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ৩০ লাখ শহীদকে, স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ চার জাতীয় নেতাকে।
স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ রয়ে গেছে। খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তির ব্যবহার, বহুমুখী যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু নির্মাণসহ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার যে স্বপ্ন, অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্যের সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে বেকারত্ব। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়নি। বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য। দেশের অর্থ/সম্পদ নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের করায়ত্ব। জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এর পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের ঋণখেলাপি, শেয়ারবাজারে কারচুপি, সরকারি সম্পদ লুটপাট এবং বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা প্রকার অনাচারে পরিপূর্ণ- যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য। অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়েও, দিনে দিনে গণতন্ত্র সংহত হওয়ার পরিবর্তে সংকুচিত হয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে আইসিটি আইন পাস এরপরে আওয়ামী লীগ সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও বাক্স্বাধীনতার পরিসর সংকুচিত হয়েছে।
২০২২ সালে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) প্রকাশিত সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম (স্কোর ৩৬ দশমিক ৬৩)। অথচ ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম (স্কোর ৫০ দশমিক ২৯)। মাত্র একবছরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের যেসব স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বৈষম্যমুক্ত, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে___ এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
স্বাধীনতা দিবসে সাময়িকীর সকল পাঠক, লেখক, শুভানুধ্যায়ীসহ সমগ্র দেশবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।