বাবা রবার্ট আর্তভেলিয়াশভিলি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ আইনজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ। ছেলে যুরাব আর্তভেলিয়াশভিলি সোভিয়েত উত্তর প্রজন্মের জর্জিয়ান ভাষার শীর্ষস্থানীয় কবি। যিনি আন্তর্জাতিক লেখালেখির জগতে কবিতার একনায়ক হিসেবে পরিচিত। যিনি জন্মেছিলেন ১৯৬৭ সালে কাজাখাস্তানে। বাবা জর্জিয়ার আর মা মস্কোর, বাবার ভাষা ও জাতীয়তা জর্জিয়ান আর মায়ের রাশিয়ান। শৈশবে মা বাবার বিচ্ছেদ হয়। যুরাব থেকে যান বাবার সঙ্গে জর্জিয়ায়। তার তারুণ্যে সোভিয়েত জামানার অবসান হয়। ১৯৯১ সালে জর্জিয়া সোভিয়েত শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
অনেকের মাঝে খটকা কাজ করে দুটো জর্জিয়া নিয়ে। একটা জর্জিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য। আর আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য বর্তমানে স্বাধীন দেশ জর্জিয়া। এই জর্জিয়ায় জন্ম সোভিয়েত নেতা যোসেফ স্ট্যালিনের। এখানে জন্ম বিশ্ববিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির
এবার কবি যুরাব আর্তভেলিয়াশভিলি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সোভিয়েত উত্তর স্বাধীন জর্জিয়ায় যুরাবের সামনে চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি সবদিকে অবারিত সম্ভাবনা বসন্তে ঝরাপাতার মতই ছড়ানো ছিটানো ছিল। কিন্তু ওসব তো তাকে দিয়ে হবার নয়। যুরাবের প্রতিভা ছিল কবিতার শিল্প সাহিত্যের; অভিনয়ের আর তীক্ষœ মানবদৃষ্টি, গভীর অর্ন্তদৃষ্টি আর বিরল কল্পনাশক্তি। একবার কথা প্রসঙ্গে যুরাব আমাকে বলেছিল, “আনিসুর, তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমার ভাই। এই দুনিয়ায় মানুষরূপী মিথ্যা মানুষ ভুরিভুরি। কথা ও কাজে কোন মিল নাই। মনুষ্য বোধ নাই। বড়ই তুচ্ছ তাদের দেখার, বোঝার এবং চাওয়ার ব্যাপারগুলো। এই ধরো আমার জন্ম হয়েছে কবিতা লেখার জন্যে, শিল্পসাহিত্যে জীবন পার করে দেবার জন্যে। আমাকে দিয়ে রাজনীতি, ব্যবসা, চাকরিবাকরি এসব কি সম্ভব? এসব তো আমাকে টানে না। আমার দরকার খেয়ে পরে বাঁচার জন্যে নির্দিষ্ট কিছু টাকা, আর আমার ছেলে আর বউসহ ছোট পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন। ভরসা নাই, কোথাও নাই। না সুইডেনে, না জর্জিয়ায়, দুনিয়ার কোথাও নাই। বাবার রেখে যাওয়া বাসাটা, এই আমার বিষয় আশয়। আমার যোগ্যতা, আর ভালোলাগা অনুযায়ী কিছু একটা কাজ আমার চাই। আমি কি দ্বারে দ্বারে ঘুরব? সরকারে যারা তারা আমার বন্ধু। তারা কি আমার সমস্যাটা বোঝে না?
এরকম ছিল যুরাবের সঙ্গে এই বছরের শুরুর দিকে একদিনের টেলিফোন আলাপের অংশবিশেষ।
এই পর্যায়ে যুরাবের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং তার লেখক এবং অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কথা বলতে চাই।
যুরাবের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১০ সালে স্টকহোমের আন্তর্জাতিক কবিতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে। সুইডেন, ইরান, বাংলাদেশ এবং জর্জিয়ার কয়েকজন কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল স্টকহোমের লেখক কেন্দ্র এই আয়োজিত অনুষ্ঠানে। আমাদের কবিতা আর পরিচিতি নিয়ে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়েছি
যুরাবের সঙ্গে কবিতার মঞ্চে প্রথম পরিচয়ে টের পেয়েছিলাম এ যেন আপনভোলা জাতকবি। তারপর অবাক করা ধ্বনিকাব্যের উদ্ভাবন অকল্পনীয়। শব্দের উচ্চারণ দ্যোতনায় অর্থ চিত্র আর প্রতিবেশ আমূল বদলে ফেলার সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিরল প্রতিভা তার ছিল। এরপরে অসংখ্যবার ইউরোপের নানা শহরে প্রতিষ্ঠানে বিবিধ আয়োজনে একসঙ্গে অংশ নিয়েছি। যুরাব ছিল সব অনুষ্ঠানে রাজা। রাজার পরে আর কারো কথা চলে না। যুরাবের আবৃত্তি অভিনয় বা উপস্থাপনা এত মনোমুগ্ধকর ও শক্তিশালী, তার পরে অন্য কারো উপস্থাপন বা পাঠ মাঠে মারা যায়। তাই এটা একটা রীতিই হয়ে গিয়েছিল অনুষ্ঠান শেষ হবে যুরাবের কবিতা পাঠ বা ধ্বনিকাব্যের উপস্থাপনা দিয়ে।
প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই আস্তে আস্তে আমরা পারিবারিক বন্ধু হয়ে যাই। এরপর সুখে দুঃখের অনেক গল্প অনেক স্মৃতি। এই যুরাব কবি হিসেবে নিজের দেশ জর্জিয়া এবং দ্বিতীয় দেশ সুইডেন তো বটে, অন্যান্য দেশেও ঈর্ষণীয় রকম সমাদৃত। ওর প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ জর্জিয়ান ভাষায় তিনটি, সুইডিশে দুটি, জার্মানে একটি এবং ইংরেজিতে একটি। বিচ্ছিন্নভাবে এবং নানা সঙ্কলনে অনেক ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত এবং সমাদৃত হয়েছে তার কবিতা।
ওর ব্যক্তিত্ব অভিনয় এবং কবিতার মধ্যে কোথাও একটা দৃশ্যমান আর অদৃশ্য সম্মোহনী শক্তি ছিল। ওর কবিতা পড়ে বা পাঠ শুনে পছন্দ করেনি এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কি বাংলাদেশের সাহিত্য পরিম-লে যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন, ওর কবিতা পড়েছেন, শুনেছেন, আমার জানা মতে তাদের কয়েকজন হচ্ছেন শামসুজ্জামান খান, তকির হোসেন, হারিসুল হক, শামসাদ বেগম, সুজন বড়–য়া, মুহাম্মদ সামাদ, তারিক সুজাত, নাহিদ কায়সার, মুহম্মদ নুরুল হুদা এবং রাজু আলাউদ্দিন। অধ্যাপক সামাদ তার কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে আর্টস ডট বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমে ছেপেছেনও। পরে সেগুলো জার্নিম্যান থেকে প্রকাশিত “সাত দেশের কবিতা” সঙ্কলনেও অন্তর্ভুক্ত হয়
যুরাবের ভেতর ও বাহির এক ও একাকার। প্রতিভার স্বতস্ফুর্ত সূর্য তেজ ছিল তার মাঝে। কিন্তু মেধার চতুরতা ছিল না। সরল সহজ ও সুন্দরের সহজাত প্রকাশ ছিল তার কথায় ও লেখায়, অভিনয় ও কল্পনায়।
২০০৮-২০০৯ সালের দিকে জর্জিয়ার রাজনীতি টালমাটাল। সরকারের মাথায় স্বৈরতন্ত্র ভর করে। দেশের রাজধানী তিবলিসির কেন্দ্রের বিশাল জনতার সামবেশে স্বৈরতন্ত্রেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখা কবিতা পড়ে মসনদের ভিত কাঁপিয়ে দেন কবি যুরাব। যুরাবের তো এত অগ্রপশ্চাৎ নিয়ে হিসেব নিকেশ নাই। তার মনে যা লয়েছে কলমে লিখেছেন, মঞ্চে এসে পড়েছেন। তাতেই মসনদ কেঁপে গেল। মসনদের কারবারিরা ভয় পেয়ে গেল। ভয়ের অন্য কারণও ছিল। যুরাবের বাবা যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, তাই তারা আশঙ্কা করছিলেন যুরাবের যে জনপ্রিয়তা সে কি না আবার মসনদ দখল করে বসে। কিন্তু যুরাব তো ঐ পথের পথিক না। যুরাব যে কবিতার একনায়ক। মসনদের কারবারিরা কবিতার একনায়ককে স্বস্তি দিলেন না। তাকে বিপদের মুখে ফেললেন। শেষতক দুঃখ কষ্টে অভিমানে প্রথমে গোথেনবার্গে আবাসিক লেখক হিসেবে পরে স্টকহোমের অতিথি লেখক হিসেবে নির্বাসিত জীবন শুরু করেন। এর কয়েক বছর পরে জর্জিয়ার মসনদে স্বৈরাচারী আমলের অবসান হয়
বর্তমানে জর্জিয়ার রাষ্ট্রপতি থেকে সরকারের অনেকে তার ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন্তু ক্ষমতাবানদের সেই সব বন্ধুত্ব কাজে লাগিয়ে নিজের সুবিধা ভাগিয়ে নেবার মত রুচি ও ব্যক্তিত্ব কোনটাই যুরাবের ছিল না। এটা সকলে জানত, তাই জর্জিয়ার মানুষ তাঁকে দেবতার মত সমীহ করে। বেশ কয়েক বছর ইউরোপে থাকার পর প্রথম যেদিন তিবলিসির উদ্দেশে যাত্রা করে, জর্জিয়ার জাতীয় টেলিভিশন দুইজন সাংবাদিক পাঠিয়েছিল যুরাবের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে। তার যাত্রার প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রচারের জন্যে। এমনকি ইউরোপে থাকার সময় তিবলিসি থেকে সাংবাদিক পাঠানো হতো যুরাবের লেখালেখি নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্যে।
ইউরোপ আমার নিজের ভূমি না, যুরাবেরও না। একবার আমি দেশে আসব। যুরাব ফোন করে বলল, এই তুমি যেন কবে দেশে যাবে?
সপ্তাহ খানেক পরে।
ঠিক আছে তুমি যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে, একটা প্রয়োজনে।
কি প্রয়োজন বলা যাবে?
না, তেমন কিছু না। তোমার সঙ্গে একটু কফি খাবো।
কবে আসবে?
যে কোন দিন। ফোন করব তার আগে।
যথারীতি একদিন ওর বউকে নিয়ে হাজির। কফিটফি খেয়ে যাবার আগ মুহুর্তে ওর বউকে বললো, তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি। এই কথা বলে আমাকে হাত ধরে একটু ধরে টেনে নিয়ে একটা কাগজের খাম আমার পকেটে পুরে দিল। আমি বের করে বললাম, এটা কি?
এটা কিছু না এখানে কিছু ইউরো আছে। তুমি তো আমার কেবল বন্ধু নও। আমার ভাইও। আমার কোন ভাই নাই। আমরা দুই ভাই। অনেকদিন পর দেশে যাবে, ইউরোগুলো কাজে লাগবে।
আমি বললাম, আমার যথেষ্ট টাকা আছে। তুমি চিন্তা করো না। এটা রাখো। বরং তোমারই দরকার হতে পারে।
কথা বাড়াইও না। তোমার হাজার থাকলেও ভাইয়েরটা নিতে হয়
এরকম ছিল যুরাবের দৃষ্টিভঙ্গি। আরেকবার তিবলিসি আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে আমার অংশগ্রহণের জন্যে প্রয়োজনীয় সব যোগাযোগ করেছে এবং আমার কবিতা অই দেশের ভাষায় অনুবাদ করে দেশের প্রাচীন এবং শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশ করেছে। থিয়েটার, বিশ্ববিদ্যালয় আর সম্পাদক লেখক কবিদের সঙ্গে আমার জন্যে মেইল করে, টেলিফোন করে যোগাযোগ করে সব বন্দোবস্ত করেছে উচ্ছাসের সঙ্গে। তারপর তিবলিসি যাবার আগ মুহুর্তে এসেছে আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে। আড্ডার এক পর্যায়ে বললো, আমার তো পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। আমি তো তোমার সঙ্গে যেতে পারছি না। যেতে পারলে ভাল হতো। তুমি যাচ্ছ আমার প্রতিনিধি হয়ে। আমি বলি, রাজার প্রতিনিধি, ভালই তো।
তখন যুরাব বললো, আমি রাজা নই, কবিতার একনায়ক। তুমি তিবলিসি গেলে বুঝতে পারবে।
সত্যিই সে কবিতার একনায়ক।
আমি তাকে বলি কবিতার রাজা, তিনি নিজেকে বলেন, কবিতার একনায়ক। সেই যুরাব আর্তভেলিয়াশভিলি ২০ এপ্রিল ২০২১ তারিখে কর্কশ রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোগ গমন করেন। আফসোস তার রোগ ধরা পড়ে শেষ মুহর্তে এসে, সপ্তাহ কয়েক আগে। ভাবতে কষ্ট হয়, দেশের রাষ্ট্রপতি যার বান্ধবী, একগাদা বন্ধুস্থানীয় মানুষ মন্ত্রীর আসনে, সেই যুরাবের জীবন ও যাপন, চিকিৎসা ও টিকে থাকা হোচট খেয়েছিল টাকার অভাবেই। কারণ যুরাবের তেলেসমাতি চাতুরি ছিল না সফল হবার এবং আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতায় থাকা মানুষদের তোষামোদ করে সুযোগ সুবিধা ভাগিয়ে নেবার জন্যে। আমার সঙ্গে নিয়মিত কথা হত। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, সরকারে তোমার বন্ধুবান্ধবরাই, তারা তোমার জন্যে কিছু করছে না কেন?
যুরাব জানাল, এটাই তো বিব্রতকর। আমি কি সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে নিজের মর্যাদা খুইয়ে তাদের কাছে ধর্না দেব? করোনা যাক, নিজের পথ নিজে করে নেব।
ওরা কি বুঝে না আমার অবস্থাটা?
যুরাবের অভিমানটা ছিল এমনই
শেষতক সবারই টনক নড়ল। দেশটার গোটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সর্বশক্তি নিয়োগ করলো যুরাবের চিকিৎসার পেছনে। বিশেষ বিমান প্রস্তুত থাকল তাকে বিদেশে পাঠাবার ব্যাপারে। কিন্তু ততদিনে অভিমানী যুরাবের আর সময় নাই। তিনি আত্মসম্মানকে শিরোধার্য করে চলে গেলেন।
শেষের দিনগুলোতে কথা বলার, এমনকি ক্ষুদেবার্তা লেখার শক্তিটাই আর ছিল না তার। যখনই একটু শক্তি পেতো আমার সঙ্গে যোগাযোগ হতো।
কবিতার এই একনায়কের কেবল কবিতা এবং সৃষ্টিশীলতার জন্যে বেকারত্ব পেছন ছাড়েনি। আশার কথা কাব্যদেবী তাকে ছেড়ে যায়নি কখনো। গুটি কয়েক কবিতার বই প্রকাশ করে পাঠক মহলে পেয়েছেন দেবতার আসন।
কবিতার পাশাপাশি তার ছিল অভিনব অভিনয় প্রতিভা। তিনি মূলত ইউরোপের বিভিন্ন নাট্যমঞ্চে অভিনয় করেছেন। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছেন। কী তার কবিতা, অভিনয় আর সামগ্রিক সৃষ্টিশীলতায় তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী দাদা। দাদা তত্ত্বের গুরু। তার জীবনও ছিল তাই। গোটা জীবন ঢেলেছিলেন উজার করে প্রতিভার খেয়ালে আপনভোলা জাতশিল্পী, জাতকবি যুরাব আর্তভেলিরাশভিলি।
তিনি আমার একটি ছোট কাব্য স্বগতসংলাপে একক অভিনয় করেছিলেন সুইডেনের থিয়েটার ব্লাঙ্কায়। তিনি এ বছর শেষের দিকে ঢাকা সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমার লেখা এপিক মনোলগ, ‘আমি শেখ মুজিব’ জর্জিয়ান ভাষায় ঢাকার মঞ্চে উপস্থাপন করবেন। সে সুযোগ আর থাকল না।
অসুস্থ হবার মাস দেড়েক আগে এ বছরের শুরুর দিকে আমাকে অভিনন্দন লিখে একটা ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছে। আমি কিছু বুঝিনি। না বুঝে ফোন করেছি।
অভিনন্দন কেন? তুমি এই বার্তা ভুলে পাঠাওনি তো?
না ভুলে পাঠাইনি। তোমাকেই পাঠিয়েছি। তোমার বই জর্জিয়ান ভাষায় প্রকাশের জন্যে লেখক ভবনের অনুবাদ প্রকল্পে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পেয়েছে। তোমার বই খুব সহসাই জর্জিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। তুমি খবরটা এখনও পাওনি?
না।
ও! এতদিনে এত খারাপ সময়ের মধ্যে একটা ভাল খবর।
এই কথা বলে যুরাবের কি যে উচ্ছাস। মনে হচ্ছিল উত্তেজনায় যুরাব যেন নাচা শুরু করে দিবে। বইটা প্রকাশ পেল ঠিকই। ততদিনে তার স্বাস্থ্য আর ঠিক নাই। ব্যাথা যন্ত্রণা বিরামহীন। দিন দিন দুনিয়ার সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি সরে যাচ্ছেন। হলোও তাই।
যুরাব জগতের এফোঁড় ওফোঁড় দেখার দৃষ্টি আর কল্পনাশক্তি পেয়েছিল। জগত তার মনটা বুঝতে চায়নি, বুঝতে পারেনি, বুঝেনি তার অভিমানের ভাষা। দাদা গুরুর ভাষা বোঝা দায়। আরো দায় একনায়কের মন বোঝার। কবিতার একনায়ক তো আরো দূরহ। যুরাব ‘কবিতার একনায়ক’, তা কেবল কথার কথা ছিল না। ‘কবিতার একনায়ক’, বা “কবিতার একনায়কতন্ত্র” নামে তার একটি কাব্যগ্রন্থও ছিল। যুরাব আর্তভেলিয়শিভিলির একটি কবিতার অনুবাদ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।
প্রেমিক পুলিশ
[তিবলিসি লিমিটেডের জন্যে]
শহরে কি ঘটবে (?)
কেউ কিছু জানে না
পথে পুলিশ ছুটে
যেন আকাশ ভাবে।
এই পথে কি ঘটবে?
পথের শুরুতেই পরিস্কার হবে প্রেমিক পুলিশ
পথে ছুটে! ছুটে চলা ভাবে আকাশ।
নগরের এমনটা কখনো ঘটেনি
প্রত্যেকে একে অপরকে ভালো লেগেছিল
বিশ্বাস করুন, এটা কখনো ঘটবে না
কেউ কেউ সব সময় কিছুটা তীক্ষœ হবে (!)
আকাশে গোটা চাঁদের দেখা মেলে
পথ তার নিশানা হারায়
পাতিল পেটের ভ্যাস্পায়ারেরা ব্লাডব্যাংকের কাছে জড়ো হয়।
নগরে কি ঘটবে (?)
কেউ কিছু জানে না
যতক্ষণ প্রেমিক পুলিশ
রাস্তা ধরে ছুটে আসে।