এখানে অপরাহ্ন
সামনে বইছে নদীটা দুর্বার
নিরন্তর উত্তাল উজানে…
আছড়ে পড়া দুরন্ত ঢেউ
পাড় ভাঙছে কারণে-অকারণে।
চার ধার রক্তিম ঘেষা হলুদ মেশা
ঠিকরে পড়া আলো, উদ্ভাসিত!
চিকচিক করছে জল , টল টল।
বয়ে চলেছে আদি অনাদি প্রবাহ ,
ছুটছে সময়, মহাকালের মোহনায়।
কবে সেই! মিশেছি এ জলে
চলেছি! হেসেছি! খেলেছি!
দুলেছি অজস্র দোলে
ভেসেছি কি হিল্লোলে,
কত কি ভুলেছি তার…
এখনো সবটা যায়নি ভুলে।
এখনো এখানে সন্ধ্যা আসেনি নেমে ,
বাসন্তী বাতাস এ মালঞ্চে আজ ও
কখনো কখনো এসে,
কত বসন্তের কত কথা
বলে যায় কানে, হেসে।
এখনো তমসা, খানিক দূরে…
প্রাচীন অভ্যাসে রাত্রি আসবে
সন্ধ্যার হাত ধরে।
দিন ডুবে যাবে, প্রচলিত এক
পদযাত্রায়, গহন অন্ধকারে।
আকাশে এখনো বর্ণালী আজও
এ যে অপরাহ্নের আলো!
পশ্চিমের খেলা, কি আবির ঢালা!
এই শেষ রাগ! এ অস্তরাগ !
চোখে বুকে প্রাণে মাখো।
কত কি শিখেছি, কত কি শিখেছ
ফুরানো আলোর অবশেষ টুকু
এই বেলা শেষে আজ
যতনে কুড়িয়ে রাখো।
বাকি বাঁচা টুকু এখনো বাঁচতে হবে।
অলৌকিক কোনো ভালোবাসা!
বুকে বুকে আজ ও, রঙ ঢেলে যাক
দুর্লভ, বিস্মিত অনুভবে।
ওরা ওদের পৃথিবীর
তুমি মানুষ! সারাটা সকাল
হেঁটেছ ,পড়েছ, উঠেছ, ছুটেছ।
মধ্যাহ্নে প্রখর দীপ্ত তুমি!
আলো দিয়েছো অন্ধকারের কোনায় কোনায়,
তাপ দিয়েছো, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়।
অপরাহ্নে বেলাশেষের পড়ন্ত সূর্য।
সারা আকাশ গোধূলির,
শেষ আলো রক্তিম।
নীড়ে ফেরা পাখির ডানায়
আসন্ন সন্ধ্যার চিরন্তন সংকেত।
সন্ধ্যায় আবছা ঝাপসা পৃথিবী
আলো-আঁধারির খেলা ক্ষণিকের ।
তুলসী তলায়, প্রদীপ কম্পিত নিভু নিভু
শঙ্খ নিনাদে বাতাসে বাতাসে
রাত্রির চিরন্তন আহ্বান।
গহন রাত্রি, তুমি পড়ে আছ
একফালি দুর্গন্ধ বিছানায়,
চাদরটা বদলে দেবার তাড়া নেই।
বাড়ির যে অংশটার কাড়াকাড়ি নেই,
অবাঞ্ছিত সেই বাড়তি টুকু
আজ বরাদ্দ তোমার জন্য।
চোখ তোমার এখন ও দেখতে চায়।
গোনা কয়েকটা সকালের সূর্য
এখনো হতে পারে তোমার।
তার অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ
তোমার সীমানা পর্যন্ত।
পুরনো ধুলোপড়া আসবাবের মত
পড়ে আছো একধারে
সারিসারি ব্যস্ত পায়ের আনাগোনা
সারাদিন তোমার চারধারে
সময় দু’দণ্ড আর বসে না
তোমার নিঃসঙ্গ চাদরে।
ওরা তোমার সন্তান সন্ততি
তোমার একান্ত আপন।
আজীবন রক্তমাখা ঘামের বিনিময়ে
এক একটা গোটা পৃথিবী কিনেছো
এর ওর তার জন্য।
আজ তোমার রোগ যন্ত্রণার
একলা বিছানার,
অন্তিম অভিমানী অশ্রুর
ওরা কেউ নয়।
ওরা শুধু ওদের পৃথিবীর।
জীবন
আত্মকেন্দ্রিক মানুষের,
লালসাপুষ্ট আত্মতুষ্টি নয়,
আত্মসুখে আত্মমগ্ন, দিনাতিপাত নয়,
আত্ম চর্চা, আত্মদান, আত্ম দর্শনই জীবন।
বাঁচা ও বাঁচতে দেবার নাম জীবন।
মহাবিশ্বে সময়ের মহা স্রোতে,
তুচ্ছ খড়কুটোর মতো নিরন্তর প্রবাহমান…
অভিন্ন গল্পটাই জীবন।
মুখে মুখে সংজ্ঞা তার বিচিত্র ও বিভিন্ন।
জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি।
দু’দণ্ড বিরাম নেই খরায় ও মড়কে,
এপাড়া ওপাড়া গ্রামে নগরে বন্দরে…
প্রলয় ও বর্ষনে তার,
প্রতিপল অনন্ত চলাচল।
দু চোখে কান্না, ঠোঁট ছুঁয়ে হাসি
পায়ে পায়ে কাঁটা,
হাতে ফুল রাশি,
বিশ্বাস অবিশ্বাস, ঘৃণা ভালোবাসা
বুক জুড়ে একাধারে,
দেশভেদে কাল ভেদে নেই রূপান্তর,
সে অনন্য, সে অভিন্ন।
জীবন কোন রূপকথা চুপকথা
উপকথা বা লোকগাথা নয় ,
আবেগের উড়ন্ত ফানুস কিংবা
কলমের ছুটন্ত কাব্য নয়।
নিরাপদ দূরত্বে বসে, মনোরম অভিযান নয়,
উপলব্ধির মহাসাগরে তলিয়ে,
খুঁজে পাওয়া মনিমালাই জীবন।
প্রয়াসের দরকার নেই।
জীবনকে বুঝিয়ে দেয় জীবন।
তাই মনে আছে
ভালোবাসা! তোমাকে ভালোবাসি আজও…
তুমি আমার জন্য, মহুয়া কুড়িয়েছো বনে ,
রেখেছ তা বসন্তের সবুজ আবিরে ।
তোড়া বেঁধেছো লাল গোলাপের,
তোমার রক্তিম অনুরাগে।
জুঁইয়ের মালা কিনেছো গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়
পরিয়ে দিয়েছো তা
কত বর্ষায় বিমুগ্ধ ভালো লাগায়।
হতবাক বিস্ময়ে, অহংকারে, গৌরবে
ভালোবাসা! তোমাকে পেয়েছি কতবার
কত রূপে, পরিপূর্ণ সার্থকতায়।
ভালোবাসা! তোমার ম্যাজিক আয়নায়
আমি রূপসী! মেনকা! উর্বশী! রম্ভা!
ভালোবাসা! তুমি এসেছিলে বলে,
নদীতে ভাদ্রের ভরা কোটাল
এপার ওপার তোলপাড় , একাকার।
ভালোবাসা! তোমাকে হাসতে দেখেছি
তার দু চোখের গহন নীলিমায়।
তোমাকে উঠতেও দেখেছি,
আমার উঠোন বাগান পেরিয়ে
চলে গেছো অগস্ত্য যাত্রায়…
ভালোবাসা! তোমাকে ভালোবাসি আজও।
কেননা একমাত্র তুমিই,
নিঃস্বার্থ এবং নিঃশর্ত।
পূজা
দেখেছি, মা ঠাকুমা তুলসী তলায়…
লাল পেড়ে শাড়ি গলায় আঁচল
হাতে প্রদীপ মুখে শাঁখ ,বাতাসে নিনাদ
একই সময়, একই রুটিন
নতজানু নত শির প্রতিদিন। আমরণ…
টিম টিমে প্রদীপের আলোয়
উদ্ভাসিত দৃঢ় বিশ্বাসী মুখ
দমকা বাতাসে প্রদীপের নিভু নিভু শিখা
হাতের আড়াল টেনে, শেষ পর্যন্ত
তাকে আমরণ জ্বালিয়ে রাখা
এ প্রচেষ্টা, এ প্রত্যয়, এ বিশ্বাস
এটাই পূজা। পূজা আর কিছু নয়।
তোমারও উঠোন, বাগান, ঘর সংসার
এঘর ওঘর ঠাকুরঘর।
তিলে তিলে তেত্রিশ কোটি দেবতার সমাবেশ
আচার – বিচার -উপকরণ- আয়োজন
আজ নিরামিষ ,কাল নিরন্ন।
কে আরাধ্য তোমার? কি আরাধনা?
ফলের তপস্য? ফুল ফুটেছে কি?
শ্বেত পদ্ম? নিভৃতে গভীরে অন্তরে?
মুছে ছো কি কালিমা? ধুয়েছ কি ঘর?
পেতেছো কি আসন সত্যের উপর?
জ্বেলেছো কি প্রদীপ মর্মের মর্মস্থলে
চেতনা চৈতন্যের?
কি নৈবেদ্য, কি নিবেদন? কি সমর্পণ?
নিয়ত ফোটাও আপনাকে
রাখো সে শতদল জীবনের পায়ে
এটাই পূজা। পূজা আর কিছু নয়।
একটাই পূর্ণাঙ্গ কবিতা
একটাই কবিতা লিখেছিলাম
মাত্র একবার, একটাই।
একটা পূর্ণাঙ্গ কবিতা।
ভাষা এসেছিল পাথরচাপা বুক ঠেলে,
ছন্দ নেমেছিল ঢেউ লাগা হৃদয় চুঁয়ে।
অনুভবে অলংকারে ঝংকারে ,
সুর লেগেছিল অন্তরের অন্তরীক্ষে।
বাতাবি ফুলের গন্ধ,দিয়েছিলাম তাকে।
আম্রমুকুলের মাদকতা ছিল তাতে।
আষাঢ়ের জল তরঙ্গ ,ভাদ্রের থৈথৈ
অঝর শ্রাবন দিয়েছিলাম তাকে।
শরতের দে দোল! মাঠ মাঠ কাশ,
শিউলির বাতাস দিয়েছিলাম তাকে।
কবিতার ভাব কে দিয়েছিলাম
বিস্তীর্ণ নীল আকাশ…
আকাশকে, অনুরাগের লালী।
ছিল যুঁই, ছিল গোলাপের ডালি।
বাগানকে দিয়েছিলাম
বসন্তের উতলা বাতাস,
‘সে’ আমার একমাত্র বাসন্তী কবিতা।
তাকে ঘর দিয়েছিলাম, আত্মার কাছাকাছি।
এক ঘর বিশ্বাস আর,একবুক নিঃশ্বাস।
লিখতে লিখতে কবিতা,
বেদ পুরাণ গীতা বাইবেল একাকার।
কবিতা মন্দির, কবিতাই বিগ্রহ
কবিতা নৈবেদ্য, কবিতাই পূজা।
লিখতে লিখতে কবিতা
সে এক অজানা ঝড়
মেঘ ছিল না আকাশে,
পূর্বাভাস ছিল না বাতাসে
তছনছ কবিতা, হারানো সে খাতা
মনে নেই ,কোন সে তারিখ,
ছিল কোন মাস, কি বা ছিল বার?
ভেঙেচুরে কবে, কবিতা ছাড়খার।
মনে নেই কালবৈশাখী কিংবা
সে ঝড় আশ্বিনে,
ঝড়ের মরশুম কোনো ছিলনা,
আজও নেই মানুষের জীবনে।
ঘর ভাঙলে ঘর হয়
কবিতা ভাঙ্গলে আর নয়…
একটাই কবিতা লিখেছিলাম
লিখেছিলাম একটাই, একবার।
একটাই পূর্ণাঙ্গ কবিতা।