শনিবার, ১ আগস্ট ২০১৫ : দীর্ঘ ৬৮ বছর পর গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে ‘ছিটমহল’ শব্দটি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এখন থেকে বাংলাদেশ ও ভারতে আর কোনো ছিটমহলের অস্তিত্ব নেই। নেই ছিটমহলবাসীও। তারা সবাই স্বাধীন সার্বভৌম এই দুই দেশের নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদা পেয়েছেন। গতকাল দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশের এবং ভারতের অভ্যন্তরের ছিটমহলগুলোতে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে জীবনের নতুন পরিচয়ে প্রবেশ করেন তারা। ৬৮ বছরের কার্যত দুঃসহ বন্দিজীবন অবসানের প্রতীক হিসেবে তারা প্রত্যেক বাড়িতে জ্বালিয়েছেন ৬৮টি করে মোমবাতি। মোমের আলোয় অবসান ঘটে তাদের দীর্ঘ ৬৮ বছরের গøানিকর জীবনযাপন। মুক্ত-স্বাধীন জীবনের স্বাদ গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করতে ছিটমহলের রাস্তায় রাস্তায় ছিল মোমবাতি, মশাল নিয়ে আনন্দ মিছিল। আনন্দ-উৎসবের আমেজে নতুন পরিচয়ে নতুন জীবন শুরু করেছেন তারা।
ছিটমহলের বিদায় : মুক্তজীবনে ফিরল ৫৫ হাজার মানুষ
সাময়িকী.কম
স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিকত্ব লাভের বিশেষ এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল এবং সুবিধামতো সময়ে মন্দিরে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে উৎসব আয়োজন শুরু হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নৌকা বাইচ, ঘোড় দৌড়, লাঠি খেলা। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ছিটমহলগুলোতে শুরু হয় আলোকসজ্জা, রাস্তায় রাস্তায় মশাল প্রজ্বলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র জন্মের সময় সীমারেখা নির্ধারণে লর্ড মাউন্টবেটনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। ওই বছরের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। এর কদিন পর ১৩ আগস্ট তিনি এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা হয়। অভিযোগ আছে গভীর ভাবনাচিন্তা ছাড়াই জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সময় না নিয়েই সীমানা মানচিত্র তৈরি করা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেলেও অনেক পরে স্বতন্ত্র রাজ্য কুচবিহারের মহারাজা নারায়ণ ভুপ বাহাদুর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হন। ভারত ও পাকিস্তান অংশে বিভিন্ন মৌজায় রাজার খাস খতিয়ানভুক্ত জমি ভারতের অধীনে চলে গেলে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি মোট ১১১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। যার আয়তন ১৭১৫৮.১৩ একর।
অন্যদিকে ময়মনসিংহের কাশিমবাজার স্টেটের মহারাজা শ্রীশ চন্দ্র নন্দী, কুড়িগ্রামের পাঙ্গারাজা শচীন চন্দ্র কোঙ্গার, দিনাজপুরের মহারাজা গিরীজা প্রাসাদ, রংপুরের রাজা জগৎ ভূপেন্দ্র নারায়ণ ও নীলফামারীর মহারানী বৃন্দা রানী পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ভারতীয় ভূ-খণ্ডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মৌজায় অবস্থিত নিজস্ব খাস খতিয়ানভুক্ত জমিগুলো সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। এর সংখ্যা ৫১টি। যার আয়তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশ ভাগের সময় রেডক্লিফ কমিশনের মানচিত্রে ছিটমহল জটিলতার শুরু। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ওই সমস্যার অবসানে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়। এরপর তা কার্যকরে প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালে। চলতি বছরের ৭ মে ভারতের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই চুক্তি বাস্তবায়নের পথ তৈরি হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হয়। আর দলিল হস্তান্তরের পর থেকেই শুরু হয় ছিটমহল শব্দটি বিদায়ের আয়োজন। শুরু হয় যৌথ সমীক্ষা। সর্বশেষ ৬-১৬ জুলাই যৌথ সমীক্ষানুযায়ী, এখানকার ৪১ হাজার ৪৪৯ জন নাগরিকের মধ্যে ঠিকানা পরিবর্তন করে ভারতের মূল ভূ-খণ্ডে যাওয়ার আবেদন করেছেন ৯৭৯ জন। তাদের বিশেষ নিরাপত্তায় আজ ১ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বুড়িমারী, হলদিবাড়ি ও সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অপরদিকে ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ১৪ হাজার মানুষের কেউ বাংলাদেশে আসতে আগ্রহ দেখায়নি।
স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসারে গতকাল শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ক্যালেন্ডারের তারিখ ১ আগস্টে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয় ছিটমহল বিনিময়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ‘ছিটমহল’ নামক ক্ষুদ্র ভূ-খণ্ডগুলোতে বসবাসকারীরা অর্জন করেন স্বাধীন দেশের নাগরিকের পূর্ণ সম্মান, মর্যাদা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে এক অনুষ্ঠানে উভয় দেশের ছিটমহলের ‘খণ্ড মানচিত্র’ (স্ট্রিপ ম্যাপ) হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পেল ১১১ ছিটমহল। আর ভারত পেল ৫১ ছিটমহল। আমাদের ভূমি মন্ত্রণালয় ১১১ ছিটমহলকে বাংলাদেশের অংশ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করবে। এখন থেকে এগুলো আর ‘ছিটমহল’ বলে পরিচিত হবে না। আপতত ছিটভিত্তিক নম্বর দিয়ে পরিচয় নির্ধারণ করা হবে।
খণ্ডমানচিত্র হস্তান্তর করেন বাংলাদেশের পক্ষে দিল্লিতে বাংলাদেশি হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এবং ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শফিউল আলম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, অতিরিক্ত সচিব এ কে এম রহমতুল মুনিম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া), ভূমি রেকর্ড জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল জলিলসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই ছিটমহলগুলোতে উৎসব শুরু হয়। মসজিদ, মন্দির ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভার মাধ্যমে নতুন জীবন শুরুর বন্দনা করেন উভয় দেশের ছিটমহলবাসী। আর নাগরিকত্ব লাভের মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করতে দিনব্যাপী ছিল নানা আয়োজন। রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমের আলোয় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সব আয়োজন পূর্ণতা লাভ করে।
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ঐতিহাসিক এ মুহ‚র্ত স্মরণীয় করে রাখতে কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলের বাসিন্দা ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। মশাল ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রার্থনা, গ্রামীণ খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, ঘোড় দৌড়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা, সন্ধ্যায় ছিটমহলগুলোর প্রতি বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি প্রজ্বলন, আলোকসজ্জা, রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮ বার তোপধ্বনির আয়োজন করা হয়েছে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরের দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলে গতকাল দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবনের অবসান ঘটানো হয়। পোড়ানো হয় আতশবাজি, উড়ানো হয় ফানুস।
কালীগঞ্জ (লালমনিরহাট) সংবাদদাতা জানান, কালীগঞ্জের ছিটমহলগুলোতে বিকেল ৪টায় দেশীয় খেলাধুলা, যেমন- হা-ডু-ডু, লাঠি খেলা, জারি ও ভাওয়াইয়া গান, সন্ধ্যায় সারা ছিটমহলে মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করা, রাত ১২টায় ৬৮টি মোমবাতি একসঙ্গে জ্বালানো, ১২টা ১ মিনিটে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, ১ আগস্ট সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছিটমহলের প্রতিটি বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মিষ্টি বিতরণ করা হবে। ভোরের কাগজের সৌজন্যে।
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কর্মজীবী এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন