নতুন বছরের আলোচিত ঘটনাগুলির মধ্যে সদ্য অবসরে যাওয়া কবির বিন আনোয়ারের খুবই স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন, তাঁকে অবসরে পাঠানো, অবসরের পরে তাঁর কর্মকান্ড কিংবা তাকে নিয়ে সরকারের কর্মকান্ড অন্যতম ঘটনা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানে সরকারি চাকুরীজীবীদের বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী অবসরে যাচ্ছেন, তাঁকে নিয়ে এত হৈহৈ-রৈরৈ করবার কি আছে? আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। প্রজাতন্ত্রের এই কর্মচারীরাই আজ কর্মকর্তা, নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, সচিব, সিনিয়র সচিব নানা নামে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্ণধার। তাঁদের নানা কীর্তি, অপকীর্তি, দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সংবিধান অনুসারে যারা দেশের সত্যিকারের মালিক তারাই আজ কোণঠাসা। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্থাৎ মালিক কিংবা নাগরিকের অনুপাতে এই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। কিন্তু তারপরও তারা কিভাবে জনতার উপর ছড়ি ঘোরান, এমনকি আমাদের কথিত রাজনীতিবিদদের উপরও তারা কত্রিত্ব করছেন কিভাবে?
এর নানামাত্রিক কারণ রয়েছে। সেই আলোচনায় যাবার আগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদেরকে কর্মকালীন এবং অবসরে যাবার পরও সরকারের যে তোষণ নীতি আমাদের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতিসহ নাগরিক জীবনে এগুলির প্রভাব কেমন হতে পারে সে বিষয়ে আলাপে যাওয়া প্রয়োজন। কবির বিন আনোয়ারের বিষয়টাকে সামনে রেখেই যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখব, এত অল্প সময়ের সময়ের জন্য মন্ত্রীপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন এবং অবসরে যাওয়া নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, আজকে আমার সরকারি চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে, এটি রুটিন মাফিক বিষয়। চুক্তিভিক্তিক হওয়া সুযোগের বিষয়। এখন যেটা হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা বুঝেশুনে নিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্তের প্রতি আমার সম্মান রয়েছে। তবে পরে হয়ত অন্য কোনো ভাল জায়গাতেও আমাকে দেখতে পাবেন।
ভাল জায়গা কোনটা সেটা আজ আর কারো অজানা নয়। এখন কথা হল, প্রধানমন্ত্রী বুঝেশুনে যদি তাঁকে রাস্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব দিতেন, তাহলে আমরা বুঝতাম যে তাঁর মত কথিত দক্ষ এবং বিচক্ষণ মানুষের রাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে, তাই প্রধানমন্ত্রী তাঁর মেধা এবং যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পেলেন আওয়ামলীগের নির্বাচন সমন্বয়ের এবং এটাই তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল। সংকটটা এখানেই। সরকার এবং দল মিলেমিশে একাকার। এমন যদি হত অবসরে যাবার পর, তিনি আওয়ামলীগের দলীয় প্রধানের সাথে দলের কার্যালয়ে দেখা করে রাজনীতিতে যুক্ত হবার বাসনা ব্যক্ত করেছেন, কিংবা দলীয় প্রধান তাঁকে দলের কার্যালয়ে ডেকে দলীয় দায়িত্ব নিতে আহবান জানিয়েছেন, তাহলেও বিষয়টাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যেত। কিন্তু কবির বিন আনোয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন গণভবনে। তিনি আসলে কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি আওয়ামলীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সাথে? সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন। দায়িত্বটা কি তা আপনারা সময়ে সময়ে জানতে পারবেন। কাজের মধ্য দিয়ে তা আস্তে আস্তে পরিস্কার হবে। এই যে দল এবং সরকার, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কর্মজীবনে এবং অবসরে যাবার পর যথেচ্ছাচারের অপসংস্কৃতি এগুলি আমাদের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। এখন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এগুলি তো নতুন কিছু নয়। আগেও ছিল। আগে ছিল, সমালোচনাও ছিল। কিন্তু আওয়ামলীগ এগুলিকে তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করে ফেলছে।
আরও একটা বার্তা এবারে পোক্ত হল, যে আওয়ামলীগ যতই দেশের প্রাচীন দল, গণমানুষের সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল ব্লুক না কেন দলীয় নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য একজনও নেতাও এই দলটির মধ্যে নেই। দলের নানাস্তরে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, উপদেষ্টামন্ডলী আছে, দলীয় এমপি, মন্ত্রী আছে কিন্তু একজনও বিচক্ষণ নেতা নেই। কিংবা নির্বাচন সমন্বয়ের কাজ নেতাদেরকে দিয়ে হয় না। প্রাক্তন আমলারাই এটার জন্য উপযুক্ত। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উর্ধতনদেরকে অনুসরণ করে। তাই আজ মাঠ প্রশাসনে যে ছেলেটা সবে চাকুরিতে প্রবেশ করেছে, তার মনেও এমন স্বপ্ন অস্বাভাবিক না যে, কবির বিন আনোয়ার স্যারের মত আমি যদি সরকারকে সার্ভিস দিতে পারি, তাহলে আমার জন্যও একদিন ওই জায়গায় যাওয়া অসম্ভব নয়। কাজেই জনগণ নয়; সরকারকে খুশি রাখাই আমর সামনে এগিয়ে যাবার একমাত্র পাথেয়। এই সব সমীকরণের যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অভিঘাত, তার ফলাফল কথিত রাষ্ট্রের মালিকদেরই ভোগ করতে হচ্ছে এবং হবে।
কবির বিন আনোয়ারকে আওয়য়ামলীগ কেন এই পদে? এই প্রশ্নের জবাবে গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে যেটা দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামলীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারপার্সন এইচ টি ইমামের শূন্যতা পূরণের জন্যই এই উদ্যোগ। আসলে বিষয়টাকে অত সাদাচোখে দেখবার সুযোগ নাই। কবির বিন আনোয়ার তাঁর কর্মজীবনে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনি না যত রাষ্ট্রের অনুগত, তার চেয়ে বেশি সরকারের। আরো খোলামেলা বললে, বলতে হবে আওয়ামলীগের। প্রশাসনে একটা কথা প্রচলিত আছে, মন্ত্রীপরিষদ সচিব হলেন, সচিবদের সচিব। তাই সরকার তথা আওয়ামলীগ তাকে দিন কয়েকেকের জন্য হলেও সেই সীলটা তার গায়ে লাগিয়ে এখন সেই সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছেন হয়ত আগামী নির্বাচনে। সদ্য অবসরে যাওয়া রাষ্ট্রের কথিত সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার আদেশ, নির্দেশ কিংবা অনুরোধ কি আর মাঠ প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্ণধারেরা না শুনে পারবেন?
একইসাথে দলের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হলে দলীয় প্রধান। তিনি ব্যতীত দলের অন্য কেউ নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্ব নিলে দলের নেতাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দিতে পারে। আমলা তোষণ যেখানে আওয়ামলীগের মত দলে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, সেখানে এই সিদ্ধান্তকেই হয়ত সকলে স্বাগত জানাবেন। এগুলি নির্বাচনে জিতবার, পরিস্থিতি সামলাবার আপাত কৌশল হিসাবে ফলদায়ক হলেও যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে, তাতে দূর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি একই সাথে মহীরুহ হয়ে উঠছে দেশের প্রশাসন এবং আমলাতন্ত্র। রাজনীতিতে আজ রাজনৈতিক জ্ঞান এবং দক্ষতার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থ-বিত্ত্ব-পদ-পদবী। হোক না সেই পদ সাবেকী কিংবা সদ্য সাবেকী।