কথিত আছে রাজা রঘুনন্দন নৌকাভ্রমণে এসেছিলেন, তখন এই স্থানের নাম ছিল ছাইভাঙ্গার বিল, রাজা রঘুনন্দন পদ্ম ফুলের উপরে একটি ব্যাঙ, সাপ খাচ্ছে। এমন দৃশ্য তার চোখে পড়েছিল। তিনি মাঝিকে বলেছিলেন নাওঠেইরো, তখন রাজা এখানে একটি নগরী তৈরীর পরিকল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তবায়নও করেছিলেন।
ইতিহাস বলছে- বিশাল জমিদারির রাজধানী নিজ জন্মভূমিতে স্থাপনের নিমিত্তে রঘুনন্দন, রাম জীবন ও পণ্ডিতবর্গ তৎকালীন ভাতঝাড়ার বিলকে নির্বাচন করেছিলেন। ভাতঝাড়ার বিল ছিল পুঠিয়া রাজা দর্পনারায়ণের সম্পত্তি। এজন্য রঘুনন্দন ও রামজীবন রাজা দর্পনারায়ণের নিকটে বিলটি রায়তী স্বত্বে পত্তনীর আবেদন করেন। নতুন রাজা রামজীবনকে রাজা দর্পনারায়ণ জমিটি ব্রহ্মোত্তোর দান করেছিলেন।
রামজীবন বিলে দীঘি, পুকুর ও চৌকি খনন করে সমতল করেন, দুর্লভ প্রজাতির অসংখ্য বৃক্ষ রোপন করেন এবং রাজবাড়ি সহ এই জনপদ স্থাপন করেছিলেন। এলাকাটির নামকরণ করেন ‘নাট্যপুর।’
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি হয়েছিল। ১৭০৬ সালে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানী চরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন, দেওয়ান রঘুনন্দন জমিদারিটি তার ভাই রাম জীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন, এভাবে নাটোর রাজবংশের পত্তন হয়।
রাজা রাম জীবন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬ সালে, মতান্তরে ১৭১০ সালে, ১৭৩৪ সালে তিনি মারা যান, ১৭৩০ সালে রাণী ভবানীর সাথে রাজা রাম জীবনের দত্তক পুত্র রামকান্তের বিয়ে হয়, রাজা রাম জীবনের মৃত্যুর পরে রামকান্ত নাটোরের রাজা হন। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশ সরকারের সর্বোচ্চ করদাতা ছিলেন রাণী ভবানী, তাই অনেকের মতে তৎকালীন সময়ে তাকে অর্ধবঙ্গেশ্বরী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল, তৎকালীন সময়ে যাতায়াতের প্রধান পথ ছিল, পানি পথ।
সেই সময় থেকে সবুজ, শ্যামলে সিক্ত আমাদের এই নাটোরের মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও সত্তা ছিলোনা বরং নিজেকে প্রকৃতির এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করেছে, তাই নাটোরের সাহিত্য ও ধর্মকথায় বারবার ফিরে এসেছে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের কথা।
যে হারে নাটোরের জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই হারে স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। অল্প মানুষের জন্য নির্মিত এই নগর, বর্তমানে শতগুন বেশি নাগরিক বসবাস করছে, ফলে-
দালান-কোঠার নগরায়ন, মানুষ নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তৈরি করছে, কমছে জলাশয়, তৈরি হচ্ছে জলবদ্ধতা, প্রকৃতি হচ্ছে বিপন্ন, একের পর এক বাড়ছে হাটবাজার, মাথা তুলেছে শিল্প, গাছ কেটে গড়ে উঠেছে বসতি, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে কোথাও যেন এক দুস্তর ব্যবধান রচিত হচ্ছে।
প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা সম্পদের ব্যবহার করতে গিয়ে একে একে বিপন্ন হচ্ছে নাটোরের জঙ্গল, নদী, পশুপাখি, জঙ্গলের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সভ্যতা— এক কথায় সব কিছুই।
উৎখাত হচ্ছে চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও জৈব উপাদান ইত্যাদির সামষ্টিক রূপ।
একদা এই পুণ্যভূমিতে সন্তানস্নেহেই বৃক্ষ থেকে শুরু করে প্রাণীকূল সকলেই লালিত হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বনভূমির উপরে বারবার নেমে এসেছে আঘাত, পরিবেশ হয়েছে দূষণ, পরিস্থিতি হয়েছে বিপন্ন, বৃদ্ধি পেয়েছে শহরতলি, গ্রাম মানুষ সহ বাজারহাট।
সুসমন্বিত রূপের ব্যত্য়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায় এবং পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর সাথে দায়ী। কিন্তু প্রাচীন নাটেরের সেই তপোবনের ঐতিহ্যকে আজও মনে রেখেছেন কিছু মানুষ। তাঁদের চোখে তাই উন্নয়ন, পরিবেশের প্রতিস্পর্ধী নয় বরং পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন এক ব্যবস্থা যা মানব সমাজের সঙ্গে গোটা প্রাণীকূলকে বিকাশের পথ দেখাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগিয়ে আসবে নাটোরের সচেতন মহল, দৃষ্টান্ত স্হপন করবে প্রাচীন নাটোরের সভ্যতা, সার্থক উত্তরাধিকার বহন করবে নাটোরের পরবর্তী প্রজন্ম। এমনটাই প্রত্যাশা।