পুরো নাম ফুলপরী খাতুন। ভ্যানচালক বাবা ও গৃহিণী মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বড় দুই ভাইবোন উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ দুই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত।
অগ্রজদের দেখানো পথে হেঁটেছেন ফুলপরীও। চোখেমুখে স্বপ্ন আর উচ্ছ্বাস নিয়ে পা রাখেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি)। গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় ক্লাস। সবকিছু ঠিকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ বিপত্তি দেখা দেয় আবাসিক হলে ওঠা নিয়ে। এরপর দুই দফায় নির্যাতনের শিকার হয়ে আপন নীড়ে ফিরতে বাধ্য হন ফুলপরী।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম অনুসারে , ঘটনাটি ছিল ছাত্রলীগ নেত্রীর অনুমতি না নেওয়াকে কেন্দ্র করে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা আবাসিক হলে ফুলপরী ওঠেন এক পরিচিত বড় বোনের সিটে। বিষয়টি জানতে পেরে গত ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ফুলপরীকে রাতভর নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ফিন্যান্স বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম ইসলামসহ আরও ৭-৮ জন জড়িত বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।
তবে এ ঘটনায় চুপসে যাননি ফুলপরী। বাবার সাহস আর পরিবারের সহযোগিতায় আবারও ফিরে আসেন ক্যাম্পাসে। প্রতিবাদমুখর হয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ দেন তিনি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিবাদী ফুলপরী খাতুন বলেন, ‘বাবা কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি হয়তো খুব ক্ষুদ্র পেশার মানুষ কিন্তু সৎ ও নিষ্ঠাবান। আমাদেরকে শিখিয়েছেন অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করতে। এমনকি তিনি আজীবন এভাবেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই আমিও কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করবো না। সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাবো।’
ফুলপরীর এ সাহসিকতাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের ভাষ্যমতে, প্রতিবাদী হতে যে মানসিকতা বা সাহস থাকা দরকার ফুলপরী সেটা করে দেখিয়েছেন।
সেদিন রাতের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে ফুলপরী বলেন, “অন্তরা আপু, তাবাসসুম, উর্মি, মিম, মুয়াবিয়াসহ ৭-৮ জন আপু উপস্থিত ছিল। তারা নানাভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে। আপুরা হুমকি দিয়ে বলছিল, ‘এসব বাইরে বললে একেবারে মেরে ফেলবো। তোকে উলঙ্গ করে এখান থেকে বের করে দেবো। এই কথা বাইরে গেলে ভিডিও ভাইরাল করে দেবো’।”
তিনি আরও বলেন, ‘তারা আমাকে নির্যাতন করে আনন্দ পাচ্ছিল, হাসাহাসি করছিল। তারা এতটাই মজা পাচ্ছিল যে রাত পার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। এমন নির্যাতনের পর অনেকেই ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। কিন্তু ওই হলের কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি।’
দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান ফুলপরী খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা তো আর ফিরে আসবে না। তবে অভিযুক্তদের এমন শাস্তি হোক যেন আর কেউ এমন কিছু করার সাহস না দেখায়। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আর আমি ক্যাম্পাসে ফিরতে চাই।’
এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী গাজী মো. মহসীন ও আজগর হোসেন তুহিন। তখন তাদের লিখিত আবেদন দিতে বলেন আদালত। সে অনুসারে তারা জনস্বার্থে রিট করেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি রিটের শুনানি শেষে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া অভিযুক্তদের ক্যাম্পাসের বাইরে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে ১৯ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। এরই মধ্যে শনি, সোম ও বুধবার ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্তদের বক্তব্য শুনেছে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির প্রধান মুন্সি সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটি পুরো ঘটনার বর্ণনা তার মুখ থেকে শোনে এবং তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে।
রোববার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল।
এদিকে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিবাদ জানানো ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের সাহসিকতা ও অদম্য স্পৃহার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছেন, ফুলপরী বাংলাদেশে বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের সত্যিকারের উত্তরসূরি। ফুলপরী ছাত্রলীগের প্রতিবাদের নাম। ফুলপরী ন্যায়বিচারের প্রতীকের নাম। ছাত্রলীগ ফুলপরীদের পক্ষে রয়েছে। রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এসব কথা বলেন।