লন্ডন পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণ ও জনগণের আস্থাভঙ্গের প্রতিবেদনে
লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশের কর্মসংস্কৃতি ও মানের ব্যাপক সমালোচনা করে যে প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চরম ব্যর্থতার নানা দিক উঠে এসেছে।
মেট্রোপলিটান পুলিশ বাহিনী নিয়ে ব্যরোনেস লুইস কেসি তার পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বৈষম্যের সংস্কৃতি, নারী ও শিশুদের রক্ষায় তাদের ব্যর্থতা, নিজেদের বাহিনীর ওপর নজরদারিতে অক্ষমতা এবং পুলিশের ওপর সাধারণ জনগণের আস্থাভঙ্গের ভয়াবহ চিত্র।
লন্ডন পুলিশ বাহিনীর ইতিহাসে এত ব্যাপক ব্যর্থতার চিত্র এর আগে কখনও সামনে আসেনি। এই বাহিনীতে পুলিশ কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার।
ব্যারোনেস কেসির ৩৬৩ পৃষ্ঠার রিপোর্টে বেরিয়ে আসা ব্যর্থতা ও বৈষম্যের এরকম পাঁচটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত:
ভাঙা ফ্রিজারের কারণে ধর্ষণের মামলা বাতিল
এই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে: শিশুদের সুরক্ষাদান, ধর্ষণ এবং গুরুতর যৌন অপরাধের মত জনগণকে রক্ষা করার ক্ষেত্রগুলোকে “অগ্রাধিকার না দেয়া এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নেয়ার” কারণে নারী ও শিশুদের আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে ধর্ষণ ও গুরুতর যৌন অপরাধের ঘটনাগুলো তদন্তের সময় অফিসারদের ভাঙা, অকেজো বা জিনিসপত্রে ঠাসা ফ্রিজ ও ফ্রিজার নিয়ে ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে, যার ফলে তাদের তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব ফ্রিজে অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখা হয়। অনেকসময় অতিরিক্ত নমুনা সেখানে মজুদ রাখায় পরীক্ষার ফলাফলের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে।
যেমন, ২০২২ সালে প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে একটি ফ্রিজার অকেজো হয়ে গেলে সেখানে রাখা যৌন নিগ্রহের শিকার এক নারীর রক্ত ও অন্যান্য নমুনা এবং তার অন্তর্বাস থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়।
ফলে ধর্ষণের যে অভিযোগ তদন্তাধীন ছিল সেই অভিযোগের মামলা প্রমাণের অভাবে বাতিল করে দিতে হয় বলে পর্যালোচনা প্যানেলকে নাম পরিচয় প্রকাশ না করে জানিয়েছেন পুলিশ বাহিনীর একজন অফিসার।
ওই ফ্রিজারের ভেতর এত বিপুল পরিমাণে ফরেনসিক নমুনা সংরক্ষিত ছিল যে ফ্রিজারের দরজা বন্ধ করার জন্য তিনজন অফিসারকে একসাথে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। যে অফিসার এই তথ্য দিয়েছেন ধরা যাক তার নাম ‘অফিসার জি’- তিনি আরও বলেছেন ধর্ষণের মামলার জন্য সংগৃহীত নমুনা এই ফ্রিজগুলোতে “এমনভাবে ঠেসে রাখা হয়েছে, যাতে সেগুলো যথাযথভাবে না রাখায় এবং গাদাগাদি করে রাখায় সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে”।
শিখ অফিসারকে দাড়ি কামাতে বাধ্য করা – কারণ ‘তা হাস্যকর’
এই প্রতিবেদনে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক মাত্রায় হয়রানির অনেক নজির তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্ট বলেছে লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী ও সমকামীতা বিদ্বেষী।
সারা এভারার্ড নামে এক নারীকে অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের দায়ে মেট্রোপলিটান পুলিশে কর্মরত এক অফিসার ওয়েন কুজেন্স দোষী সাব্যস্ত হবার পর এই পর্যালোচনার দায়িত্ব দেয়া হয় ব্যরোনেস কেসিকে।
প্রতিবেদনে যেসব বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল একজন শিখ পুলিশ অফিসারকে তার দাড়ি ছাঁটতে বাধ্য করা- কারণ অন্য আরেকজন অফিসারের চোখে তার লম্বা দাড়ি ছিল ‘হাস্যকর’। আরেকজন শিখ অফিসারকে তার পাগড়ি খুলে জুতোর বাক্সে ঢুকিয়ে রাখতে বাধ্য করা হয়েছে।
আরেকটি ঘটনায় একজন মুসলিম পুলিশ অফিসার দেখেন লকারের ভেতর রাখা তার বুট জুতোর মধ্যে শূকরের মাংস ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি এটা আবিষ্কার করে “স্তম্ভিত” হয়ে যান, কিন্তু প্রতিহংসার ভয়ে এই ঘটনার কথা কাউকে জানাননি।
আরও যারা এধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ অফিসার যিনি খোলাখুলিভাবে জানিয়েছিলেন যে তিনি সমকামী। তাকে সকলের সামনে প্রকাশ্যে হেনস্তা করা হতো, তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এবং ইউনিফর্ম লুকিয়ে রাখা হতো এবং তার লকার তছনছ করা হতো।
মেট্রোপলিটান পুলিশ লোকমুখে যা পরিচিত ‘মেট পুলিশ’ নামে, সেখানে কর্মরত সমকামী নারী, পুরুষ এবং উভকামী অফিসারদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে প্রায় একজন ব্যক্তিগতভাবে সমকামীবিদ্বেষী আচরণের মুখে পড়েছেন বলে পর্যালোচনায় বলেছেন।
নাম পরিচয় গোপন রেখে ‘অফিসার ই’ নামে আরেকজন সমকামী পুলিশ কর্মী অন্যান্য সহকর্মীদের অভিজ্ঞতার কথা জানার পর বলেন: “আমি পুলিশ বাহিনীকে ভয় পাই। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানের ওপর আমার কোন আস্থা নেই।”
ব্যরোনেস কেসির পর্যালোচনা রিপোর্টে লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী ও সমকামীতা বিদ্বেষী বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
নারীদের জোর করে খাইয়ে হেনস্তার সংস্কৃতি
পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পর বিভিন্ন দলে যোগ দেবার যোগ্যতা পরীক্ষায় অধস্তন কর্মচারীদের হেনস্তা করার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছে অনেক অফিসারকে।
বিশেষ বাহিনীতে কর্মরত একজন নারী অফিসার তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, পদমর্যাদার দাপট দেখানো, অধস্তন অফিসারদের হেনস্তা ও অপদস্থ করার সংস্কৃতি এই বাহিনীতে ব্যাপক মাত্রায় বর্তমান।
এই যোগ্যতা পরীক্ষার মধ্যে ছিল খাবার খাওয়ার চ্যালেঞ্জ, যেখানে নারী অফিসারদের জোর করে বিশাল মিষ্টি চিজকেক পুরোটা খেতে বাধ্য করা হতো, যতক্ষণ না খেতে খেতে তারা বমি করছে, জানান নাম প্রকাশ না করা ওই নারী অফিসার।
তিনি আরও বলেন পুরুষ অফিসারদের একই ধরনের যোগ্যতা পরীক্ষায় একজন পুরুষ অফিসারকে গোসলখানায় শাওয়ার করার সময় যৌন হয়রানি করা হয়েছে বলে তাকে জানানো হয়। এ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা ও সহকর্মীদের মধ্যে ঠাট্টা-মস্করা পুলিশ বাহিনীতে খুবই চালু সংস্কৃতি।
এই ঠাট্টা-মস্করায় যোগ দিতে কেউ অস্বীকার করলে তাকে একঘরে করা হয় এবং “সে দলের উপযুক্ত নয়” বলে মনে করা হয়, জানান ওই নারী অফিসার।
গোসল করার সময় অফিসারদের গায়ের ওপর প্রস্রাব করার ঘটনাও এই পর্যালোচনায় জানা গেছে।
অফিসারদের হোয়াটসঅ্যাপ মুছে ফেলতে উৎসাহদান
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডনের একটি পুলিশ স্টেশনে কর্মরত অফিসারদের পাঠানো কিছু হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ছড়িয়ে পড়ে যেগুলো ছিল বৈষম্যমূলক।
ওই মাসেই পরের দিকে বাহিনীর ভেতর একটি প্রচারণা অভিযান চালানো হয় যার নাম ছিল ‘নট ইন মাই মেট’ অর্থাৎ ‘আমাদের মেট পুলিশে এমনটা ঘটে না’। এর লক্ষ্য ছিল পুলিশ কর্মীদের বৈষম্য নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে উৎসাহিত করা।
অফিসার জি জানান, এই প্রচার অভিযান সম্পর্কে যে বৈঠকে স্টাফদের অবহিত করা হয়, সেখানে তার সহকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ মুছে ফেলতে উৎসাহিত করা হয়।
তিনি বলেন অফিসারদের বলা হয়- আপনাদের হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকে পাঠানো মেসেজগুলো “ভাল করে চেক করে দেখে নেবেন” কারণ “ওরা এখন মেসেজ দেখে দেখে সবাইকে ধরবে- কাজেই নিজেকে বাঁচান।”
তিনি বলেন, তিনি জেনেছেন তার সহকর্মী যারা অন্য ব্রিফিং বৈঠকে যোগ দিয়েছিল তাদেরও একই বার্তা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে “নিজেকে বাঁচাতে প্রমাণ লোপাট করে দিন”।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, “বাহিনীতে অফিসারদের অগ্রহণযোগ্য আচরণ যাতে কেউ জানতে না পারে তার জন্য “উদ্বেগজনক কিছু ব্যবস্থা চালু করা হয়” যার মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য সোশাল মিডিয়া থেকে তথ্য জানাজানি হলে কীভাবে তা মোকাবেলা করতে হবে সেসব বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়।
যেমন একটি বিশেষ বাহিনী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সেখানে কর্মরত কোন অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে গ্রুপে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক সঙ্কেত দেয়ার রেওয়াজ চালু আছে, যাতে গ্রুপের সদস্যরা ওই গ্রুপ থেকে অবিলম্বে বেরিয়ে যায়, তাদের কন্টেন্ট সাথে সাথে মুছে ফেলে এবং তদন্তের আওতায় যাতে পড়তে না হয় তার জন্য নতুন গ্রুপ তৈরি করে।
কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আচরণে অবহেলা আর বৈষম্য
‘শিশু কিউ’ নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরী ছাত্রীর একটি ঘটনা গত বছর সামনে আসার পর শিশুদের প্রতি পুলিশের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ওই ছাত্রীর তখন মাসিক চলছিল। সেসময় স্কুলের ভেতর দুজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে নগ্ন করে তার শরীর তল্লাশি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয় এই ঘটনা বর্ণবৈষম্যের প্রকট একটি দৃষ্টান্ত। শরীর তল্লাশির সময় কৃষ্ণাঙ্গ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হিসাবে গণ্য করার বহু নজির পুলিশ বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে পাওয়া গেছে।
একটি ঘটনায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর একজন বিশেষজ্ঞের কাছে সাহায্যের জন্য যায়, যিনি পুলিশ বাহিনীর সাথে জড়িত নন। কিশোরটি তাকে বলে যে নিজের সুরক্ষার জন্য সে সাথে ছুরি রাখছে, কারণ সে একটি গ্যাংএর সাথে জড়িত। কিন্তু ওই গ্যাংএর সংশ্রব সে ছাড়তে চায়।
এরপর একজন প্রাপ্তবয়স্ক ওই কিশোরের ওপর হামলা করে। ওই বিশেষজ্ঞ পুলিশকে হামলার ঘটনা জানান এবং ছুরিটি পুলিশের কাছে জমা দেন। কিন্তু অন্য একটি পুলিশ ইউনিটের অফিসাররা কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
“কিশোরটিকে সাহায্য করা আর সম্ভব হয়নি। সে সবকিছু খুলে বলতে আর কোনভাবে রাজি হয়নি, সে আর সহযোগিতাও করতে চায়নি।”
কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের তরুণ কিশোরদের প্রতি পুলিশ বাহিনীর আচরণ খুবই বৈষম্যমূলক বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
বলা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করা বা তাদের সাহায্য করার মানসিকতার অভাব লন্ডন পুলিশ বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে প্রকট। সেখানে বর্ণবাদ আর পদ্ধতিগত পক্ষপাতের যে ব্যাপকতা রয়েছে তা মোকাবেলা করার কোন উদ্যোগ বাহিনীর মধ্যে অনুপস্থিত।
সূত্র বিবিসি