গত ২৮শে এপ্রিল গুলশানের একটি ফ্লাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় চলছে আলোচনা সমালোচনা। জানা গেছে, গুলশানের ঐ বাসায় কলেজছাত্রী মুনিয়া একাই থাকতেন এবং তিনি কলেজ শিক্ষার্থী ছিলেন।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, নিহত মুনিয়ার বাড়ি কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার মনোহরপুরের উজীর দীঘির পাড়ে৷ সে রাজধানীর একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান।
বাড়ি কুমিল্লায় হলেও পড়াশুনার করার জন্য একাই ঢাকায় থাকতেন। যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন, সে বাড়ির মাসিক ভাড়া ছিল ১লক্ষ টাকা এবং সার্ভিস চারজ ১১হাজার টাকা। বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে প্রণয় গড়ে ওঠে। অতঃপর ২০১৯ সাল থেকে তারা বনানীতে একটি ফ্লাট ভাড়া নিয়ে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন।
২০২০ সালের কোন এক সময় আনভীরের পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রণয় এবং একসাথে বসবাস করার বিষয়টি অবগত হলে, মুনিয়াকে ডেকে পাঠায় আনভীরের মা। তিনি মুনিয়াকে বকাবকি করেন এবং আনভীরের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করে ঢাকা ত্যাগ করতে বলেন। এরপরে পরিস্থিতি শান্ত করতে আনভীর ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে মুনিয়াকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। সে সময় তিনি মুনিয়াকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি দেবেন এবং সেখানে ঘরসংসার করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপরে মুনিয়া কুমিল্লায় তার বোন নুসরাত জাহানের বাড়িতে গিয়ে কয়েকমাস থাকেন।
২০২১ মার্চ মাসে আনভীর ১লক্ষ টাকা মাসিক ভাড়ায় গুলশানে ফ্লাট ভাড়া নেন এবং মুনিয়া তিনি ঢাকায় ডেকে পাঠান। গুলশানের এই ফ্লাটে মুনিয়া একাই থাকতেন এবং মাঝে মধ্যে আনভীর এই ফ্লাটে যাতায়াত করেন।
গত ২৩শে এপ্রিল বাড়িওয়ালার বাসার ইফতার পার্টিতে মুনিয়া যোগ দেন। সেই পার্টির ছবি বাড়িওয়ালী ফেসবুকে পোস্ট করেন। বাড়িওয়ালীর ফেসবুক বন্ধুর তালিকায় পিয়াসা নামের একজন আনভীরের পরিবারকে মুনিয়ার কথা জানিয়ে দেয়। এই নিয়ে আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার কথা কাটাকাটি ও মনোমালিন্য হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি অডিও ক্লিপে মুনিয়া ও আনভীরের বাক্যালাপ শুনতে পাওয়া যায়। সেখানে আনভীর মুনিয়াকে চোর অপবাদ দিয়ে, ৫০লক্ষ টাকা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া জানান, নুসরাতকে ফোন করে মুনিয়া জানিয়েছে, ‘ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার পার্টিতে গিয়ে কেন ছবি তুলেছি এর জন্য আনভীর আমাকে বকা দিয়ে গালিগালাজ করেছ। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি পিয়াসা (সম্ভবত আনভীরের আত্মীয়) দেখেছেন। পিয়াসা মালিকের স্ত্রীর ফেসবুক বন্ধু। এখন পিয়াসা তার মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন। তিনি (আনভীর) দুবাই যাচ্ছেন, আমাকে কুমিল্লায় ফিরে যেতে বলেছে। আনভীরের মা জানতে পারলে আমাকে মেরে ফেলবেন।’
সোমবার সকালে মুনিয়া ফোন করে বোন নুসরাতকে জানান, মুনিয়া তার শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুনিয়াকে তিনি ছাড়বেন না। মুনিয়া চিৎকার করে বোনকে বলেন, আসামি (আনভীর) তাকে ধোঁকা দিয়েছে। যেকোনো সময় তার বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদী নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।
সোমবার (২৬ এপ্রিল) সকালে মুনিয়ার এই ফোনের পর আত্মীয়স্বজন নিয়ে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত বেলা দুইটার দিকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় রওনা দেন। আসার পথে বারবার মুনিয়ার ফোনে কল করেন। কিন্তু তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলশানের বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নিচে নেমে আসেন। তারা নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে বাসার ইন্টারকমে ফোন করেন। পরে ফ্ল্যাটের মালিকের নম্বরে ফোন দিলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার পরামর্শ দেন। মিস্ত্রি ডেকে তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি দেখেন, তার বোন ওড়না প্যাঁচিয়ে শোয়ার ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আছেন।
২৬শে এপ্রিল সন্ধ্যার পর গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান (মুনিয়া) নামের এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবাহান আনভীরকে আসামী করে মামলায় দায়ের করেন।
সোমবার দিবাগত রাত পৌনে একটার দিকে গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইমরান হোসেন মোসারাতের লাশের সুরতহাল করে তার লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রেখে যায়।
২৭শে এপ্রিল, মঙ্গলবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মুনিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও এলাকায় তার বড় বোনের বাসায় নিয়ে আসা হয়। বাদ আসর কুমিল্লা নগরীর টমসমব্রিজ কবরস্থানে বাবা মায়ের কবরের পাশে মুনিয়ার দাফন সম্পন্ন করা হয়।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘মুনিয়ার মৃহদেহ উদ্ধারের পর সেখান থেকে তার মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের আলামত উদ্ধারের সাথে ৬টি ডায়েরি পাওয়া যায়। এসব ডায়েরিতে কী লিখা আছে, তা যাচাই করা হচ্ছে।’
পুলিশ মামলাটি হওয়ার পর সায়েম সোবাহান আনভীরের বিদেশযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে একটি আবেদন করেছিল পুলিশ। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে।
ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান মোহাম্মদ নোমান মামলার এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৩০শে মে দিন ধার্য করেন। এরপরেই বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভিরের বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
যদিও আদালত থেকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও ইতিমধ্যে বসুন্ধরার এমডি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে গুঞ্জন শোনা গেছে। কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশ (তদন্ত) সংশ্লিষ্টদের নিশ্চিত করেছে যে, আসামির পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ দেশের বাইরে যাননি। কার্গো বিমান, ব্যক্তিগত বিমান বা যে কোনো ধরনের বিমান ব্যবহার করে কেউ দেশের বাইরে গেলে অবশ্যই ইমিগ্রেশন সিস্টেমে সে বিষয়ে তথ্য থাকবে। কিন্তু মুনিয়া আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে দায়ের করা মামলার আসামি আনভীরের বিদেশযাত্রা সংক্রান্ত কোনো তথ্য ইমিগ্রেশনে নেই।
পুলিশ ইতিমধ্যে ২৩শে এপ্রিল থেকে ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী, বাড়ির মালিক, মালিকের জামাতা ইব্রাহিম আহমেদ রিপন ও তার স্ত্রীকে। মডেল হিসেবে পরিচিত ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাদ করা হবে বলে জানিয়েছেপুলিশ।
পুলিশের জব্দ করা একটি ডায়েরিতে মুনিয়ার সর্বশেষ লিখেছিলেন, ‘আনভীরের সঙ্গে প্রেম করা আমার ভুল ছিল। বিবাহিত ও বাচ্চার বাবার সঙ্গে প্রেম করা ঠিক হয়নি। তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছাড়া বিয়ে হয় না। আনভীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আনভীর আমাকে ভুল বুঝেছে। তাই আমি জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাল এসে আনভীর তার ভুল বুঝতে পারবে।’ যদিও মাস, দিন, সময় উল্লেখ নেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া শারুনের সঙ্গে মুনিয়ার কিছু কথোপকথনের স্ক্রিনশটের সূত্র ধরে সরকারদলীয় হুইপ ও চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে শারুন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে শারুন চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তার কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন। যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো তিনি জানিয়েছেন। জানতে চাওয়া হয় তিনি মুনিয়াকে চেনেন কি না। জবাবে তিনি জানিয়েছেন, মুনিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। গত বছর মুনিয়া ফেসবুকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবে শারুনের দাবি, মুনিয়ার মৃত্যুর পর ফেসবুকে তার সঙ্গে কথোপকথনের যে স্ক্রিনশট ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো মিথ্যা। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে এই কথোপকথনগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও দাবি জানান তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুদে বার্তার ওই কথোপকথনে মুনিয়া শারুনকে লেখেন, তিনি ভালো নেই। এরপর লেখেন, ‘উনি তো আমাকে বিয়ে করবে না। কী করব আমি?’ জবাবে শারুন লেখেন, ‘আগেই বলেছিলাম, ওর কথা শুইনো না। ও আমার বউকে বলছে বিয়ে করবে, কিন্তু করে নাই। মাঝখানে আমার মেয়েটা মা ছাড়া হয়ে গেছে।’
২৮শে এপ্রিল, মুনিয়ার মামলায় বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। গতকাল বুধবার তিনি গনমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
২৮ এপ্রিল বুধবার দুপুরে গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম হোসেনের লেখা একটি সুরহতাল সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুনিয়ার বয়স ২৩ বছর। গায়ের রং ফর্সা। লম্বা অনুমান ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। মাথার চুল লম্বা অনুমান ১২ ইঞ্চি। চুলের রং বাদামি। মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক স্বাভাবিক, চোখ দুটি বন্ধ, জিহবা মুখ থেকে আধা ইঞ্চি বাহিরে, দাঁত দিয়ে কামড়ানো, দুইটি দাঁত দেখা যায়। জিহবা দিয়ে সামান্য লালা বের হয়েছে। গলার বামপাশে অর্ধচন্দ্রাকৃতি গভীর কালোদাগ রয়েছে। হাত দুটি শরীরের সঙ্গে লম্বালম্বি অর্ধমুষ্টি। মৃতের বড়বোনের দ্বারা লাশ ওলটপালট করে বুক পেট ও পিঠ স্বাভাবিক দেখা যায়। মলদার স্বাভাবিক, যৌনাঙ্গে দিয়ে লালচে রঙের পদার্থ বের হতে দেখা যায়। দুই পা লম্বালম্বি, পায়ের আঙুল নিম্নমুখী।
সুরতাহল প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই হয় ময়নাতদন্ত। এরই মধ্যে ময়নাতদন্ত শেষ হলেও এখনো প্রতিবেদন আসেনি। এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এলেই প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসবে। তবে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আমার বোন মুনিয়া আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে না। আমরা মনে করছি এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাতে চাই, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’