“বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে” সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই বিখ্যাত উক্তিটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। অর্থাৎ বন্যপ্রাণীরা সর্বদাই বনের শোভাবর্ধন করে। তাদের বিচরণে বন জঙ্গল ভরে ওঠে আপন সৌন্দর্যের সহাবস্থানে। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে বন জঙ্গলের এক আত্মিক নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টির উষা লগ্ন থেকেই। জঙ্গল ও বন্যপ্রাণী যেন একে অপরের সুখে দুখের সাথী বেঁচে থাকার পরিপূরক।কিন্তু আজ এই বন্য প্রাণীদের অস্তিত্ব সংকটময়। আর এই সংকটজনক পরিস্থিতি দূর করার জন্য ২০১৩ সালের ২০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ৩রা মার্চ “বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস” হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তারপর থেকেই ২০১৪ সালে প্রথম এ দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এই দিবসের মূল লক্ষ্য।জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বিবরণীতে বন্যপ্রাণীদের অপরিহার্য মূল্য এবং বিভিন্ন অবদানের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এতে পরিবেশগত, জিনতাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিষয়ক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক এবং নান্দনিক বিষয়ের সঙ্গে যুগসই উন্নয়ন এবং মানবকল্যাণের দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা গড়ে তোলা, এবং সিআইটিইএস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করা বলা হয় আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য যাতে বন্য প্রজাতিদের টিকে থাকতে হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বে এ পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ।
পৃথিবীকে যান্ত্রিক আধুনিকতার ছোঁয়া যত স্পর্শ করছে, মানুষের চাহিদা ততোধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা সকলে নিজের নিজের স্বার্থ অনুযায়ী বনজ সম্পদকে ধ্বংস করার কাজে উদ্যত হয়েছি। আর এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণীরা। এরা যে শুধু নিজেদের বাসস্থানই হারাচ্ছে তা নয়, এর সঙ্গে তারা চরম খাদ্য সংকটে মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ তারা লোকালয়ে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলত, সেই সমস্ত বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ের বাসিন্দাদের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বনভূমির সংখ্যা এতই সীমিতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে যে, বন্যপ্রাণীরা অজান্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বনের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বন্যপ্রাণীরা আজ কিছুটা হলেও বিলুপ্তির পথে। তাই এই বিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীদের সমানভাবে মর্যাদা দিতে এবং তাদের সংরক্ষণ করার জন্য আজকের এই দিনটি পালন করা অত্যন্ত জরুরি।গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রায় ৮০০০ প্রজাতির বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে গিয়েছে। অনেক সময়, এটাও বিশ্বাস করা হয় যে এক মিলিয়ন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এই সকল প্রজাতিগুলোকে বাঁচাতে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস (World Wildlife Day) পালন করা হয়। সেই থেকে ৩ মার্চ দিনটি বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এবছর২০২৩ সালের বিষয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য অংশীদারিত্ব। বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ২০২৩ এর থিম হল “বন এবং জীবিকা: মানুষ এবং গ্রহকে টিকিয়ে রাখা”। বনভূমি, তাদের বাস্তুতন্ত্র এবং তাদের মধ্যে থাকা বন্যপ্রাণী বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আদিবাসী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে বন ও বন-সংলগ্ন এলাকার ঐতিহাসিক সম্পর্কযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর ফোকাস করা হয়। থিমটি প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্বকেও তুলে ধরে।পৃথিবীতে অংখ্য প্রজাতি রয়েছে। এবং প্রত্যেকটিই পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মরুভূমি, তৃণভূমি, জঙ্গল ও অন্যান্য পরিবেশে থাকে তারা। বর্তমান আধুনিকতার দৌড়ে আমরা টেকনোলজি নির্ভর হয়ে গিয়েছি। সে কারণেই হোক কিংবা পরিবেশের পরিবর্তনের জন্য এই সকল বন্যপ্রাণী নানা রকম সমস্যায় পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তেমনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ। তেমনই সমস্যার মুখে বহু প্রজাতি। এই সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীদের রক্ষার্থে নতুন পদক্ষেপ গৃহীত হয় প্রতিবছর। এছাড়াও, শিকার, চোরাচালনের মতো বহু কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন উদ্ভিদ। যা খারাপ প্রভাব ফেলছে আমাদেরই পরিবেশের ওপর। আমাদের কার্যকলাপের জন্যই সমস্যায় এই সকল প্রাণী। আফ্রিকান বন্য হাতি, সুন্দর বনের বাঘ, ডলফিনের মতো প্রাণী, গুরাংগুটান-এর মতো একাধিক প্রাণীরা সমস্যার মুখে। বিলুপ্ত হতে চলেছে বহু প্রজাতি। এই সকল বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন পরিবেশবীদেরা। বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভারত সরকার কর্তৃক ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন, ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন এবং ১৯৮৬ সালের পরিবেশ সুরক্ষা আইন সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত এবং জীববৈচিত্র্য আইন পাস করা হয়েছে। ভারত প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রকল্প এবং প্রকল্পেও স্বাক্ষর করেছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া সরকার ও নাগরিক উভয়েরই দায়িত্ব। বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসে আমরা বন্যপ্রাণীদের বিপন্নতার হাত থেকে রক্ষা করতে আরো বেশি মানবিক ও সচেতন হয়ে ওঠি। আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই এই বাসযোগ্য পৃথিবীতে বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্বও গুরুত্বপূর্ণ। এ পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার্থে বন্য প্রাণীর পাশাপাশি বন জঙ্গলের প্রভাব অপরিসীম। আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার যতটুকু তাদেরও ততটুকু। বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই বন্যপ্রাণীদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করি।#