আজ মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর সংহতির দিন। বঞ্চনা থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বের শ্রমিকেরা ফি বছর আন্তর্জাতিক মে দিবস পালন করেন।
মানব সভ্যতার উষালগ্নে মানুষের খাদ্য সংকট দূরীকরণে এক শ্রেণির মানুষ কৃষিকাজে শ্রম দিতে শুরু করেছিল আর অপর শ্রেণি ছিল ভূস্বামী বা জমির মালিক। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল কর্ম বিভাজন এবং সমাজে তৈরি হয়েছে শ্রেণি বৈষম্য। সে সময়ে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা ভাবেনি, দৈনিক কত ঘন্টা ফসলের মাঠে শ্রম দেওয়া উচিত! বুদ্ধিমান সুবিধাভোগী মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে বিনা পরিশ্রমে কিভাবে অপরের শ্রমের উপরে নির্ভর করে ধনবান হওয়া যায়! এই ধারণা থেকেই পরবর্তী কালে বিশেষত প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় দাসপ্রথা গড়ে উঠেছিল।
ক্রমশ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠল। সেসব প্রতিষ্ঠানে জীবিকা নির্বাহের জন্য বহু শ্রমিক কাজে নিয়োজিত হলেন। বহু দশক জুড়ে এ ধরনের শ্রমিকদের নির্দিষ্ট শ্রমদিবস ছিল না। মালিকের প্রয়োজন ও ইচ্ছানুযায়ী, শ্রমিকদের কাজ করতে হত। দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় পারিশ্রমিক ছিল নগণ্য। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে এ ধরনের শ্রমজীবী মানুষের সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। সেদিন হাজার হাজার শ্রমিকের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ৬জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল। আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে কয়েকজন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন বাড়তে শুরু করলো। সেসময় আমেরিকায় শ্রমিকদের মধ্যে থেকে গড়ে উঠেছে সমাজবাদী, বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন, ক্লাব…।
গত বছর থেকে বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারী চলছে। বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ অতীতের তুলনায় যতটা এগিয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে শ্রমিকদের ত্যাগ ও সংগ্রাম। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের উৎপাদনের চাকা সচল রাখে শ্রমিকেরা; কিন্তু প্রাকৃতিক এই মহামারি-দুর্যোগের মধ্যে শ্রমিকরা সবচেয়ে অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। করোনা বিপর্যয়ের সময়ে মালিক পক্ষের শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই ও কারখানা লে-অফের মত অমানবিক পদক্ষেপের ফলে লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সরকার মালিকদেরকে প্রণোদনা দিলেও, যার সুফল থেকে শ্রমিকেরাই বঞ্চিতই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের শ্রমিকের সময়, শ্রমের বিনিময়ে পাওনা ন্যয্য মজুরির দাবি উপেক্ষিত এবং শ্রমজীবী মানুষেরা মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা কাগজে কলমে লিখিত সেসব নিয়মের বাস্তবায়ন এখনো হয়নি।
মে দিবস যেমন বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি বাড়িয়েছে, তেমনি শ্রমিকের উপর শোষণের বিরুদ্ধেও প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। মে দিবসের পথ ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের অধিকার, বিশেষ করে মজুরি, কাজের পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা—এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কিন্তু গত দুই দশকে বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনা। বর্তমাল প্রযুক্তির যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বে শিল্প খাতে উন্নত প্রযুক্তির আগমনে উৎপাদনের পরিমান ও পণ্যের মান দুটিই বাড়ছে। শ্রমিকেরাই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত প্রযুক্তি, রোবট প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে শ্রমিকদের চাকরি হারানোর শুধু আশঙ্কা সৃষ্টি নয়, কাজ হারিয়ে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছে। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকেরা কাজে টিকে থাকলে মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণির শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছে। পুঁজির বিকাশ হচ্ছে, কিন্তু শ্রমিক সংগঠিত হতে পারছে না। মালিক যা খুশী দেবে, কিন্তু শ্রমিকের কি পাওয়া উচিত এবং কি পাওয়া দরকার – অর্থাৎ শ্রমিকের অধিকার ততটুকুই যা মালিক নির্ধারণ করে দেবে! মালিকেরা হয়তো ভাবছে, শ্রমিকের দরকার নেই, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি আসছে আসছে এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি আসবে। বকেয়া বেতন-ভাতা, চাকরি চ্যুতি, বন্ধ কারখানা খোলাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সহ বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় শ্রমিক সংগঠনগুলোকে। কিন্তু অটোমেশন এবং রোবট প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে সংকুচিত শ্রমবাজার নিয়ে নীরব ভূমিকায় রয়েছে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
গত দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশে কতগুলো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে? কত লক্ষ শ্রমিক কর্মহীন বেকার হয়ে পড়েছে? কতগুলো পরিবার দারিদ্রের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়েছে? এ দায় কার?
শ্রমিকের ন্যয্য অধিকারের দাবীতে বারবার আন্দোলন হয়েছে এখনো হচ্ছে। কিন্তু বড় আকারে গণশ্রমিকের আন্দোলন তেমন ভাবে না হওয়ায় শ্রমিকেরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে। অনুন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলোতে আইনের গ্যাড়াকলে অসংগঠিত শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চিত রয়ে গেছে। অদক্ষতার অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। মাঝ বয়সে এসে কর্মহীন হয়ে নতুন করে নিজেকে তৈরি করে আবার নতুন কোন কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। শ্রমিকের জীবনের মানবিক মৌলিক অধিকার ও শ্রমের মূল্য আজ যে পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার প্রতিটি দেশের, প্রতিটি সমাজের মানুষের।
বিশ্ব জুড়ে উন্নত প্রযুক্তি আর পুঁজিবাদ নানান ধরণের দূষণের দুষিত করে চলেছে পৃথিবী। প্রযুক্তির কারণে একদিকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানান রকমের দুষন। এসব চিন্তা থেকে দূরে রাখার জন্য মানুষের ভেতরে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদ, বিদ্বেষ।
সেদিন শ্রমিকের লড়াইটা শুরু হয়েছিল, মালিকের চাহিদানুযায়ী অতিরিক্ত কাজের বিরুদ্ধে কম কাজ করার লড়াই। নির্দিষ্ট কর্মমুজুরীর বিপরীতে দৈনিক ৮ঘন্টা শ্রমের লড়াই। অতিরিক্ত শ্রমের বিনিময়ে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাবার অধিকারের লড়াই। আজকের দিনে শ্রমিকের শোষিত হওয়ার ধরণটা বদলেছে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানব সম্পদ মূল্যহীন হচ্ছে। মানুষ বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছে। আজকের লড়াইটা চলছে- কাজ করে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার লড়াই। বেকারত্ব নয়, কাজ চাই। কোন অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই নয় বরং পণ্য উৎপাদনে জনশক্তিকে কাজে ব্যবহার করা চাই। বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদনে যদি জনশক্তির পরিবর্তে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকে তবে মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণির অদক্ষ শ্রমজীবী মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকবে! এই বিপুল পরিমানে জনসংখ্যার দেশে লিঙ্গ বৈষম্য ছাড়া (নারী পুরুষ) সকল কর্মক্ষম শ্রমজীবী মানুষকে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলে কাজে লাগানো ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।
দেশের সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রইল মহান মে দিবসের বিল্পবী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।