পাশ্চাত্যের মানুষের আয়ু কেন বেড়েছে?
আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণেই পাশ্চাত্যের মানুষ আজ স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে। এতে তাদের গড় আয়ু আনেক বেড়েছে। এটা স্পষ্ট গড় আয়ুর সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের কথাই ধরি ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর মাত্র। ১৯৬৫ সালে বেড়ে হয় ৪৯ বছর।
১৯৭০ এর ঘুর্ণিঝড় ও একাত্তরের গণহত্যার প্রেক্ষিতে গড় আয়ু কমে যায়। এরপর ১৯৮১ সালে আমাদের গড় আয়ু ছিল ৫৪.৮৫! এখন ৪২ বছর পরে এসে আমরা দেখছি আমাদের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৪.৩০ বছর।
অর্থাৎ মানুষ এখন আগের থেকে প্রায় ২০ বছর বেশি বাঁচে। মানে হল যমরাজ বা আজরাইল মানুষের জান কবজ করতে এখন ২০ বছর পরপর আসছে? বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির পেছনে কারণগুলো কি কি? তারা কি আগের থেকে ধর্মকর্ম বেশি করছে? বরং উল্টো হচ্ছে? এরমধ্যে আগের দশকেই উত্থান ঘটে ব্লগারদের। তারা ধর্মবিশ্বাসকে ফার্দাফাই করে ছাড়ে। তারা নবী, রসুল, পয়গম্বর, অবতার, ভগবান, ঈশ্বর ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হাসি-তামাশা করে। এতে স্রষ্টা রাগান্বিত হয়ে আয়ু আরো কমিয়ে দিতে পারতো। অথচ আমাদের গড় আয়ু বেড়েই চলছে। জান/আত্মাকে ছিনিয়ে নিতে আসা যমদূতদেরই যেন এরা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে!
গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার কারণগুলো আমরা চিন্তা করি—
০১। নবজাতকের মৃত্যুর হার হ্রাস ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস।
০২। গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সময়ে মায়ের মৃত্যু হার হ্রাস।
০৩। চিকিৎসাসেবা গ্রহণের হার বৃদ্ধি।
০৪। রোগের টিকা গ্রহণ।
০৫। ঘরের কাছে চিকিৎসা সেবা চলে এসেছে।
০৬। মানুষ পুষ্টিকর ও পরিমাণ মতো খাবার খাচ্ছে।
০৭। খাদ্যগ্রহণ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ছে।
০৮। ভাল সেনিট্রেশনের ব্যবস্থা।
০৯। নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবহার।
১০। চিকিৎসার মান উন্নয়ন।
১১। শিক্ষা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন।
আমরা আরো অসংখ্য বিষয় ভাবতে পারবো। কিন্তু এমন একজনও বলবেন না যে, গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণ হল মানুষ ধর্মকর্ম করা বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার দেখুন যে সব দেশের মানুষ ধর্মকর্ম করা ছেড়ে দিয়েছে সে সব দেশের মানুষেরই গড় আয়ু অধিক হারে বেড়েছে।
দেশগুলো আমরা দেখি—
১) জাপানে নাস্তিক ৬০% এবং গড় আয়ু পৃথিবীর সর্বোচ্চ ৮৪ বছর।
২) অষ্ট্রেলিয়ায় নাস্তিক ৬৩% এবং গড় আয়ু পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৩ বছর।
৩) নরওয়েতে নাস্তিক ৬২% এবং গড় আয়ু ৮২ বছর।
৪) সুইডেনে নাস্তিক ৭৩% এবং গড় আয়ু ৮২ বছর।
৫) স্পেনে নাস্কিক ৫৭% এবং গড় আয়ু ৮২ বছর।
৬) যুক্তরাজ্যে নাস্তিক ৬৯% এবং গড় আয়ু ৮১ বছর।
৭) বেলজিয়ামে নাস্তিক ৬৪% এবং গড় আয়ু ৮০ বছর।
এই বিস্ময়কর ডাটা আমাদের কি শিক্ষা দিবে? তুলনা করে অনায়াসেই বলা যায়, যে দেশে মানুষ কম ধর্মকর্ম করে সে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি। মানে ধর্ম না-মানার সাথেও গড় আয়ু বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক রয়েছে। আবার দেখুন এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব ভাল। এদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও উন্নত। ফলে এদের গড় আয়ু যেমন ৮০-৮৪ বছর আবার এসব দেশে ধর্ম না-মানা মানুষের সংখ্যাও ৫৭%-৭৩%। ফলে অনায়াসেই বলা যায় শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ধর্ম না-মানার সাথে আয়ুর একটা সম্পর্ক রয়েছে।
বিপরীত একটা চিত্রও দেখতে পারি—
আফগানিস্তানে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০০% এবং গড় আয়ু মাত্র ৪২* বছর যা পৃথিবীতে সর্বনিম্ন। খারাপ গড় আয়ুর আরো কয়েকটি দেশ হল- মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, সিয়েরা লিওন, চাদ, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, মোজাম্বিক, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, জিম্বাবুয়ে, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, নাইজার ও উগান্ডা। এই দেশগুলোর মানুষও খুব ধর্মকর্ম বিশ্বাস করে। আফগানিস্তানে শিশু মৃত্যুর হার বিশ্বে সর্বোচ্চ।
এখানে ১০০০-এ ১৬০ টি শিশুই জন্মেই মারা যায়। ধর্ম বিশ্বাসী দেশগুলোর গড় আয়ু কম কেন? বাস্তবিক ধর্ম বিশ্বেসের সাথে এর সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। এই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ, শিক্ষার অবস্থা খারাপ। এসব কারণেই মানুষ এসব দেশে ধর্মান্ধ হয়েছে আবার এসব কারণেই গড় আয়ুও কম।
বেঁচে থাকা নিয়ে আমাদের দেশে বহু কথা হয়। কথায় কথায় বলে, মিয়া মরবা না! আয়ুর একদিনও বেশি বাঁচবা না। বাস্তবিক এগুলো সবই ফালতু কথা। আয়ু বৃদ্ধির সাথে যে অনুসঙ্গগুলো জড়িত তার সাথে ধর্মের ইতিবাচক কোন সম্পর্ক নেই, রয়েছে নেতিবাচক সম্পর্ক। যেসব দেশের মানুষের আয়ু অনেক বেশি, তারাতো এসব ফালতু কথা বলে না। তাদের আত্মার শাস্তি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কেউ তাদের জান কবজ করতে আসবে, সে বিশ্বাসও তারা করে না। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে তারা জেনে নিয়েছে কিভাবে আয়ু বাড়াতে হয়। তারা যমদূতদের দূরে সরিয়ে রেখে বেঁচে থাকছে দীর্ঘদিন। আয়ুর একদিনও বেশি বাঁচবো না, এমন ধারণা সভ্য দেশগুলো করে না। যেসব দেশ অন্ধ বিশ্বাসে নিমজ্জিত, হায়! তাদের আয়ুই সবচেয়ে কম৷
* আফগানিস্তানের গড় আয়ু একেক তথ্যসূত্রে একেক রকম। যেমন উইকিপিডিয়াতে আছে ৪৩ বছর, বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সংবাদে আছে ৪২ বছর। আফগানিস্তানের সংবাদগুলো সম্ভবত হালনাগাদ নয়।
লেখক: মুজিব রহমান