নারীশিক্ষা, নারী কর্মসংস্থান ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে বাংলাদেশে এখনো বিপুল বিরোধীতা রয়েছে।এখনো এদেশে অনেকে নারীদের ঘরথেকে বেড়িয়ে আসাকেই দেশের সবথেকে বড় সমস্যা বলে মনে করে।এখনো এদেশে শুনতে হয় মেয়েদের চতুর্থ শ্রেণীর বেশি পড়তে দেওয়া অনুচিত,গার্মেন্টসের মেয়েরা পতিতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা বেশ্যা, সিজার করা নারীরা কুত্তির চেয়েও অধম ইত্যাদি। এসব যারা বলেন তাদের অধিকাকাংশের কাছেই আবার সৌদি আরব আদর্শ বলে বিবেচিত। কিন্তু সৌদি আরব কি পেরেছে আজও তাদের নারীদেরকে ঘৃহকোণে বন্দী করে রাখতে? আদিম রক্ষণশীলতা থেকে তারাও কি ধীরেধীরে বেড়িয়ে আসছেনা?
তারাও কি আধুনিক বিশ্বের অগ্রযাত্রায় অংশ নিচ্ছেনা? চলুন দেখাযাক নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরব ইতিমধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
১৯৫৫ সালেই সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল ‘দার আল হানান’, ১৯৭০: মেয়েদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় রিয়াদ কলেজ অফ এডুকেশন। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এখন বিপুল সংখ্যক ছাত্রীকে স্কুলে যেতে দেখা যায়৷ কিন্তু প্রথমদিকে চিত্রটা এমন ছিল না৷ যাইহোক গত বিশবছরে সৌদি আরবে নারী অগ্রযাত্রায় বেশকিছু মাইলফলক যুক্ত হয়েছে।যেগুলো পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে দিয়েছে। যেমন-
২০০১: একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷ সৌদি আরবে নারীদের পরিচয়পত্র নিতে হলে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন হতো৷ ২০০১ সালে সৌদি নারীরা পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পরিচয়পত্র নেয়ার সুযোগ।
২০০৫: জোরপূর্বক বিয়ে সৌদি আরবে নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এই প্রথম বিয়ের ব্যাপারে স্বাধীনতা পেয়েছেন সৌদি আরবে নারীরা।
২০০৯: বাদশাহ আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় সরকারে প্রথম নারী মন্ত্রী নিয়োগ করেন৷ নূরা আল কায়েজ নারী বিষয়ক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সে বছর সরকারে যোগ দেন।
২০১২: এই বছরেই প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে অংশ নেন সৌদি নারীরা৷ তাঁদের মধ্যে সারাহ আত্তার নারীদের ৮০০ মিটার দৌড়ে লন্ডন অলিম্পিকের ট্র্যাকে নেমেছিলেন হিজাব পড়ে৷ আসর শুরুর আগে নারীদের অংশগ্রহণ করতে না দিলে সৌদি আরবকে অলিম্পিক থেকে বাদ দেয়ার কথা জানিয়েছিল আইওসি।
২০১৩: সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি পান নারীরা। ঐ বছর সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি পান সৌদি নারীরা৷ তবে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এবং ইসলামি রীতিতে পুরো শরীর ঢেকে এবং কোনো পুরুষ আত্মীয়ের উপস্থিতিতে তা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়৷
২০১৬: সৌদিতে মেয়েদের শারিরীক শিক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়।২০১৪ সালেই আইনটি প্রস্তাবিত হয়েছিল কিন্তু দেশের ধর্মিয় নেতাদের বিরোধীতায় সে বছর আইনটি করা যায়নি।
২০১৭: এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব দেশটির স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারপার্সন হিসেবে সারাহ আল সুহাইমির নাম ঘোষণা করে আরেক ইতিহাস রচনা।
২০১৭: মেয়েদের শরীরচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। জেদ্দায় জন্ম নেয়া হালা আল-হামরানি তাঁর শহরে ‘এফএলএজিবক্সিং’ নামে একটি ব্যক্তিগত জিম (শরীরচর্চা কেন্দ্র) চালু করেছেন৷ এফএলএজি মানে হচ্ছে ‘ফাইট লাইক এ গার্ল’৷ সেখানে মেয়েদের বক্সিং শেখান তিনি৷
২০১৮: এই বছরেই ২৬শে সেপ্টেম্বর সৌদি আরব নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে৷ ২০১৮ সালের জুন মাসে এই আদেশ কার্যকর হয়েছে৷ এর ফলে নারীদের আর কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না এবং স্বতন্ত্র লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা৷
২০১৮: পুরুষের অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা করার অনুমতি পান সৌদি নারীরা। এখন থেকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ব্যবসা শুরুর অধিকার পেল সৌদি নারীরা। এরফলে সৌদি নারীদের এখন থেকে স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়ের অনুমতি ছাড়াই নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারবে।
২০১৮: সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনার দুই গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের প্রশাসনে নিয়োগ পেলেন নারী।
২০২০: হজ্বের নিরাপত্তায় প্রথমবারের মতো সৌদি নারী পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ।
২০২০: প্রথমবারের মতো নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।
২০২১: সৌদি সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাবেন নারীরাও।
নারী বিষয়ে এ সকল পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে সারাবিশ্বে।
তবে এখনো সৌদি আরবের অনেক নারী অধিকারকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক নারী অধিকারকর্মী জেল কাটছেন। তারা সৌদি আরবের অভিভাবকত্ব আইনের সম্পুর্ণ বিলুপ্তি চান।
তাছাড়া সৌদি আরব তাদের তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে আসতে চাইছে। কারণ তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বে তেলের চাহিদাও কমছে।তাই তারা পর্যটনকে গুরুত্ত দিচ্ছে। পর্যটন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি টানতে লঘু করা হয়েছে সামাজিক বিধিনিষেধ। যেমন, অবিবাহিত বিদেশি নারী ও পুরুষদের হোটেলে একসঙ্গে থাকার ছাড়পত্র দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি, বেড়েছে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি।
তারা দেশের নাগরিকদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে।আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষায় গুরুত্ত দিচ্ছে। ভিবিন্ন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দিয়ে জনগোষ্ঠিকে উদার (Liberal) করার চেষ্টা করছে।যারই অংশ হিসেবে পড়ানো হবে ভারতের রামায়ন -মহাভারত।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন সৌদি আরব তার গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।তাই এই দেশে যারা এখনো সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন তারা সেই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। আপনাদের সামনে থেকে রক্ষণশীল রাষ্ট্রের উদাহারণটি সরে যাচ্ছে। অযথা প্রগতির পথে বাধা হওয়া বন্ধ করুন। নয়তো ইতিহাসের আস্তাকুড়ে আপনাদের নাম লিখিত রবে।