আজ বিশ্বে পালিত হচ্ছে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এই দিবসটিতে। এ দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও তাদের পেশাগত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই দিবসটি পালন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। পৃথিবীর ১৮০টি দেশের মধ্যে র্যাঙ্কিং বা সুচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এ বছর বাংলাদেশ ১৫২ তম অবস্থানে রয়েছে, যেখানে ভারতের অবস্থান যথাক্রমে ১৪২, পাকিস্তান ১৪৫, মায়ানমার ১৪০, আফগানিস্তান ১২২, শ্রীলঙ্কা ১২৭, নেপাল ১০৬, মালদ্বীপ ৭৯ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভুটান ৬৫। গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে তার ওপর ভিত্তি করে ২০০২ সাল থেকে নিয়মিত এই সূচক প্রকাশ করে থাকে আরএসএফ। এই সূচকের শীর্ষ ১০ দেশ হলো- নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, কোস্টারিকা, নেদারল্যান্ডস, জ্যামাইকা, নিউজিল্যান্ড, পর্তুগাল এবং সুইজারল্যান্ড।
গণতন্ত্র, দ্রুত ন্যায় বিচার এবং বাংলাদেশের মুক্ত গণমাধ্যমের অবস্থা কেমন! – একটা গল্প মনে পড়ে গেল। একটি মুনিয়া পাখি উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে গাছের ডালে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল। এমন সময় একজন শিকারী পাখিটাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। তীর পাখির বুকে বিদ্ধ হলো, ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হলো, অবশেষে মারা গেল।
শিকারীর সাথে থাকা চারজন বন্ধুর মধ্যে প্রথমজন শিকারীকে বলল, তীর ছুঁড়তে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলে তো, এই নাও বেদনা নাশক ট্যাবলেট, জল দিয়ে গিলে ফেল। সেই সাথে তিনি শিকারীর হাত ম্যাসেজ করতে লাগলেন।শিকারী হাসলেন আর প্রথম ব্যক্তিকে বললেন, হে বন্ধু এখন থেকে তুমি আমার প্রতিটি সফরের সঙ্গী হইবে।
দ্বিতীয়জন শিকারীকে বলল, তীর ছুঁড়ে তো শিকার করেছে ছোট্ট একটা মুনিয়া পাখি, হাতি তো আর শিকার করেনি। দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, হাতি খাবার অযোগ্য তাই শিকার করি না।
আজকে মুনিয়া পাখিটাকে কত রকমের মসলায় মাখিয়ে আগুনে ঝলসে (বারবিকিউ) তারপরে কিভাবে চিবিয়ে খেতে হবে তার বর্ণনা দিচ্ছিল তৃতীয় ব্যক্তি। উত্তম ও সেরা রেসিপি দেওয়ায় তৃতীয় ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুরুস্কৃত করলেন শিকারী।
চতুর্থ ব্যক্তি শিকারীকে তিরস্কার করলেন এবং নিরীহ পাখিটাকে তীর বিদ্ধ করায় শিকারীর শাস্তি পাওয়া উচিত বলে মত ব্যক্ত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাকীরা চতুর্থ ব্যক্তিকে উত্তম মধ্যম দিয়ে দল থেকে বের করে দিল। সকলেই বলতে লাগলো শিকারী নয়, বরং সব দোষ ছিলও ঐ মুনিয়া পাখিটার। পরবর্তীতে শিকারী তার শিকারানুভুতিতে আঘাত পাওয়ার অভিযোগ এনে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করলো। লোকটিকে গ্রেপ্তার করা হলো। সেই থেকে লোকটি আজ অবধি জেলেই বন্দী আছে। জেলখানার ভেতরে তাকে তিনিবেলা খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত শেখানো হচ্ছে- দেখবে, শুনবে, জানবে কিন্তু কথা ততটুকুই বলবে- যতটুকু তাকে বলতে বলা হবে।
কিছু মানুষ আছে যারা মাঠে ঘাটে ঘুরে ঘুরে দুর্বল নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত, অসহায়, অবহেলিত, অত্যাচারিত মানুষের কথাগুলো সংবাদপত্রে তুলে ধরেন, যাতে সমাজে বঞ্চিত, শোষিত মানুষেরা শোষকের হাত থেকে রেহাই পায়, ন্যায় বিচার পায়। শোষিতের বঞ্চনার কথা লিখতে গেলে শোষক ও অত্যাচারীর নাম ধাম প্রকাশ করলে রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী তকমা পেতে হয়, ক্ষমতাধর শোষকের অনুভুতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেলে পচে মরতে হয়। কখনও কখনও তাদের হত্যাও করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী তারা সেদিনও ছিল যেদিন দেশ ছিল পরাধীন। আজও তারা জেলখানাতেই বন্দী আছেন কিন্তু দেশ আজ স্বাধীন।
সংবাদকর্মীদের হয়রানি অথবা তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দূর করা সরকারের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। গণমাধ্যমের স্বাধীন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে, এমন কোন আইনি, প্রশাসনিক, নীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ করা থেকে রাষ্ট্র বা সরকারের বিরত থাকা উচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার দলিল, সংবিধান ও আইনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রক্ষা কবচ হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে আরো দ্রুত গতিতে বাড়ছে অনলাইন সংবাদ পত্রের সংখ্যা। অবাধ ও দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম হওয়াতে মানুষ মুক্ত মতপ্রকাশের জন্য ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সাংবাদিক’রা লাঞ্চিত হচ্ছেন, অত্যাচারিত হচ্ছেন, বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর, সমাজ শাসকের রক্তচক্ষু ছাড়াও আছে কিছু গোষ্ঠী যারা ইসলামের নামে সাংবাদিকদের, মুক্তচিন্তার লেখকদের হুমকি দিয়ে হত্যার তালিকা প্রকাশ করছে। হত্যার শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। হাতে গোনা মাত্র ২/৪ সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ছাড়া বাকী ঘটনাগুলোর বিচার হয়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি সাংবাদিকের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করেছে। হাজার প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এদেশে আজ সংবাদপত্রই সবচেয়ে সক্রিয় আছে, বিভিন্ন অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে।