আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একাল সেকাল
“বিশ্বের কিছু মহান সৃষ্টি চির যা কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর” -বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় নারীর বীরত্বগাঁথায় কোন বাহুল্য নেই।
নারীর ভূমিকা সমাজ সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে সমন্তরাল। সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষের পারিপার্শ্বিক নারীর ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। বলা যায় একে অপরের পরিপূরক। মানবচক্রের যে মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবীতে আসা, তার একটি অন্য মাধ্যম এই নারী। এই নারী কখনো আমার মা, কখনো আমার বোন আবার কখনো সহধর্মিনী। হাজার সম্পর্কের মাঝে তাদের সঙ্গে আপনার আমার সম্পর্ক অন্যতম।
সভ্যতার সৃষ্টি লগ্ন থেকেই এই অনাবিল, মধুর, আত্মিক সম্পর্ক প্রবাহমান ও গতিশীল। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অন্যের সুখে হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিতে পিছপা হন না এই নারী। তাই হয়তো একাই ভালোবাসে সমস্যা ও সমাধানের সমস্ত দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেই। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার করেই চলে এই নারীর জীবন। যার জন্য উৎসর্গ করা যায় বছরের প্রত্যেকটি দিন। তাকে উদ্দেশ্য করে যা-ই করা হয়, তা-ই হয়তো তার করা কাজের কাছে কম। তাই তার উদ্দেশ্য করে আর তাকে সম্মান জানাতে বিশ্বে একটি দিন পালিত হয় নারী দিবস হিসেবে। সেই দিনটি হল ৮ মার্চ। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন ৮ মার্চ তাদের শ্রদ্ধা সম্মান এর প্রতি নিবেদিত।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় এর পশ্চাতে ও আছে নারীর এক বিশাল আন্দলনের গল্প। নারী দিবসের ইতিহাসের গোড়ার কথাটি হল, শ্রমিক নারীর কাজের সময়, ছুটি, সম্মানজনক বেতনের দাবিতে আন্দোলন। ১৮৫৭-র ৮ মার্চ আমেরিকার বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে লড়াই পশ্চিমি দুনিয়ায় আলোড়ন তোলে। পরবর্তী কালে যুক্ত হয় মেয়েদের ভোটের অধিকারের দাবি। এই সমস্ত দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯১০ সালে কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয় এবং ১৯১১ থেকে তা পালন শুরু হয়।
ভারতেও পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে মেয়েদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকারের দাবিতে নারী দিবস পালন শুরু হয়। এর পাশাপাশি পণ, ধর্ষণ, মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গার্হস্থ্য হিংসা, পরিবারে মেয়েদের অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নারী আন্দোলনের দাবির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে এবং প্রতি বছর এই সব দাবি আদায়ের আওয়াজ তোলা হয় নারী দিবসে।
বর্তমান অতিমারির সংকটে চারিদিকে যখন মানবজাতি বিপর্যস্ত, ছত্রভঙ্গ, বিধ্বস্ত, শংকিত ঠিক তখনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নারী জাতির আর্থসামাজিক কাঠামো অবনমন এর দিকে। অতি মারির দুর্বার ছোবল তাদের প্রগতি, ঐক্য, বিকাশ, লড়াই, প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংহতি সমস্ত কিছুকে যেন নড়ে দিয়েছে।
আমরা সবাই বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল, মুক্তমনা, নারীবাদী চেতনা জাগরণ নিয়ে অনেক বড় বড় গালভরা কথা বলি কিন্তু বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও তাদের উত্তরণের অভিমুখে পূণ করিনা। সবকিছুতেই আমাদের বিশাল ফাঁকফোকর। শ্রেণী, লিঙ্গ, শ্রম ও বৈষম্য, বিভাজন চারিদিকে ঘটে চলেছে তবুও খুব একটা এর বিরুদ্ধে আমাদের সুশীল সমাজের মধ্যে প্রভাব, প্রতিরোধ প্রতিবাদ চাক্ষুষ হয়না
আন্তর্জাতিক নারী দিবস সেদিন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে যখন আমরা প্রতিটি নারীর দুঃখ কষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা, ব্যথা বেদনা, চাহিদা সমস্ত কিছুকে আমাদের আন্তরিক অনুভূতি, টান, নিষ্ঠা, মহানুভবতা, কর্মমুখী মানসিকতা দিয়ে উপলব্ধি করব। সেই পরিকল্পনার সফল রূপায়নে আমাদের সর্বপ্রথমে আবশ্যিক গতানুগতিক, রক্ষণশীল, সেকালের একপেশে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে সাম্য, মানবিক, দায়বদ্ধতার জাগরণ ঘটিয়ে প্রকৃত মনুষ্যত্বের গুণাবলীতে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের যথাযোগ্য প্রাসঙ্গিকতা গুরুত্বের বার্তা সমগ্র নারীজাতির পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও প্রকৃত উপলব্ধি করণে ছড়িয়ে পড়বে।